আগাম বন্যা নয়, এসব বাঁধ-ব্যবসার খেসারত

এবার বর্ষা এসেছে দেরিতে কিন্তু বন্যা দেরি করেনি। মূলত ভারতে তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র ও বরাক অববাহিকায় একটানা ভারী বৃষ্টি আর উজানের জলাধারগুলি খুলে দেওয়ায় আমাদের বিভিন্ন নদ-নদীর পানি ৬৮টি পয়েন্টে বেড়েই চলেছে। এর মধ্যে ১৪টি নদীর ২৫টি পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে। নদ-নদীর পানি মাপার দায়িত্বে থাকা পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্য (শ্রাবণ ১, জুলাই ১৬, দুপুর ১২টা) অনুযায়ী সুরমা-কুশিয়ারা ছাড়া দেশের প্রায় সব নদ-নদীর পানি বাড়ছে। বাংলাদেশ আর ভারতের আবহাওয়া দপ্তর জানাচ্ছে, রংপুর ও সিলেট বিভাগ আর তার লাগোয়া ভারতীয় রাজ্য আসাম-মেঘালয়ে আগামী ২৪ ঘণ্টা বৃষ্টি চলবে, কোথাও কোথাও হবে ভারী বৃষ্টি। পূর্ণিমার পরে আর দুই দিন (জুলাই ১৯ পর্যন্ত) ব্রহ্মপুত্র, যমুনা আর পদ্মায় পানি বাড়তে থাকবে। পদ্মা তখন গোয়ালন্দে (এখন যেটা পাটুরিয়া) আর আত্রাই বাঘাবাড়ীতে বিপৎসীমা অতিক্রম করতে পারে। বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের ধারণা, কুড়িগ্রাম, জামালপুর, গাইবান্ধা, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল প্রভৃতি জেলায় বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হবে। 


বন্যার পানি নাকি ভাঙা বাঁধের খেসারত
স্বাভাবিকভাবে পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হলে বিপদগ্রস্ত মানুষের সংখ্যাও আরও বেড়ে যাবে। এটা বর্ষা মৌসুমের প্রথম ধাক্কা, তাতেই চারদিকে বন্যা বন্যা ধ্বনি উঠছে। প্রথম ধাক্কার পা ভেজা পানিতে দেশে নিচু এলাকার ঘাস ডুবে যায়। দুকূল ছাপানো পানি আসে আরও পরে, শ্রাবণ আর ভাদ্রের পূর্ণিমার আগে। সেসবের এখনো ঢের দেরি। আগস্টের তৃতীয় সপ্তাহ আর সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি প্রবল বন্যার আদর্শ সময়।

তবে এবার কেন নিচু এলাকার ঘাসডুবা পানি মানুষের ঘরে ঢুকে গেল? কোথাও কিন্তু বাঁধ উপচে বানের পানি লোকালয়ে আসেনি। প্রথম বর্ষায় সে সাধ্যি তার হয় না, এবারও হয়নি। সব জায়গায় পানি ঢুকেছে বাঁধ ভেঙে। প্রতিবছর একই ঘটনা কেন ঘটে? ফি বছর কেন বাঁধ ভেঙে যায় তার এক রকম তৈরি করা ব্যাখ্যা বাঁধের মালিকপক্ষ মানে পানি উন্নয়ন বোর্ডের আছে। দুই বছর আগে সেটা ছিল ‘ইঁদুর তত্ত্ব’ যা থিওরি অব র‌্যাটস নামে পরিচিতি পেয়েছিল।

বাঁধ ভাঙার জোড়াতালি তত্ত্ব
তত্ত্বটার বয়ান অনেকটা এ রকম, ‘বাঁধের ওপর জলবায়ু উদ্বাস্তু মানুষের বসবাস বাড়ছে, তাই খাবারের লোভে ইঁদুরও বেড়েছে। এসব ইঁদুরের গর্ত (র‍্যাট হোল) অনেক লম্বা হয়।...এসব গর্ত যেসব স্থানে বাঁধের নিচের দিকে থাকে, সেখানে পানি ঢুকে বড় ফাটল তৈরি হয় বা বাঁধ ভেঙে ফেলে।’ পাউবোর আরেকটা প্রচলিত তত্ত্ব হলো ‘থিওরি অব ওয়াটার লেভেল’। এই তত্ত্ব অনুযায়ী ‘নদীতে যখন পানি আসে, তখন দুই দিকের পানির লেভেলের তারতম্যের কারণে একদিকের পানি পানি চুইয়ে আরেক দিকে আসে। একটি নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত মাটির বাঁধগুলো বন্যা ঠেকাতে পারে। কিন্তু এর বেশি হলে সেটা ভেঙে যায়। আবার অনেক সময় বাঁধের ভেতর ছোট ছোট ফাঁকা থাকে। সেটা নানা কারণেই হতে পারে। পানি বা বাতাস চলাচল, ইঁদুরের যাতায়াত, অনেক কারণে হতে পারে।’

দুটি তত্ত্ব আলাদা মনে হলেও দুটিতেই ইঁদুরের কারিশমাকে আমলে নেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ ঘুরেফিরে ব্যবসাদেবতা কার্তিকের বাহন ইঁদুরকে সঙ্গে রাখা হয়েছে। ইঁদুর থাকুক না-থাকুক, বাঁধ নির্মাণ আর রক্ষণাবেক্ষণে যে বিপুল ব্যবসা আছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই । সংবাদমাধ্যমের কাছে সেই ব্যবসার ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন কুড়িগ্রামের হলুখোলা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান, ‘বাঁধের দায়িত্ব ওয়াপদার (পাউবোর আগের নাম)। প্রতিবছর এটা তাদের মেরামত করার কথা, কিন্তু তারা তা করে না। দুই-তিন বছর কিছু ঠিকাদারকে দায়িত্ব দেয়, কিন্তু তারা মেরামতের বদলে বাঁধ চেঁছে আরও চিকন করে ফেলে।...পানির চাপে সেগুলো নষ্ট হয়ে গেছে।’ তবে স্থানীয় জনগণের জীবন থেকে জানা এসব কথার সঙ্গে পাউবোর কর্তারা কখনো একমত হন না। তাঁরা বলেন, ‘বড় কারণ বরাদ্দের অভাব। লোকবলেরও অভাব রয়েছে। তবে প্রতিবছরই কিন্তু আমরা জেলা পর্যায়ে কম-বেশি কাজ করি।’

সংকট ঘনীভূত হচ্ছে
ধানের দাম না পাওয়ায় ছোট কৃষক ও বর্গাচাষিরা এমনিই নেতিয়ে আছেন। পরের ফসল আমন ধরবেন কীভাবে, এই চিন্তায় যখন তাঁরা জেরবার, তখন এই বন্যা আরও বড় উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে। ঈদের বাজার সামনে রেখে ক্ষুদ্র ঋণের সহযোগিতায় যাঁরা গবাদি প্রাণী প্রতিপালনের চেষ্টা করেছিলেন, তাঁরাও সংকটে পড়েছেন। গোখাদ্য ও গবাদি প্রাণীর নিরাপত্তার অভাবে পানির দরে তাঁরা তাঁদের সম্বলগুলো বেচে দিতে বাধ্য হচ্ছেন।

ইতিমধ্যেই সারা দেশে প্রায় তিন হাজারের মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। চর অঞ্চল বা নদীর কিনারে থাকা জনপদের ৫০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নদীতে বিলীন হয়ে যাওয়ার খবর শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার আগাম ইঙ্গিত দিচ্ছে।

যেকোনো পরিস্থিতিতে শিশুমৃত্যুর হার বাড়লেই বুঝতে হবে পরিস্থিতি সংকটের রূপ নেওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে। জুলাই ১৫ পর্যন্ত কুড়িগ্রাম, সিরাজগঞ্জ, জামালপুরে বন্যার পানিতে ডুবে কমপক্ষে আট শিশুর মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। নেপাল আর ভারতেও মৃত্যুর মিছিলটা এবার বড় হচ্ছে। তিন দেশ মিলিয়ে এর মধ্যেই শতাধিক লোক মারা গেছে। বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্যমতে, উত্তরের কয়েকটি জেলায় বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হলে এবং নতুন জেলা প্লাবিত হলে সংকট নিয়ন্ত্রণে রাখা কষ্টকর হবে।

এখন কী প্রয়োজন?
ত্রাণ তৎপরতার নানা কথা আর ছবি আমরা দেখতে পাব। রিলিফ বিতরণের এসব লোকদেখানো ও প্রচারসর্বস্ব কাজের লোভ সামলে আমাদের অন্য কিছু ভাবতে হবে। প্রান্তিক মানুষের এখন প্রয়োজন তাদের শেষ সম্বল রক্ষার একটা উপায় খুঁজে দেওয়া। গবাদি প্রাণী রক্ষার জন্য দরকার গোখাদ্য এবং দালাল ও ডাকাতের হাত থেকে সুরক্ষা। শাড়ি, লুঙ্গি আর দুই-তিন কেজি চালের ভিক্ষা দিয়ে সেটা অর্জিত হবে না। গবাদি প্রাণীর প্রাণঘাতী রোগের প্রতিষেধক দেওয়ার ব্যবস্থা এখনই জোরেশোরে নিতে হবে। সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী সাত দিনের বেশি কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলে বিকল্প পাঠদানের যে নিয়মের কথা বলা হয়েছে, তা অবিলম্বে চালু করতে হবে। আগামী ১০ সপ্তাহ বন্যার ঝুঁকি থাকবে, সেই সঙ্গে থাকবে ভাঙনের ঝুঁকি।

গওহার নঈম ওয়ারা: লেখক ও গবেষক
nayeem 5508 @gmail.com