বিপন্ন মধ্যবিত্ত সমাজচিত্র পাল্টে দিতে পারে

বাংলাদেশে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি আয়বৈষম্য ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলেছে। এ বক্তব্য আসছে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন অর্থনীতিবিদ ও সংস্থার কাছ থেকে। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, দরিদ্র ও হতদরিদ্র শতকরা হার ২০০৫-এর তুলনায় ২০১৯-এ যথাক্রমে ৪০ থেকে ২১ এ এবং ২৫ থেকে ১১-তে নেমে এসেছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ৮ শতাংশের ঊর্ধ্বে। মাথাপিছু আয় ১০ বছরে দ্বিগুণ হয়ে ১ হাজার ৯০৯ মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে। উচ্চতর প্রবৃদ্ধি লক্ষণীয় হচ্ছে বৈদেশিক বাণিজ্য, প্রবাসীদের প্রেরিত অর্থ, রিজার্ভসহ বেশ কিছু খাতে। ২০০৫-এর বিদ্যুৎ উৎপাদন যেখানে ছিল ৪ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট, এখন তা ২২ হাজার মেগাওয়াটের কাছাকাছি। রাজস্ব আহরণ ও বাজেটের আকৃতি প্রশংসনীয় হারে বেড়েছে। সামষ্টিক অর্থনীতির এ চিত্র প্রশংসনীয়।

অন্যদিকে বেড়ে চলেছে গড় আয়ুষ্কাল ও শিক্ষার হার। এর বিপরীতে অর্থনীতির এ প্রবৃদ্ধির বড় অংশ চলে যাচ্ছে সমাজের ভাগ্যবান শ্রেণির হাতে। আর্থিক সামর্থ্য বিবেচনায় বিভিন্ন শ্রেণির মধ্যে বৈষম্য ক্রমবর্ধমান। অন্যদিকে সরকারের করনীতি ক্রমান্বয়ে ধনিকশ্রেণির অনুকূলে ঝুঁকে পড়ছে। কোষাগারের ক্রমবর্ধমান জোগান দেওয়ার দায় বাড়ছে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত শ্রেণির ওপর। এবারের বাজেটে সে চিত্রটি আরও সুস্পষ্টভাবে সামনে এল। বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে মধ্যবিত্ত শ্রেণি ক্রমান্বয়ে চাপের মুখে রয়েছে। তাদের বিশাল অংশ এখন অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াইয়ে নিয়োজিত।

অর্থনীতিবিদ ও সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, যাঁদের বার্ষিক আয় ৩ লাখ থেকে ১৪ লাখ টাকার মধ্যে, তাঁরা এ শ্রেণিতে রয়েছেন। তবে আর্থিক সক্ষমতা ব্যতিরেকে তাঁদের বাসস্থান, শিক্ষা, সামাজিক মর্যাদা ইত্যাদিকেও বিবেচনায় নেওয়া হয়। হিসাবটা কিছুটা জটিল হলেও তাঁদের চিহ্নিত করতে খুব বেগ পেতে হয় না। জানা যায়, এ শ্রেণির আওতায় থাকা লোকের সংখ্যা এখন ৪ কোটির কিছু ওপরে। অর্থাৎ, দারিদ্র্যের বিত্ত থেকে বেরিয়ে এলেও বিপুলসংখ্যক মানুষ এখনো মধ্যবিত্তের কাতারে আসেনি, বরং মধ্যবিত্ত শ্রেণির কিছু লোক মানদণ্ডের নিচে নেমে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

মধ্যবিত্তরা সমাজ বিনির্মাণে বিশেষ ভূমিকা রাখে। প্রয়োজনে তারাই সমাজ পরিবর্তনের নেতৃত্ব দেয়। চিন্তাচেতনার অগ্রসরতার নেতৃত্বও মধ্যবিত্তরাই দিয়ে থাকে। শিক্ষা, সংস্কৃতি, ক্রীড়া এসব ক্ষেত্রেই নেতৃত্ব আসে তাদের মধ্যবিত্ত থেকে। এ শ্রেণি থেকেই আসে বিচারক, শিক্ষক, পেশাজীবী, কূটনীতিকসহ বিজ্ঞানী ও ব্যবস্থাপকেরা। আমাদের স্বাধীনতাসংগ্রামে শীর্ষ পর্যায়ে থেকে প্রায় সব স্তরের নেতৃত্বই ছিল এ শ্রেণির হাতে। রাষ্ট্রের কোষাগারের বড় অংশই আসে তাদের হাত থেকে। উত্তরোত্তর বিকাশ ঘটলে শ্রেণিটি রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ও সামাজিক ভিতকে শক্তিশালী করবে।

কিন্তু ইদানীং করকাঠামোর জালে তাদের বিকাশের পথ রুদ্ধ হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বরং কমে যেতে পারে এ শ্রেণির আওতায় থাকা লোকের সংখ্যা। তারা সরাসরি আয়করসহ বিভিন্ন শ্রেণির কর দেয়। তেমনি বিভিন্ন ভোগ্যপণ্য ও সেবা খাতে মূল্য সংযোজন করের ভারও তাদের ওপরই চূড়ান্তভাবে বর্তায়। বরাবরই এমনটা ছিল। তবে ইদানীং বিষয়টি অনেকটা একমুখী হয়ে পড়েছে, এমনটাই লক্ষণীয়। চলতি অর্থবছরে ভ্যাটের প্রভাবে অনেক ধরনের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বড় রকমে বাড়বে। তেমনি ব্যয় বেড়েছে মোবাইল ফোন ব্যবহারে। অন্যদিকে সঞ্চয়পত্রের মুনাফার ওপর আয়কর ৫ থেকে ১০ শতাংশে উন্নীত করায় মধ্যবিত্ত শ্রেণির বড় একটি অংশের আয় কমে যাবে। আগামী দিনগুলো কীভাবে চলবে, সে হিসাব তারা মেলাতে পারছে না। রড, সিমেন্টের মূল্যবৃদ্ধির জন্য ফ্ল্যাটের দাম মধ্যবিত্তের অনেকটা আওতার বাইরে থাকবে।

রাষ্ট্র পরিচালনা করতে টাকা দরকার। টাকা দরকার উন্নয়নের চাকাকে সচল রাখতে। আর তা আদায়ের রাস্তাও সহজ নয়, এটা অনস্বীকার্য। যাদের ওপরই কর আসবে, তারাই গেল গেল রব তোলে। এর মধ্যে সরকারকে সুবিবেচনাপ্রসূত হয়ে সমাজের সব শ্রেণি-পেশার স্বার্থকে সামনে রেখে করের জাল সরাতে হবে। একটি ধারণার মধ্যে আমরা বাস করছি যে সমাজের ধনিকশ্রেণি উদ্যোক্তা, তাদের উদ্যোগেই শিল্প ও ব্যবসা পরিচালিত হয়। সৃষ্টি হয় কর্মসংস্থান। ফলে সহায়ক হয় দারিদ্র্য দূরীকরণ ও মধ্যবিত্তের ভিতকে প্রসারিত করতে। এ কৃতিত্ব অনেকটাই ধনিকশ্রেণির, এতে কোনো সন্দেহ নেই।

তবে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী পুঁজিবাদী দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ২০১১ সালের ৭ ডিসেম্বর কানসাসে শিক্ষার্থীদের এক সমাবেশে সুস্পষ্টভাবে বলেছেন, মধ্যবিত্তরাই অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি আনে, ধনীরা নয়। তিনি উল্লেখ করেন, ভোক্তাশ্রেণির প্রধান ভিত্তিই হলো মধ্যবিত্ত। তাদের জোরালো প্রসার না ঘটলে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি হবে না। এর সমর্থনে তিনি বলেন, প্রয়াত শিল্পপতি হেনরি ফোর্ড তাঁর প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের মজুরি ক্রমান্বয়ে এমনভাবে বাড়ান, যাতে তাঁরা একটি গাড়ি কিনতে পারেন। ব্যবস্থাটি সুফল দিয়েছিল।

বারাক ওবামার মতে, আর্থিক বৈষম্য গণতন্ত্রকে বিকৃত করে। দক্ষ ও সৎ সরকারি সেবার মান ক্রমান্বয়ে হ্রাস পায়। মধ্যবিত্ত দুর্বল হয়ে পড়লে ধনিকশ্রেণি সরকারের ওপর অধিক প্রভাব বিস্তার করে অসম সুবিধা আদায় করে নেয়। এ প্রসঙ্গে আমাদের দেশে নিকট অতীতে এক অঙ্কে ব্যাংকঋণ এবং নামমাত্র টাকা নিয়ে ঋণখেলাপিমুক্ত করার বিষয়টি স্মরণ করা যেতে পারে। একটি শক্তিশালী মধ্যবিত্ত শ্রেণি ধনিক ও শ্রমিকশ্রেণির মধ্যে সমাজের ভারসাম্যের জন্যও আবশ্যক।

আমাদের শাসনব্যবস্থায় গুণগত পরিবর্তন আনতে পারলে সরকারের দেওয়া সুযোগগুলো থেকে জনগণ অধিক সুফল পাবে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে আরও বিনিয়োগ দরকার। তবে যেটুকু হচ্ছে, তা-ও সঠিকভাবে জনগণ ভোগ করতে পারছে না সুশাসনের ঘাটতির জন্য। ঘাটতিটা দূর করতে হবে।

আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব
[email protected]