নিউজিল্যান্ডের জায়গায় আমরা হলে কী করতাম

বিশ্বকাপ ক্রিকেটের ফাইনালে ইংল্যান্ড আর নিউজিল্যান্ডের রান ৫০ ওভারে ছিল সমান সমান। সুপার ওভারেও ছিল সমান সমান। টুর্নামেন্টে বেশি বাউন্ডারি মেরেছিল বলে ইংল্যান্ড পেয়ে গেল বিশ্বকাপ। কিন্তু তারও আগে আম্পায়াররা একটা বড় ভুল করেছেন, যেমনটা বলেছেন আইসিসির রুল কমিটির সদস্য অস্ট্রেলিয়ার সাবেক আম্পায়ার সাইমন টফেল। বেন স্টোকসের ব্যাটে লেগে বলটা যখন সীমানা পেরোল, তখন ইংল্যান্ডের পাওনা হয়েছিল ৫ রান। আর স্টোকস তখন নন-স্ট্রাইকিং প্রান্তে থাকবেন, এটাই ছিল নিয়ম। কিন্তু আম্পায়াররা ভুল করে ৬ রান দিয়ে দেন ইংল্যান্ডকে।

কিন্তু এটা নিয়ে নিউজিল্যান্ডে মোটেও কোনো ক্ষোভ-বিক্ষোভ, কুশপুত্তলিকা দাহ ঘটছে না। নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী, যিনি এর আগে মসজিদে সন্ত্রাসী হামলার পর তাঁর অসাম্প্রদায়িক বর্ণবাদবিরোধী ও মানবতাবাদী কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে বিশ্ববাসীর ভালোবাসা কেড়ে নিয়েছিলেন, সেই জেসিন্ডা আরডার্ন বলেছেন, কোনো সন্দেহ নেই এটা ছিল এক অবিশ্বাস্য ম্যাচ। একটা ওভার আমাদের সবার বয়স এক বছর করে বাড়িয়ে দিয়েছে। অভিনন্দন ইংল্যান্ড। আর নিউজিল্যান্ড টিমের জন্য আমরা গর্ব ছাড়া আর কিছুই অনুভব করছি না। আহ্, কী একটা দুর্দান্ত টিম!

নিউজিল্যান্ড টিমও সুপার ওভার নিয়ে, খেলার নিয়ম নিয়ে কোনো অভিযোগ করছে না। ওদের অধিনায়ক কেন উইলিয়ামসনের সুখেলোয়াড়সুলভ আচরণ, প্রকৃতপক্ষে পুরো নিউজিল্যান্ড দলেরই খেলোয়াড়ি মনোভাবের প্রশংসায় ক্রিকেট বিশ্ব সর্বদা পঞ্চমুখ!

এ থেকে কি আমাদের কিছু শেখার আছে?

এই উপমহাদেশের কোনো দেশ, বাংলাদেশ, ভারত কিংবা পাকিস্তান যদি থাকত নিউজিল্যান্ডের জায়গায়, কী প্রলয়কাণ্ডই না ঘটে যেত!

আমরা ফেসবুকে যা যা লিখতাম:
১. ছি ছি আইছিছি!
২. ইংল্যান্ডকে চ্যাম্পিয়ন করিয়ে দেওয়ার জন্য আম্পায়ারদের কী নির্লজ্জ পক্ষপাতিত্ব!
৩. ফাইনাল খেলা পরিত্যক্ত ঘোষণা করুন। নিউজিল্যান্ডকে (মানে আমার দেশ) চ্যাম্পিয়ন ঘোষণা করুন।

এগুলো সব ভদ্রতম স্ট্যাটাসের উদাহরণ।

আর যা যা করতাম:
বেন স্টোকসের দাদাবাড়ি গিয়ে সেটা পুড়িয়ে দিয়ে আসতাম!
আম্পায়াররা যে দেশের, সে দেশের দূতাবাস ঘেরাও কর্মসূচি দিতাম!
তারও আগে, ওই সুপার ওভারের সময় হার্ট অ্যাটাকে মারা যেতাম অন্তত ১৫৬ জন, হাসপাতালে যেতাম ৭ হাজার ৪৪ জন।
আমাদের পত্রপত্রিকায় লাল রঙে শিরোনাম হতো, ফাইনালের নামে কলঙ্ক!

কিন্তু নিউজিল্যান্ড এসব কিছুই করেনি।

ইভিনিং স্ট্যান্ডার্ড-এর শিরোনাম: নিউজিল্যান্ড স্টারস রিফিউজ টু ব্লেম ক্রিকেট ওয়ার্ল্ড কাপ ফাইনাল ডিফিট অন কন্ট্রোভার্সিয়াল রুলস (নিউজিল্যান্ডের খেলোয়াড়েরা ওয়ার্ল্ড কাপ ফাইনালে হারের জন্য বিতর্কিত বিধানকে দায়ী করছে না)

ইংল্যান্ডের অধিনায়ক মরগান তাঁর দেশের তরুণ ক্রিকেটারদের বলেছেন, ‘দয়া করে তোমরা নিউজিল্যান্ডের ক্রিকেটারদের আদর্শ হিসেবে অনুসরণ কোরো।’

আর নিউজিল্যান্ডের হিরো নিশাম টুইট করে মজা করেছেন ফাইনালে অমন হার না মানা হারের পর, ‘কিডস, ডোন্ট টেক আপ স্পোর্টস। টেক আপ বেকিং অর সামথিং। ডাই অ্যাট সিক্সটি রিয়েলি ফ্যাট অ্যান্ড হ্যাপি। (বাচ্চারা, খেলাধুলাকে বেছে নিয়ো না। রান্না করো বা আর কিছু করো। মোটা হয়ে ৬০ বছর বয়সে মারা যাও বা সুখে বেঁচে থাকো।’ তাঁর এই টুইটকে দেখা হচ্ছে একটা দারুণ রসিকতা হিসেবে, মজা হিসেবে।

ওই খেলা থেকে আমরা কি আরও একটা জিনিস শিখতে পারি? দুটো দল, আসলে সেমিফাইনালে খেলা চারটা দলই শারীরিকভাবে দারুণ সমর্থ, স্বাস্থ্যবান, টগবগ করে ফোটা। অ্যাথলেট। নিউজিল্যান্ডের একেকজন খেলোয়াড় কত দূর থেকে দৌড়ে এসে ঝাঁপ দিয়ে পিছলে এগিয়ে গিয়ে বাউন্ডারি ঠেকাচ্ছিলেন, খেয়াল করেছি কি?

আমরা যদি ক্রিকেটে ভালো করতে চাই, আগে আমাদের অ্যাথলেটে ভালো হতে হবে। শারীরিকভাবে সমর্থ হতে হবে। দৌড়াতে পারতে হবে, ঝাঁপাতে পারতে হবে। সাকিব আল হাসান ভালো করেছেন, কারণ তিনি ওজন কমিয়ে নিজেকে শারীরিকভাবে ফিট করেছেন, মানসিকভাবে শক্ত করেছেন এবং পাখির চোখের মতো লক্ষ্য স্থির রেখে খেলেছেন।

ভুঁড়ি নিয়ে আজকের দিনের ক্রিকেটে একটা-দুটো ম্যাচে জেতা যাবে, শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বীর বিরুদ্ধে নয়।

আনিসুল হক: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক