'এক অ্যাঁজলা পানি দেও বাহে'

কদিন আগে ধানের দামে ভুগেছি, এখন পানিতে মরছি। ঘরে ঘরে পানি, ঘরে ঘরে পানির জন্য হাহাকার। পানিতে ডুবে গেছে প্রায় পুরো কুড়িগ্রাম। প্রায় ৮০ ভাগ নলকূপ পানির তলায়। চরের উঁচু ভিটাতে যাদের বাড়ি, ’৮৮–এর বানের পর যে উঁচা উঁচা সড়কগুলো ছিল, সেগুলোর জন্য বছর বছর বাজেট এলেও মাটি পড়েনি এক খাঁচাও। উল্টা ক্ষয়ে গেছে বছর বছর। ফলে আবহাওয়া পূর্বাভাস কেন্দ্রের ভাষ্যকে ভুয়া প্রমাণ করে যখন ব্রহ্মপুত্র ছাড়াও জিঞ্জিরাম, হলহলিয়া, ধরলা, দুধকুমার, তিস্তা তাদের সারা বছরের পানি একেবারে উগরে দিয়েছে, তখন কূলহারা হয়ে গেছে মানুষ। সব নদ–নদী যেন ঘেরাও করে ফেলেছে জনপদের পর জনপদকে।

ব্রহ্মপুত্রপাড়ের কৃষক রহিম মুন্সীর ভাষায়, ‘ব্রহ্মপুত্রের পেট এত বড় হৈলে কী হৈবে, বালু ভরা পেটে কি পানি ধরে?’ ডিমলার তরুণ কৃষক সেলিম রানা ফেসবুকে লিখেছেন, ‘তিস্তায় সারা বছর পানি নাই, বান আইলেই তিস্তা ভাসায় আর ভাঙ্গে।’ সব নদ–নদী একতালে বান ডাকছে বাহে। পত্রিকাগুলোতে খবর হয়েছে, গত ৩০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বড় বন্যা ব্রহ্মপুত্র-যমুনায়। প্রশ্ন, গত ৩০ বছরে কতবার তলদেশ গভীর করা হয়েছে?

অষ্টমীর চরের ফ্লেক্সি লোড ব্যবসায়ী মনজুর মিয়া (৪৫), চর শাখাহাতীর মিলন (৩৫), মেহেদী (৪০), খোর্দ বাঁশপাতা চরের কৃষক বাদশা মিয়া (৪৫), এবাদুল মোল্লা (৪০), চর খাঁরু ভাঁজের দলিল লেখক দেলোয়ারের (৩৮) সঙ্গে কথা হয়। তাঁরা জানান, চরের চেয়ারম্যান ও শিক্ষিত লোকেরা সবাই কাইম (উঁচু) এলাকায় থাকে। এদিকে চরের বাজেট ভূতে খায়। বান আসে বান যায়, যেমন চর তেমনই থাকে।

২.
কুড়িগ্রামের রাস্তায় রাস্তায় বানভাসি মানুষের ঘর। সম্বল যে রাস্তা, তা–ও এখন ডুবেছে। রৌমারী-রাজীবপুর-চিলমারী পুরোই গেছে পানিতে। এরা সবাই ওয়াপদা বাঁধের নদীর দিকের লোক। নদীতে পানি এলেই এই অংশের ঘরে ঘরে পানি ওঠে। চরের বাড়িগুলোতে পানি ওঠার আগেই এখানে পানি ওঠে। এখন তাদের বাড়ির ধরনা (ছাদ) পর্যন্ত পানি। যারা স্কুল ঘর ও রাস্তায় ঠাঁই পায়নি, তারা চালের ওপর চৌকি বেঁধে আছে। নাগরিক জীবনের অংশ হওয়ায় পানির সঙ্গে সহাবস্থানও তারা ভুলে গেছে। ঢাকা শহরে যারা রিকশা চালান, এরা তারাই। বউ আত্মীয়স্বজনদের সহযোগিতায় সংসার সামলান। এই অংশেই জেলেপাড়া, কুমোরপাড়া ও সব ভূমিহীনের ঠিকানা। সম্ভবত এখানেই ঈশ্বর থাকেন না। চরের তুলনায় এদের ঘরের ভাত নেই, চরের মোটামুটি সবার জমি আছে, কিন্তু এরা ভূমিহীন। চরের বাড়িতে বাড়িতে কুড়িয়ে পাওয়া শাক ও সবজি আছে, কিন্তু এদের তা–ও নেই। ভদ্রলোকেরা শহরের এত কাছে রিলিফ দেন না, তাঁরা দুর্গম চরে গিয়ে রিলিফ দিতে চান, চান নাগরিক মনের শান্তি।

চিলমারী, রৌমারী, রাজীবপুর উপজেলায় ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় অপেক্ষা করছে। ২–১ কিমি যেটুকু বাঁধের রাস্তা জেগে আছে, তাতে তিল ধারণের জায়গা নাই। রিকশা, ভ্যান, দোকানপাট, ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হয়ে গেছে। মোমবাতি-চিড়া-গুড় কেনার মতো দোকানও বন্ধ হয়েছে। রাস্তাঘাটও ভেঙে তলিয়ে গেছে, বন্ধ রেল চলাচল। ত্রাণ কার্যক্রম চালানোও কঠিন। ফলে যারা দিন আনে দিন খায়, তারা মহাসংকটে। ৭৭ ভাগ গরিব মানুষের অনাহারে মৃত্যুর ঝুঁকিতে। জলোচ্ছ্বাসে আশ্রয়কেন্দ্রে ঠাঁই নিলেই বিপদ কেটে যায়, কিন্তু ১৫ দিন ঘরের চাল পর্যন্ত পানি থাকলে কেয়ামত নামবে।
দুইজন পুলিশ সুপার ও রৌমারীর ইউএনও দীপঙ্কর বড়ুয়া আন্তরিক। তবু চতুর্দিক থেকে পরিস্থিতি খারাপ হয়ে গেছে। সবজির দাম আকাশ ছুঁয়ে ফেলছে। বন্যার সময় কুড়িগ্রামের মানুষ সবজির বদলে মাছ খায়, এখনো মাছ সেভাবে পাওয়া যাচ্ছে না। থাকবে কীভাবে নদীতে মাছের খাবার নেই। মাছ পেলেও রান্না করে খাবে কী করে? মানুষের হাতে কাজ নেই। ব্যবসায়ীর দোকান বন্ধ, শ্রমিকদের কাজ বন্ধ। কয়েক দিনের মধ্যে রোগবালাই ছড়ানো শুরু হবে। সামনে অন্ধকার।

তবু সম্পদ ও সম্ভাবনা নিয়ে দারিদ্র্যের শীর্ষে কুড়িগ্রাম জেলা। রাষ্ট্রীয় বরাদ্দ কত, তা–ও সবার জানা। গত ৩০ বছরের সর্বোচ্চ বন্যা চলছে কুড়িগ্রামে। ভাতের অভাব, খাওয়ার পানিরও অভাব। বাণ্ডালের চরের মোমেনা বেটি গতকাল বলেছেন, ‘সারা বছর হামাক কী দিছেন জানি। এলা অ্যাঁজলা ভরা পানি দেও বাবা, তিয়াসটা মেটাই!’

লেখক: সভাপতি, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ,, রেল-নৌ, যোগাযোগ ও পরিবেশ উন্নয়ন গণকমিটি।
[email protected]