সন্তানহারা মায়ের আর্তনাদ

নুসরাতের মা শিরিন আক্তার। প্রথম আলো ফাইল ছবি
নুসরাতের মা শিরিন আক্তার। প্রথম আলো ফাইল ছবি

৪ জুলাই ফেনীর সোনাগাজী গিয়েছিলাম। নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার কিশোরী নুসরাতের শৈশব–কৈশোর সম্পর্কে জানার উদ্দেশ্যে খাদিজাতুল কুবরা আলিম মাদ্রাসা (যেখান থেকে নুসরাত দাখিল পরীক্ষা দিয়েছেন), সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসা (যেখানে নুসরাত ভর্তি হয়েছিলেন আলিম পরীক্ষা দেওয়ার উদ্দেশ্যে) এবং সর্বশেষ তাঁর বাড়িতে যাওয়ার সুযোগ হয়েছে। নুসরাতের পরিবার এবং শিক্ষকদের কাছ থেকে যা জানতে পারলাম তা হচ্ছে নুসরাত ছিলেন একজন অদম্য সাহসী, উচ্ছল এবং প্রাণবন্ত মেয়ে। এ সমাজের গড়পড়তা মেয়েদের থেকে ভিন্ন স্বভাবের। তিনি অন্যায় ও নিপীড়নের সামনে চুপ থাকেননি বরং প্রতিবাদ করেছেন। তিনি আমাদের দেখিয়ে গেছেন কীভাবে প্রতিবাদ করতে হয়।

আজকের লেখার প্রতিপাদ্য নুসরাতের মা। তাঁর সঙ্গে যখন দেখা করতে গেলাম, তখন তিনি নুসরাতের স্মৃতিবিজড়িত ঘরটিতে শুয়ে কাঁদছিলেন। প্রায় তিন মাস আগে মেয়েটির মৃত্যু হয়েছে। মা আজও চোখের পানি ফেলছেন। আমরা সবাই বিচার, সামাজিক অবস্থা, যৌন হয়রানি, হত্যা—এসব নিয়ে বিশ্লেষণ করছি। কিন্তু একজন মা কীভাবে তাঁর প্রাণপ্রিয় মেয়ের পোড়া লাশের গন্ধ ভুলে যাবেন? কীভাবে ভুলবেন সেই আর্তনাদ?

কিন্তু নুসরাতের মায়ের কাছে গিয়ে বসতেই তিনি বললেন, ‘মা রে, আমার মেয়েটার হাতে একটা আংটি ছিল, পোড়া হাত থেকে আংটি খোলার চেষ্টা করতেই আঙুলটাই খসে এল।’ বলে চিৎকার করে কাঁদলেন তিনি।

বেলা তখন তিনটা। জানতে চাইলাম, দুপুরে তিনি খেয়েছেন কি না। উত্তরে বললেন, ‘মা রে, মেয়েটার কথা ভেবে তিনটা মাস ধরে ভাত খেতে পারি না।’ হাসপাতালে নুসরাতের শক্ত খাবার বারণ ছিল। একবার নাকি তিনি মাকে বলেছিলেন, ‘মা, ভাত খেতে ইচ্ছা করছে। লুকিয়ে একটু ভাত দাও।’ তার এক দিন পরই নুসরাত মারা যান। সেদিন থেকে তাঁর মা আর ভাত খেতে পারেন না।

নুসরাতের মায়ের আর্তনাদে পরিবেশ ভারী হয়ে উঠেছিল। তিনি বলছিলেন, কীভাবে সৃষ্টিকর্তার কাছে একটি কন্যাসন্তানের জন্য প্রার্থনা করেছেন। সেই প্রাণপ্রিয় সন্তান, যাঁকে তিনি জন্ম দিয়েছেন, কোলেপিঠে করে মানুষ করেছেন, সেই নুসরাতের সঙ্গে ঘটে যাওয়া নৃশংসতা তাঁকে ধুঁকে ধুঁকে মারছে দুঃস্বপ্নের মতো। তাঁর মেয়ে ভাত খেতে চেয়েছিলেন কিন্তু তিনি দিতে পারেননি, এ দুঃখবোধ তাঁকে তাড়া করে ফিরছে প্রতিনিয়ত। যে হাত ধরে তিনি নুসরাতকে হাঁটতে শিখিয়েছেন, সে পোড়া হাতের দৃশ্য তাঁকে দংশন করছে ক্রমাগত। এক মুহূর্তের জন্য তিনি ভুলে যেতে পারেননি সে দিনগুলোর স্মৃতি। কারণ তিনি মা, তাঁর অভিব্যক্তি অনেক গভীর, স্নেহের জালে ঘেরা তাঁর সন্তানেরা। আজ পর্যন্ত নুসরাতের কবরে ফুল দিয়েছেন অনেকেই, কিন্তু কবরের সামনে দাঁড়িয়ে বারবার মূর্ছা গেছেন শুধু তাঁর মা। কারণ, তিনি মা, তাঁর মমতা অতুলনীয়।

নুসরাতের মায়ের আর্তনাদে যখন শোকগ্রস্ত, ঠিক ওই দিনই পত্রিকায় চোখ পড়ল বরগুনায় ঘটে যাওয়া রিফাত হত্যাকাণ্ডের মূল আসামি নয়ন বন্ডের মায়ের অভিব্যক্তি। উল্লেখ্য, ‘নয়ন বন্ড’ ২ জুলাই পুলিশের সঙ্গে ‘ক্রসফায়ারে’ নিহত হন। গত ২৬ জুন সকাল সাড়ে ১০টার দিকে বরগুনা সরকারি কলেজের মূল ফটকের সামনের রাস্তায় প্রকাশ্যে তিনি ও তাঁর সহযোগীরা কুপিয়ে গুরুতর জখম করেন রিফাত শরীফকে।

অনেকেই এই হত্যার অনেক কারণ বিশ্লেষণ করেছেন; আমি আর সেদিকে যাচ্ছি না। আমার এই লেখার উদ্দেশ্য নয়ন নন, তাঁর মা, যে মায়ের সন্তান ক্রসফায়ারে নিহত। তাঁর অভিব্যক্তিও নিশ্চয়ই করুণ ও গভীর। গোটা সমাজের কাছে যে নয়ন কুখ্যাত সন্ত্রাসী, তাঁর মায়ের কাছে তাঁর স্মৃতি নিশ্চয়ই ছোটবেলার সেই নয়নকে নিয়ে, যাঁকে তিনি হাঁটি হাঁটি পা পা করে চলতে শিখিয়েছেন। যে হাত ধরে মা চলতে শিখিয়েছেন, সেই হাত দিয়েই প্রকাশ্যে একজন মানুষকে কুপিয়ে হত্যা করেছেন নয়ন।

নুসরাতের মায়ের মতো নয়নের মায়ের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ আমার হয়নি। তবে আমি নিশ্চিত বলতে পারি, অনুশোচনার তির এই মায়ের বুকে বিদ্ধ হয়েছে। তিনি হয়তো তাঁর কষ্টের কথাটি কাউকে বলতে পারেননি। কারণ, তাঁর ছেলে যে বীর নন, বরং ভয়ংকর অপরাধী। একাধিক পত্রিকার রিপোর্টে পড়লাম, নয়ন বন্ডের মা বলেছেন, কোথায় নয়নের সেসব বন্ধু, যাঁরা তাঁরই বাসায় এসে জুয়া খেলা, ইয়াবা সেবনসহ বিভিন্ন অনৈতিক কাজ করতেন। আজ বন্ধুরা তাঁকে বাঁচাননি। মা যে ছেলেকে এত যত্নে বড় করেছেন, তিনি তাঁরই বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে গিয়েছিলেন থানায়। এ কথা জানতে পেরে নয়ন মাকে মারধর করে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। যেদিন প্রাণপ্রিয় ছেলের মৃত্যুসংবাদ শুনেছেন, সেদিন আর্তনাদ করেছেন, আর দুষেছেন সমাজকে, যে সমাজ তাঁর ছেলেকে কেড়ে নিয়েছে। হোক তিনি সমাজের কাছে ঘৃণ্য, মায়ের কাছে তিনি আদরের নয়ন। এই মায়ের আর্তনাদ আমরা শুনতে পাইনি।

নুসরাতের মা, যিনি মেয়ে হারিয়েছেন বটে, তিনি একজন বীরসন্তানের মা। আর অন্যদিকে নয়নের মা, যিনি ছেলে হারিয়েছেন, তিনি দেখেছেন রাস্তাঘাটে তাঁর ছেলের ফাঁসির দাবিতে ছাপানো পোস্টার, ক্রসফায়ারে নিহত হওয়া ছবি। এ সমাজ তাঁকে চিনবে একজন কুখ্যাত খুনির মা হিসেবে। কিন্তু নুসরাতের মা ও নয়নের মা উভয়েরই অন্তরের ক্ষতটা একই রকমের; সন্তান হারানোর হাহাকারে শিউরে ওঠা মায়ের বুক। দুজনই সমাজকে দোষারোপ করছেন, কিন্তু দুভাবে। এক মায়ের সন্তান হয়েছে শিকার, আরেক মায়ের সন্তান হয়েছে শিকারি। যে সমাজের কথা তাঁরা বলেছেন, এ সমাজ আসলে কে বা কারা? আমি, আপনি, আমরাই তো সমাজ। প্রতিটি শিশুই নিষ্পাপ হয়ে জন্ম নেয়। সঙ্গ, পারিপার্শ্বিকতা, দৃষ্টিভঙ্গি এসব একজনকে করে খুনি, আরেকজনকে করে বীর।

আমরা আর কোনো মায়ের বুকফাটা আর্তনাদ শুনতে চাই না। পরিবার থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান—প্রতিটি পর্যায়ে আমরা যেন চেষ্টা করি আর একটি নয়ন বন্ডও যাতে তৈরি না হয়, আর একজন নুসরাতকেও যেন অকালে হারিয়ে যেতে না হয়। আমরা এই উদ্যম কৈশোরকে পত্রিকার পাতায় চাই স্বেচ্ছাসেবার খবর নিয়ে, সমাজকে উন্নত করার প্রচেষ্টায়।

আফরিন ইসলাম: বার অ্যাট ল ও বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী