ইয়েমেনে যুক্তরাজ্যের গোপন যুদ্ধ

আবদ রাব্বু মনসুর হাদির সরকার ও হুতি প্রতিরোধ আন্দোলনের মধ্যে বিভক্ত ইয়েমেন একটি দেশ, যা এখন নিজের অস্তিত্বের জন্য লড়াই করছে। ২০১৪ সালে শিয়ামতাবলম্বী হুতি বিদ্রোহীরা ইয়েমেনের সে সময়ের নতুন প্রেসিডেন্ট মনসুর হাদির দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে রাজধানী সানা, উত্তরাঞ্চলের প্রদেশ সাদা এবং আশপাশের কয়েকটি এলাকার দখল নেয়। এরপর তারা প্রথমে প্রধানমন্ত্রী এবং পরে প্রেসিডেন্টকে পদত্যাগে বাধ্য করে। ২০১৫ সালে সৌদির নেতৃত্বাধীন জোট মনসুর হাদির পক্ষে হুতি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে।

এ যুদ্ধের মধ্যে পড়ে ইয়েমেনের বেসামরিক নাগরিকদের ব্যাপক মূল্য দিতে হচ্ছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতে, সৌদির নেতৃত্বাধীন জোট হাসপাতাল, বিয়েবাড়ি এবং এমনকি শরণার্থী শিবিরগুলোতে বোমা হামলা চালিয়েছে। গত বছরের আগস্ট মাসে একটি স্কুলবাসে বোমা হামলায় ৬ থেকে ১১ বছর বয়সী ৪০টি শিশু নিহত হয়। আহত হয় ৫৬টি শিশু। যুক্তরাজ্যের দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকার খবর অনুযায়ী, স্কুলবাসে যে বোমা দিয়ে হামলা চালানো হয়েছিল, তা ছিল ২২৭ কেজি ওজনের লেজারনিয়ন্ত্রিত বোমা। বোমাটি মার্কিন শীর্ষ অস্ত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠান লকহিড মার্টিনের তৈরি। অস্ত্র রপ্তানির অংশ হিসেবে সৌদি আরবের কাছে বিক্রি করা হাজার হাজার বোমার মধ্যে এটি একটি। সৌদি নেতৃত্বাধীন জোটের যুদ্ধবিমানগুলো এমনকি ইয়েমেনের হোদাইদাহ বন্দর, দেশের প্রধান পাইপলাইনে হামলা চালায়। এই পাইপলাইনের মাধ্যমে ইয়েমেনের ৭০ শতাংশ মানুষের কাছে খাদ্য, জ্বালানি ও অন্যান্য সাহায্য পাঠানো হয়। জাতিসংঘ জানিয়েছে, সৌদি আরবের আকাশ, সাগর ও ভূমি অবরোধের কারণে এক কোটির বেশি মানুষ এখন ‘দুর্ভিক্ষ থেকে শুধু এক ধাপ দূরে’। পরিস্থিতি অত্যন্ত ভয়াবহ সেখানে।

সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন নিষ্ঠুর এই জোট ব্যাপক সামরিক সমর্থন পেয়েছে এবং এর পেছনে যারা ইন্ধন দিচ্ছে, তাদের মধ্যে যুক্তরাজ্যও রয়েছে।

২০১৫ সালের পর থেকে ইয়েমেন অগ্নিগর্ভ হওয়ার পেছনে জ্বালানি হিসেবে কাজ করেছে যুক্তরাজ্য। সৌদি সামরিক অভিযানের জন্য তারা প্রায় ৫৭০ কোটি ডলার মূল্যের অস্ত্র বিক্রি করেছে। ২০১৯ সালে দ্য গার্ডিয়ান–এ প্রকাশিত আরন মিরাটের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, যুক্তরাজ্য কেবল অস্ত্রই সরবরাহ করেনি, তারা সৌদি আরবের জন্য গুরুত্বপূর্ণ তথ্য, বিশেষজ্ঞ এবং কর্মী সরবরাহ করেছে। মিরাট লিখেছেন, ‘ইয়েমেন প্রতিদিন ব্রিটিশ বোমার আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়েছে’, ‘প্রশিক্ষিত ব্রিটিশ পাইলটদের দ্বারা চালিত ব্রিটিশ বিমান থেকে বোমা বর্ষণ করা হয়েছে এবং হাজার হাজার ব্রিটিশ ঠিকাদার সৌদি আরবে অবস্থান করেছেন তাদের সাহায্য করার জন্য।’ মিরাটের মতে, সৌদি আরবের ঘাঁটিগুলোতে ৬ হাজার ৩০০ ব্রিটিশ ঠিকাদার রয়েছেন, যেখানে তাঁরা সৌদি পাইলটদের প্রশিক্ষণ এবং ইয়েমেনে অভিযান চালানো বিমানগুলো রক্ষণাবেক্ষণের কাজে নিয়োজিত।

যুদ্ধ ও অস্ত্র বাণিজ্যবিরোধী আন্দোলন ক্যাম্পেইন অ্যাগেইনস্ট আর্মস ট্রেডের (সিএএটি) মতে, ইয়েমেন যুদ্ধে ১১ হাজার ৭০০ মানুষ নিহত হয়েছে। এর মধ্যে দুই–তৃতীয়াংশের মৃত্যু হয়েছে সৌদির নেতৃত্বাধীন জোটের অভিযানে এবং তাদের সহায়তা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স। নতুন কয়েকটি হিসাবে দেখা গেছে, ২০১৫ সালের পর থেকে ইয়েমেনে নিহতের সংখ্যা প্রায় ১ লাখ।

নিহতের এই নতুন সংখ্যা প্রকাশিত হওয়ার পর গত জুন মাসে ক্যাম্পেইন অ্যাগেইনস্ট আর্মস ট্রেডের করা এক আপিলের রায়ে যুক্তরাজ্যের একটি আদালত সৌদি আরবের কাছে দেশটির অস্ত্র বিক্রিকে অবৈধ ঘোষণা করেছেন। আদালত বলেছেন, ইয়েমেনে চালানো বিমান হামলায় ব্রিটিশ অস্ত্র ব্যবহারের বিষয়টি যুক্তরাজ্যের মন্ত্রীরা অবহেলা করেছেন। আদালতের জারি করা ডিক্রিতে বলা হয়, ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী জেরেমি হান্ট, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী বরিস জনসন এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমন্ত্রী লিয়াম ফক্স বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে ব্যবহার সত্ত্বেও সৌদি আরবের কাছে অস্ত্র রপ্তানিতে অবৈধভাবে স্বাক্ষর করেছিলেন।

আদালতের রায়ে সৌদি আরবের কাছে অস্ত্র বিক্রি আপাতত বন্ধ হলেও এর মানে এই নয় যে ইয়েমেনের যুদ্ধে যুক্তরাজ্যের ভূমিকা শেষ হয়ে গেছে। সৌদিদের নিষ্ঠুরতা সম্পর্কে সবকিছু জানা থাকলেও যুক্তরাজ্যের মন্ত্রীরা আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আবেদন করেছেন এবং সৌদি আরবের অভিযানে নিজেদের সম্পৃক্ত রেখেছেন। থেরেসা মের একজন মুখপাত্র বিবিসিকে বলেছেন, সরকার আদালতের এ রায়ে হতাশ হয়েছে।

নরওয়ে, ফিনল্যান্ড, বেলজিয়াম, ডেনমার্ক, জার্মানি, অস্ট্রিয়া, ইতালি ও নেদারল্যান্ডসের পর, যুক্তরাজ্যকে অবশ্যই সৌদি আরবের কাছে অস্ত্র বিক্রি বন্ধ করার ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে হবে।

ইয়েমেনের জনসংখ্যার ৭৫ শতাংশের এখন মানবিক সহায়তা প্রয়োজন, আমরা তাদের ওপর এই জ্বলন্ত অবিচার চালিয়ে যেতে পারি না।

দ্য স্পিকার থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
ফ্রেয়া ইন্ডিয়া এজার: লন্ডনের কিংস কলেজের আন্ডারগ্র্যাজুয়েট শিক্ষার্থী