সংবাদমাধ্যম এখন বিরোধী দলের ভূমিকায়: খালিদ মাহমুদ

খালিদ মাহমুদ চৌধুরী
খালিদ মাহমুদ চৌধুরী
>

একাদশ সংসদের মেয়াদ ছয় মাস ছুঁইছুঁই। ইতিমধ্যে বাজেট অধিবেশন শেষ হয়েছে। প্রথমবার মন্ত্রিসভায় (নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী) গেছেন দিনাজপুর-২ থেকে নির্বাচিত সাংসদ খালিদ মাহমুদ চৌধুরী। তিনি আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। সংসদ ও রাজনীতি নিয়ে তিনি কথা বলেছেন প্রথম আলোর সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মিজানুর রহমান খান

প্রথম আলো: আপনি তিনবারের সাংসদ। সংসদের ফ্লোরে ও কমিটিতে কী পরিবর্তন দেখেন?

খালিদ মাহমুদ চৌধুরী: ছাত্রজীবনে পত্রিকায় সংসদের ভেতরে কী ঘটছে, তা জেনে মর্মাহত হতাম। সরকারের অনেক ক্ষমতা ছিল, কিন্তু সংসদের ক্ষমতা ছিল না। সংসদীয় স্থায়ী কমিটির প্রধান ছিলেন মন্ত্রীরা। ফ্লোর ও কমিটি মন্ত্রীর কর্তৃত্বে। তাই সংসদের জবাবদিহি ছিল না। ১৯৯৬ সালে কমিটি থেকে মন্ত্রীদের সরিয়ে জবাবদিহির আওতায় আনা হয়। ৭১ বিধিতে জনগুরুত্বসম্পন্ন বিষয়ে দুই মিনিটে বলার নিয়ম ছিল। ২০০৯ সালে নতুন নিয়মে ১৫ জন দুই মিনিট বলার সুযোগ পান, তাঁদের ভাষ্য বই আকারে বেরোয়। যুদ্ধাপরাধের বিচার ও সংসদ টিভি সিদ্ধান্ত প্রস্তাব পাস হয়েছে। অথচ আগে রাজনৈতিক বিষয়েই আলোচনা আবদ্ধ থাকত। টেলিকমিউনিকেশনে সংসদীয় সুপারিশগুলো অধিকাংশই মন্ত্রণালয় গ্রহণ করেছে।

প্রথম আলো: তাহলে এই প্রশ্ন বা সমালোচনা উঠবে যে অনুগত বিরোধী দল, কারও কারও ভাষায় যা গৃহপালিত বিরোধী দল বা আপনারা যাকে গঠনমূলক বিরোধী দল বলেন, তাদের কারণে সংসদ একটা গুণগত পরিবর্তন এনেছে। বাস্তবতা তা–ই বলে?

খালিদ মাহমুদ চৌধুরী: আপনি যদি ২০১৪ ও ২০১৮ সালের সংসদীয় কার্যধারা দেখেন, বিরোধী দলের ভূমিকায় পরিবর্তন দেখবেন। সরকারের প্রশংসা ও সমালোচনা তারা করেছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, দ্রব্যমূল্য এবং গণমাধ্যমের সাম্প্রতিক আলোচিত বিষয়গুলো তারা আলোচনায় আনছে। বাংলাদেশের মানুষের কাছে সংসদীয় কার্যপ্রণালিগত বিষয়ের চেয়ে সমকালীন ইস্যুতে তর্ক–বিতর্ক বেশি গ্রহণযোগ্য। টেবিল থাপড়াথাপড়ি, ফাইলপত্র ছোড়াছুড়ি না থাকলে তাদের কাছে সংসদ পানসে মনে হয়। আমাদের রাজনীতির চর্চাটা এভাবেই তৈরি হয়েছে। সংসদকে কার্যকর করতে হলে বিধি অনুসরণ করতে হবে।

প্রথম আলো: বিএনপির এবারের অংশগ্রহণে কি ভিন্নতা চোখে পড়ে?

খালিদ মাহমুদ চৌধুরী: এটা আপনাকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বলতে চাই যে যেহেতু বিরোধী দলে জাতীয় পার্টি আছে, বিএনপির যে সাংসদেরা সংসদে এসেছেন, তাঁদের আচরণ কিন্তু নবম সংসদ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। আমি সংসদে কয়েকটি বিল ও জনমত যাচাই প্রস্তাবে তাঁদের অংশগ্রহণ লক্ষ করে দেখেছি, তাঁরা গঠনমূলক আলোচনা করেছেন।

প্রথম আলো: কিন্তু তারপরও বিএনপির নবীন সাংসদও দুঃখ করে বলেছেন, সংসদে তাঁরা কথা বলার কম সময় পান, তাঁদের কথা থামিয়ে দেওয়া হয়।

খালিদ মাহমুদ চৌধুরী: আপনি ঠিক বলছেন। বিরোধী দল যে এটা বলতে পারছে, এটাই তো গণতন্ত্র, গণতন্ত্রের সৌন্দর্য।

প্রথম আলো: আপনি কি একমত নন যে বিদ্যমান বাস্তবতায় তাঁদের সময় বাড়ানো উচিত?

খালিদ মাহমুদ চৌধুরী: সংসদীয় কার্যপ্রণালি বিধিই বলে দিচ্ছে, সরকারি ও বিরোধী দল কতটা সময় পাবে? আমি বাজেটে মন্ত্রী হিসেবে বক্তব্য দিয়েছি ১০ মিনিট। কিন্তু তাঁরা সংসদ সদস্য হিসেবে কেউ ১৫ থেকে ২০ মিনিট কথা বলেছেন। এর বাইরে বিলগুলোর ওপর সংশোধনী ও জনমত যাচাই প্রস্তাব আনার সুযোগ আছে, যেটা সরকারি দলের নেই।

প্রথম আলো: আপনি নিজে এসবে কতটা কীভাবে অংশ নিয়েছেন, তার ফলাফল কী?

খালিদ মাহমুদ চৌধুরী: সরকারদলীয় সাংসদ হিসেবে আমার নিজের অংশ নেওয়ার সুযোগ খুবই সীমিত। কারণ, সংসদীয় কমিটি থেকেই সংশোধিত হয়ে আসে। তবে সাংসদ হিসেবে আমাদের করণীয় কী, সাংসদ হিসেবে আমাদের ভূমিকা কী থাকা উচিত, সেই জায়গায় আমাদের অনেক দুর্বলতা আছে। আসলে সেই ধরনের পরিবেশ–পরিস্থিতি বাংলাদেশে হয়ে ওঠেনি। একজন আইনপ্রণেতার যে ভূমিকা প্রত্যাশিত, সেটা আমার মনে হয় না বাংলাদেশে তৈরি হয়েছে।

প্রথম আলো: আপনার কি মনে হয় ৭০ অনুচ্ছেদ শিথিল করে বাজেট পাস ও অনাস্থা প্রস্তাব বাদ দিয়ে আপনাদের আর সবকিছুতে স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশের একটা পরীক্ষা হওয়া উচিত?

খালিদ মাহমুদ চৌধুরী: আমি তিনটি সংসদে ৭০ অনুচ্ছেদের সীমাবদ্ধতা অনুভব করিনি। বাজেটের এবং সরকারের নানা সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে সরকারি দলের অনেকে বক্তব্য দিয়েছেন। ৭০ অনুচ্ছেদ এখন সংবিধানে আছে, কিন্তু সংসদের আলাপ–আলোচনায় তা বোঝার উপায় নেই। এভাবে চলতে থাকলে ৭০ অনুচ্ছেদের কোনো দরকার থাকবে না। বাংলাদেশে দিন দিন বাক্‌স্বাধীনতা ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে, তাতে ৭০ অনুচ্ছেদের আবশ্যিকতা নিয়ে ভাবা যেতে পারে।

প্রথম আলো: কিন্তু বাক্‌স্বাধীনতা বা গণতন্ত্রসংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সূচকগুলোতে বাংলদেশের অবস্থান নিম্নমুখী।

খালিদ মাহমুদ চৌধুরী: এই সূচকগুলো কী কী বিষয়ের ওপরে তৈরি করা, সেটা আমার জানা নেই। বাংলাদেশের গণমাধ্যম সবকিছুই বলতে পারছে এবং বাংলাদেশের মানুষ সবকিছুই বলতে ও জানতে পারছে। সংবাদমাধ্যম ও টক শোগুলোতে সরকারের যথেষ্ট সমালোচনা হয় ও সমালোচনামূলক লেখা ছাপা হয়। আমি মনে করি, সূচক উঠল কি নামল, তা বড় কথা নয়, বাংলাদেশের মানুষের বাক্‌স্বাধীনতা গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে আছে।

প্রথম আলো: সংসদীয় কমিটির সুপারিশ আপনার মন্ত্রণালয় মানছে কতটা?

খালিদ মাহমুদ চৌধুরী: আমি বলেছি, আজ আমি মন্ত্রী, আপনি কাল হবেন। দেশের সক্ষমতা যাচাই–বাছাই করেই তবে কমিটির উচিত হবে সুপারিশ করা। যা বাস্তবায়নের সক্ষমতা আমাদের নেই, এমন সুপারিশ কাম্য নয়। নৌপথ ও নৌযান চলাচলে কমিটির সুপারিশগুলো আমরা মানার চেষ্টা করব। কিন্তু বুড়িগঙ্গায় থাকা ৩২টি ইয়ার্ড উচ্ছেদের আগে পুনর্বাসন নিয়ে ভাবতে হবে।

প্রথম আলো: সংসদের নতুন মুখগুলো কেমন করছে?

খালিদ মাহমুদ চৌধুরী: খুব আশাব্যঞ্জক না হলেও কিছু তরুণ আছেন, যাঁরা নিজেদের আগামীর জন্য প্রস্তুত করছেন। তবে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তর মতো বিচক্ষণ পার্লামেন্টারিয়ান কবে পাব, তা বলা মুশকিল। একজন সাংসদকে এখন আন্তর্জাতিক পরিসরেও ভূমিকা রাখতে হচ্ছে। তাই যথাপ্রস্তুতি না থাকলে সাংসদ হয়ে আমাদেরও বিব্রত হতে হবে।

প্রথম আলো: প্রধান বিরোধী দল বিএনপি এখন দুর্বল। আবার জাপাকে সংসদীয় গণতন্ত্রের ছায়া সরকার বলা যাচ্ছে কি?

খালিদ মাহমুদ চৌধুরী: সমাজ ধ্বংস করেছে জিয়া–এরশাদের ধারাবাহিক অপরাজনীতি। অর্থনীতিকে অপরাধীদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল। আমরা তো রাতারাতি শুধরাতে পারব না। জাতীয় পার্টির ছায়া সরকারের ভূমিকা পালনের সুযোগ নেই। কারণ, সংসদে তাদের সেই ধরনের অংশগ্রহণ নেই। তবে বিরোধী দল হিসেবে যতটা সমালোচনা করার, তারা সেটা করছে। আর অপরাজনীতির কারণে বিএনপি রাজনীতির ট্র্যাক থেকে সরে গেছে। তাই সংবাদমাধ্যমকে বিরোধী দলের ভূমিকায় থাকতে হচ্ছে। এটাই বাংলাদেশের সব থেকে দুঃখজনক ঘটনা। আবার ব্রুট মেজরিটি নিয়েও আওয়ামী লীগ তার চরিত্র হারায়নি। কারণ, আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব সঠিক ও ডায়নামিক।

প্রথম আলো: কিন্তু অর্থনীতি শক্তিশালী হলেও নির্বাচনব্যবস্থাসহ প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বলতর হচ্ছে। সমাজ হিংসাশ্রয়ী ও অপরাধপ্রবণ হচ্ছে। ১০ লাখ কোটি টাকার বেশি পাচার হলো, কোকোর টাকা ছাড়া আর কোনো টাকা ফেরত আনা যায়নি। নির্বাহী বিভাগের ওপর সংসদীয় নিয়ন্ত্রণ শিথিল। এসব বিষয়ে সংসদে কোনো কথা নেই।

খালিদ মাহমুদ চৌধুরী: আমাদের শাসনামলে অপশাসনের উদাহরণ নেই। শেখ হাসিনা কোথাও ছাড় দেননি। তিনি বলেছেন, জিরো টলারেন্স। আর অভিযোগ থাকলেই তো হবে না, প্রমাণ দিতে হবে। অন্যদিকে আইনের শাসন তখনই দুর্বল হবে, যখন রাজনীতিকে উপজীব্য করে একজন অপরাধীর মুক্তি চাওয়া হবে। কোকোর বিরুদ্ধে এফবিআই সাক্ষ্য দিয়েছে। পাচার হওয়া টাকার বিষয়ে যদি সেই রকম কিছু আসে, তাহলে সরকার নিশ্চয় পদক্ষেপ নেবে। কোনো সরকারপ্রধান যখন টাকা পাচারে যুক্ত থাকেন, তখন একটা সংস্কৃতি তৈরি হয়। বর্তমান সরকার সেই সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে। রাতারাতি কিছু করা যায় না। বর্তমান সংসদ নির্বাহী বিভাগের ওপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে।

প্রথম আলো: টানা তিন মেয়াদের পরও বলছেন রাতারাতি কিছু হবে না। সংসদে প্রকৃত শক্তিশালী বিরোধী দল তৈরিতে আপনাদের দায়িত্ব থাকবে না?

খালিদ মাহমুদ চৌধুরী: বাংলাদেশের গণতন্ত্র অ্যাসিড মেরে ঝলসে দেওয়া হয়েছিল। বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে রেপ করা হয়েছে। কাজেই আপনি যে বলছেন, তিনবারই সুযোগ পেয়েছি। তিনবারে কিন্তু সম্ভব নয়। ব্রিটেনের গণতন্ত্রের দিকে তাকালে দেখি, সেটা একটা নিরন্তর সংগ্রামের একটা জায়গা। এই সংগ্রামের কোনো শেষ নেই। যত বেশি চর্চা করবেন, তত বেশি উজ্জ্বল হবে। এখন কোনো দল যদি জনগণের পালস বুঝতে না পারে, তাহলে জনগণ তো আওয়ামী লীগের সঙ্গেই থাকবে।

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।

খালিদ মাহমুদ চৌধুরী: ধন্যবাদ।