যে গুজব বড়ই নির্মম!

গুজব। সত্য, মিথ্যা আর কুসংস্কারের এক মিশেল। কিন্তু তার মধ্যে কার অংশ কতটুকু, সে হিসাব মেলানো দায়। কখনো এটি হতে পারে ডাহা মিথ্যা। কখনোবা প্রতিপক্ষকে দমানোর কৌশল। গুজব কখনো হয়ে ওঠে সামাজিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির এক মোক্ষম হাতিয়ার।

‘পদ্মা সেতুর জন্য মাথা লাগবে’—এমন গুজব ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরাও আবেগতাড়িত হলাম। সত্যতা যাচাইয়ের আগেই শঙ্কিত হয়ে পড়লাম।

আসলে সব সময়ই প্রতিটি গুজবের পেছনে স্বার্থান্বেষী গ্রুপ থাকে। আরেক গ্রুপ থাকে, যারা এই গুজবকে কাজে লাগায়। পদ্মা সেতু ইস্যুতেও আমরা একটি অভিন্ন রূপ দেখলাম।

এই ডামাডোলের মধ্যেই নেত্রকোনায় এক মাদকাসক্তের কাছে শিশুর কাটামাথা পাওয়া গেল। আর যায় কোথায়। ওই ব্যক্তি জায়গায় শেষ। গণপিটুনিতে তিনি যেমন প্রাণটা হারালেন, তেমনি হারিয়ে গেল শিশুটির মাথা কাটার কারণ।

মিডিয়ার কল্যাণে সারা দেশ মুহূর্তে সেই খবর জেনেছে। এরপর কক্সবাজার, ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে গণপিটুনির খবর পাওয়া গেছে। কিন্তু কক্সবাজারের ঘটনায় আহত রোহিঙ্গা তরুণী নাকি ধর্ষণ থেকে রক্ষা পেতে ওই শিশুকে সাহায্য করতে ডেকেছিলেন। কিন্তু ছেলেধরা মনে করে লোকজন তাঁকে পিটিয়েছে। তাঁর ভাগ্য সহায় ছিল। তবু তাঁকে পুলিশে দেওয়া হয়েছে। এ যাত্রার অন্তত তিনি প্রাণে বাঁচলেন।

কিন্তু ঢাকায় এক নারীর ভাগ্য এতটা ভালো ছিল না। গণপিটুনিতে মারা গেছেন তিনি। এখন জানা যাচ্ছে, তিনি তাঁর সন্তান ভর্তির তথ্য জানতে বিদ্যালয়ে গিয়েছিলেন। কেউ আবার বলছে, তিনি মানসিক রোগী ছিলেন। যা-ই হোক, ওই ভদ্রমহিলা প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে বসে কথা বলছিলেন। এমন সময় গুজবের বশে উত্তেজিত জনতা তাঁকে টেনেহিঁচড়ে বের করে এনে পিটিয়ে মেরেছে। কেউ একবারও বিবেচনাও করল না, তিনি আদৌ ছেলেধরা ছিলেন কি না?

নারায়ণগঞ্জের মিজমিজি এলাকায়ও একই ধরনের ঘটনা ঘটেছে। সেখানেও গণপিটুনিতে একজন নিহত হয়েছেন। কিন্তু কেউই নিশ্চিতভাবে জানেন না, তিনি আসলেই ছেলেধরা ছিলেন কি না। কিন্তু সেসব বিবেচনার আগেই তাঁর জীবন শেষ।

কেবল সন্দেহের বশে একজন মানুষকে পিটিয়ে মেরে ফেলা গুরুতর ফৌজদারি অপরাধ। কেবল কিছু ব্যতিক্রম বাদে কোনো অবস্থায়ই আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার সুযোগ নেই। যারা কেবল সন্দেহের বশে এমন গর্হিত কাজ করেছেন, তাঁরা শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন। তাঁদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন।

কিন্তু অন্যদিক থেকে একটু ভাবুন। পুলিশ যা-ই করুক, যাকে হত্যা করা হয়েছে, তার জীবন কোনোভাবেই ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। বিনা দোষে একটা মানুষকে হত্যার এই উন্মাদ আচরণ আমাদের অবশ্যই বাদ দিতে হবে।

যদি আপনার মনে হয়, কেউ অপরাধ করে থাকতে পারে কিংবা করতে পারে, তাহলে তাকে পুলিশে দিন। তদন্ত করে পুলিশ ব্যবস্থা নেবে। কিন্তু কোনো অবস্থায়ই তাকে আঘাত করার সুযোগ নেই।

বানের পানির মতো গুজব আসে এবং ছড়ায়। কিছুদিন পর আবার সেটি চাপা পড়ে যায় বা হারিয়ে যায়। কিন্তু যে মানুষগুলো এই গুজবের বলি হয়, কী উত্তর দেব আমরা তাদের কাছে? তাদের পরিবারকে?

দেশে এখন ইমারজেন্সি সার্ভিস ৯৯৯ আছে। পুলিশ অ্যাপসে সারা দেশের পুলিশের নম্বর আছে। যেকোনো বিষয় আপনার সন্দেহ থাকলে জানান। বিষয়টি উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের থেকে নিশ্চিত হোন। চিলে কান নিয়ে গেছে ভেবে চিলের পেছন ছোটার আগে কানে অন্তত হাতটা দিন। প্লিজ!

মো. ইমরান আহম্মেদ: সহকারী পুলিশ সুপার (মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস), বাংলাদেশ পুলিশ, পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স, ঢাকা।