চাঁদে হাঁটা থেকে মহাকাশযুদ্ধ

ফাইল ছবি।
ফাইল ছবি।

মার্কিন নভোচারীদের প্রথম চাঁদে যাওয়ার ৫০ বছর পর, মহাকাশ দখলের প্রতিযোগিতাটি হলিউডের ফ্যান্টাসি জগৎ থেকে এখন বাস্তব হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে। ক্ষমতাধর দেশগুলো শুধু সব প্রাণ নিশ্চিহ্ন করার জন্য পর্যাপ্ত পারমাণবিক অস্ত্র মজুতই করেনি, তারা মহাকাশও সামরিকীকরণ করেছে। মহাকাশভিত্তিক সম্পদের ওপর বিশ্বের নির্ভরতা বাড়িয়েছে। বলা বাহুল্য, এর ঝুঁকিও প্রচুর। স্নায়ুযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে মহাকাশ দখলের প্রতিযোগিতার বিষয়টির নতুন বৈশ্বিক মহাকাশ প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতীকী মাত্রা রয়েছে। মহাকাশে মার্কিন কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য চাঁদে মার্কিন নভোচারীদের অবতরণের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। চাঁদ এখন অনেক দেশের কাছে মহাকাশে আধিপত্য বিস্তারের জন্য একটি প্রাকৃতিক স্টার্টিং পয়েন্ট।

গত জানুয়ারি মাসে চাঁদের দূরবর্তী অংশে চীনের প্রথম মনুষ্যবিহীন রোবোটিকস মহাকাশযান অবতরণ করে। চাঁদের অনাবিষ্কৃত দক্ষিণ মেরুতে ভারত ২২ জুলাই (আজ) একটি মনুষ্যবিহীন মহাকাশযান পাঠাচ্ছে। গত সপ্তাহে এই মহাকাশযান পাঠানোর কথা থাকলেও রকেট থেকে জ্বালানি লিক হওয়ার কারণে শেষ মুহূর্তে তা স্থগিত করা হয়। জাপান এবং এমনকি দক্ষিণ কোরিয়া ও ইসরায়েলের মতো ছোট ছোট দেশও চাঁদে মহাকাশযান পাঠানোর চিন্তাভাবনা করছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র তার অবস্থান সহজেই ছেড়ে দেবে না। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন ‘আগামী পাঁচ বছরে আমেরিকার মহাকাশচারীদের চাঁদে ফিরিয়ে আনতে’ অঙ্গীকার করেছে। মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স বলেছেন, ২০ শতকে যেমন তাঁরা চন্দ্র অভিযান করেছেন। ২১ শতকেও তাঁদের মহাকাশচারীদের চাঁদে পাঠানোর ক্ষেত্রে তাঁরা প্রথম হবেন।

এই ক্রমবর্ধমান মহাকাশ প্রতিযোগিতা শুধু বড়াই করার জন্যই নয়, দেশগুলো আক্ষরিক অর্থেই তাদের সামরিক মহাকাশ সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য এই প্রতিযোগিতায় নেমেছে। এ জন্য ট্রাম্প মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তরকে মহাকাশ বাহিনী গঠনের নির্দেশ দিয়েছেন। এটি হবে একটি স্বাধীন সামরিক শাখা, যার দায়িত্ব হবে মহাকাশ-সংক্রান্ত মিশনগুলো তত্ত্বাবধান ও পরিচালনা করা। যুক্তরাষ্ট্র আশা করছে, চীন ও রাশিয়ার হুমকি ও ক্রমাগত প্রতিযোগিতার মধ্যে এই বাহিনী মহাকাশে যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য নিশ্চিত করতে পারবে। তবে গত মাসে ভারপ্রাপ্ত প্রতিরক্ষামন্ত্রী প্যাট্রিক শানাহান পদত্যাগ করার আগে বলেছেন, মহাকাশে যুক্তরাষ্ট্রের এই আধিপত্য খুব দ্রুতই শেষ হবে, কেননা নতুন শক্তিগুলো মহাকাশ প্রযুক্তি ও সামরিকীকরণের ক্ষেত্রে সুদক্ষ হয়ে উঠেছে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য শক্তি হচ্ছে রাশিয়া ও চীন।

চীন মহাকাশে আধিপত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ২০১৬ সালে একটি স্বাধীন মহাকাশ বাহিনী গঠন করেছে। আগামী কয়েক বছরে চীন বিশ্বের সবচেয়ে বড় মহাকাশ টেলিস্কোপ ও বিশ্বের সবচেয়ে ভারী রকেট উৎক্ষেপণ এবং আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের মতো নিজেদের মহাকাশ স্টেশন বসানোর
পরিকল্পনা করছে। এতে বোঝা যাচ্ছে, মহাকাশ প্রতিযোগিতাটা বেশ জোরেশোরেই শুরু হয়েছে। বিদ্যমান মহাকাশ অবকাঠামোতে কমপক্ষে ১ হাজার ৮৮০টি উপগ্রহ রয়েছে, যেগুলো ৪৫টি দেশের মালিকানাধীন বা পরিচালিত।

এই তীব্র মহাকাশ প্রতিযোগিতায় আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় রয়েছে—ভারত। গত মার্চ মাসে, দেশটি তাদের নিজস্ব উপগ্রহগুলোর একটিকে ধ্বংস করতে অ্যান্টি–স্যাটেলাইট ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করেছে। যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও চীনের পর ভারত চতুর্থ দেশ, যে কিনা মহাকাশে এভাবে নিজস্ব উপগ্রহকে ধ্বংস করল। চীনের ২০০৭ সালের অ্যান্টি–স্যাটেলাইট ক্ষেপণাস্ত্রের সক্ষমতার প্রদর্শনীর মতো ভারতের এই পরীক্ষা কোনো আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখে পড়েনি। কারণ এটি ছিল মহাকাশযুদ্ধে চীনের সক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ জানানো। প্রকৃতপক্ষে, মার্কিন স্ট্র্যাটেজিক কমান্ডের প্রধান জেনারেল জন ই হেইটেন ভারতের এই পরীক্ষার ব্যাপারে তাঁর সমর্থন ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেছেন, ভারতীয়রা মহাকাশ থেকে হুমকির বিষয়ে সচেতন রয়েছে এবং আমার মনে হচ্ছে মহাকাশে নিজেদের রক্ষা করার ক্ষমতা ভারতের আছে।

জন হেইটেনের এই বক্তব্যে মনে হচ্ছে বিশাল পারমাণবিক অস্ত্রভান্ডার গড়ে তোলার পেছনে যেমন যুক্তি আছে, মহাকাশ সক্ষমতা অর্জনের ক্ষেত্রেও তেমন যুক্তি আছে। পারমাণবিক সক্ষমতা অর্জনের সঙ্গে সঙ্গে দেশগুলো তাদের মহাকাশক্ষমতা বাড়িয়ে যাবে, যতক্ষণ না পর্যন্ত তারা মনে করবে যে তারা তাদের নিজেদের ও সম্পদের সুরক্ষা নিশ্চিত হয়েছে। তবে এ ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক নিয়ম ও আইন জোরদার করা আবশ্যক। ১৯৬৭ সালের আউটার স্পেস চুক্তির আওতায় মহাকাশভিত্তিক মানববিধ্বংসী অস্ত্র তৈরি ও ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু অন্যান্য অস্ত্রের ব্যবহার বা অ্যান্টি–স্যাটেলাইট পরীক্ষা নিষিদ্ধ করেনি। এখন একটি নতুন চুক্তি প্রয়োজন, যা মহাকাশে সব ধরনের শক্তির প্রয়োগকে নিষিদ্ধ করবে।

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, ইংরেজি থেকে অনূদিত
ব্রহ্ম চেলানি: নয়াদিল্লিভিত্তিক সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চের স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের অধ্যাপক