সমুদ্র বিজয় এবং অতঃপর

ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে দীর্ঘদিনের সমুদ্রসীমানা বিরোধ নিষ্পত্তি করে সমুদ্রজয় ছিল বর্তমান সরকারের একটি বড় অর্জন। ২০০৯ সালে এই সরকার ক্ষমতার আসার পরপরই বিষয়টি নিষ্পত্তির জন্য আন্তর্জাতিক আদালতের দ্বারস্থ হয়। আদালত ২০১২ সালে মিয়ানমার এবং ২০১৪ সালে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমানা চূড়ান্তভাবে নির্ধারণ ও নিষ্পত্তি করে। ‘সমুদ্র অর্থনীতি স্থবির কেন’ শিরোনামে গত মাসের ১১ তারিখ প্রথম আলো পত্রিকায় প্রথম আলোর উপসম্পাদক এ কে এম জাকারিয়ার একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। লেখাটি আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে সমুদ্র বিজয় অতঃপর তেল ও গ্যাস অনুসন্ধানে আমাদের অর্জন ও ব্যর্থতা সম্পর্কে কিছু বিষয়ে সরকারের দৃষ্টি গোচরীভূত করতে।

সমুদ্রসীমানা বিরোধ নিষ্পত্তির পর এযাবৎ মাত্র চারটি ব্লকে অনুসন্ধানের জন্য বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে পেট্রোবাংলা বা সরকারের চুক্তি হয়েছে। আমাদের সমুদ্রে নতুন করে ২৬টি ব্লক বিন্যাস করা হয়েছে, যার মধ্যে ১৫টি গভীর ও ১১টি অগভীর। ভারতের রাষ্ট্রীয় কোম্পানি ওএনজিসির সঙ্গে সেই ২০১৩ সালে দুটি অগভীর ব্লকের জন্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে, কিন্তু পরে তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান কাজে গতি ছিল মন্থর। অস্ট্রেলিয়ান কোম্পানি সান্তোসের সঙ্গে গভীর ব্লক ১১ এবং দক্ষিণ কোরিয়ার পোস্কো-দাইয়ুর সঙ্গে গভীর সমুদ্রে ব্লক ১২-এর জন্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। আজ পর্যন্ত কিছু দ্বিমাত্রিক সাইসমিক জরিপ ছাড়া তেমন কোনো অগ্রগতি নেই।

সমুদ্রে তেল ও গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য উত্পাদন বণ্টন চুক্তি বা পিএসসি বিডিংয়ের আগে প্রয়োজন মাল্টি-ক্লায়েন্ট সার্ভে বা সাইসমিক জরিপ করা। কিন্তু তা আজও অধরাই রয়ে গেল! এই জরিপের তথ্যাদি মূল্যায়ন করে প্রাথমিকভাবে তেল ও গ্যাস প্রাপ্তির লক্ষ্যে কোনো ভূগঠন রয়েছে কি না, তা অনুসন্ধান কাজের আগে জানা একান্তই প্রয়োজন। এই তথ্যাদি ছাড়া কোনো কাজ করা আর অন্ধকারে ঢিল ছুড়ে কোনো কিছু আশা করা একই রকম। আর এই জরিপ কাজটি সাধারণত করে থাকে বিশ্ববিখ্যাত কয়েকটি জিওফিজিক্যাল কোম্পানি তাদের নিজস্ব খরচেই। পরবর্তী সময়ে তারা ডেটা মূল্যায়ন করে বিভিন্ন তেল ও গ্যাস কোম্পানির কাছে তা বিক্রয় করে থাকে। প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে তারা তাদের এ কাজের ব্যয় নির্বাহ করে। যাদের জন্য মাল্টি-ক্লায়েন্ট সার্ভে করা হয়, তারা সব তথ্য ও মূল্যায়ন কোনো অর্থ দেওয়া ছাড়াই পেয়ে থাকে। এ ছাড়া কোনো কোনো ক্ষেত্রে ডেটা বিক্রয় থেকে যদি আর্থিক লাভ হয়, তার একটা অংশও পায়। এই জরিপ কাজটি করার জন্য শুধু সমুদ্র বিজয়ের পর নয়, এর আগেও ২০০২, ২০০৬ এবং ২০১৩ সালে বিভিন্ন স্বনামধন্য কোম্পানি তাদের নিজস্ব খরচে কাজটি করার জন্য আগ্রহ দেখিয়েছিল। কিন্তু বিধি বাম! প্রতিবারই পেট্রোবাংলা থেকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করে তা অনুমোদনের জন্য সরকারের কাছে পাঠায়। কিন্তু কোনো এক অদৃশ্য কারণে এ কাজের অনুমতি কখনোই মেলেনি। ২০০৬ সালে প্রায় ১.০৬ লাখ বর্গমিটার এলাকায় এই মাল্টি-ক্লায়েন্ট জরিপ কাজের অনুমোদনের জন্য মন্ত্রিসভা পর্যন্ত গিয়েছিল। কিন্তু অনুমোদন মেলেনি, এর গুরুত্ব যাদের অনুধাবন করা দরকার, তারা সে পথে হাঁটেনি।

যেকোনো পিএসসি বিডিংয়ের আগে মাল্টি-ক্লায়েন্ট সার্ভে করলে সংশ্লিষ্ট দেশ তার সমুদ্রসীমার বিভিন্ন ব্লকের প্রাথমিক তথ্য পেয়ে থাকে। যেমন বিভিন্ন ব্লকের ভূপ্রকৃতি, তেল ও গ্যাসের সম্ভাব্য আধার বা রিজার্ভার, রিজার্ভার শিলার পুরুত্ব, আঞ্চলিক ভূতাত্ত্বিক গঠন, সোর্স রক বা তেল ও গ্যাসের সম্ভাব্য উৎস, শিলার উপস্থিতি সম্পর্কে ধারণা পায়। এ ছাড়া তেল ও গ্যাসের সম্ভাব্য রিসোর্স বা সম্পদের পরিমাণের ধারণা পাওয়া যায়, যা সরকার এবং আগ্রহী তেল ও গ্যাস কোম্পানিগুলোর জন্য অত্যন্ত প্রয়োজন। এ তথ্য প্রাপ্তিতে আন্তর্জাতিক তেল ও গ্যাস কোম্পানির আগ্রহ বৃদ্ধি তথা পিএসসি বিডিংয়ে অংশগ্রহণের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়। পিএসসি চুক্তি করার সময় দর-কষাকষি করতে সুবিধা হয়। আর মাল্টি-ক্লায়েন্ট সার্ভে কাজটি স্বনামধন্য জিওফিজিক্যাল কোম্পানির মাধ্যমে সম্পাদন করাটা বাঞ্ছনীয়। এই মাল্টি-ক্লায়েন্ট সার্ভের বিষয়টি আন্তর্জাতিকভাবে একটি স্বীকৃত পন্থা।

বঙ্গোপসাগরের ভূতাত্ত্বিক তথা ভূস্তর গঠনের ইতিহাস পর্যালোচনার আলোকে একজন ভূতত্ত্ববিদ হিসেবে এটা বলা যায় যে বাংলাদেশের সমুদ্র অঞ্চলেও তেল ও গ্যাস পাওয়ার উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে। আমাদের প্রতিনিয়ত গ্যাসের চাহিদা বাড়ছে। কিন্তু অনুসন্ধান কার্যক্রমে খুবই ধীরগতি, বিশেষত সমুদ্র অঞ্চলে।

আমাদের দেশে সমুদ্রে তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান প্রথম শুরু হয় ১৯৭৫-৭৬ সময়কালে, যখন ছয়টি বিদেশি কোম্পানি দ্বিমাত্রিক সাইসমিক জরিপ কাজ সম্পন্ন করে। সে সময় সাতটি অনুসন্ধান কূপ খননের মাধ্যমে একমাত্র যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিয়ন অয়েল কোম্পানি কুতুবদিয়া গ্যাসক্ষেত্রটি আবিষ্কার করে, যার উত্তোলনযোগ্য গ্যাস মজুত মাত্র ৪৫ বিলিয়ন ঘনফুট। স্বল্প গ্যাস মজুতের কারণেও বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক না হওয়ায় গ্যাসক্ষেত্রটি থেকে আজ পর্যন্ত গ্যাস উত্তোলন করা হয়নি। ১৯৭৬ সালে ইউনিয়ন অয়েল কোম্পানি গ্যাস ক্রেটার স্বত্ব ত্যাগ করে চলে যায়। এর ২০ বছর পর ১৯৯৬ সালে ১৬ নম্বর ব্লকে সাঙ্গু গ্যাসক্ষেত্রটি যুক্তরাজ্যের কেয়ার্ন এনার্জি আবিষ্কার করে। এই ক্ষেত্র থেকে জুন ১৯৯৯ সময়কালে গ্যাস উৎপাদন শুরু করে এবং অক্টোবর ২০১৩ সময়কালে গ্যাস নিঃশেষ হওয়ার কারণে গ্যাস উৎপাদন বন্ধ করে দেওয়া হয়। এই ক্ষেত্র থেকে এযাবৎ প্রায় ৪৮৮ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন করা হয়েছে।

সমুদ্র বিজয়ের পর দেশের মানুষ সবাই আশা করেছিল দ্রুত সমুদ্রে তেল ও গ্যাস আহরণের বিষয়ে সরকার তৎপর হবে। এই রায়ের পর আমাদের সমুদ্রের নিচে বিশাল গ্যাস ও তেল সম্পদ আবিষ্কারের যে সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে, বিজয়ের সাত বছর পেরিয়ে গেল অথচ কোনো এক অজানা কারণে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই।

সমুদ্র বিজয়ের পর উন্মুক্ত হয়েছে আমাদের সমুদ্র সম্পদ আহরণের এক বিশাল সম্ভাবনার দুয়ার। তেল-গ্যাসসহ মূল্যবান খনিজ সম্পদ আহরণের জন্য আর বিলম্ব না করে দেশের স্বার্থে সরকারকে যথাযথ পরিকল্পনা নিতে হবে।

মর্তুজা আহমদ চিশতী: জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বাপেক্সের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক