দুই মেয়রের ডেঙ্গুদর্শন, রোম যখন পুড়ছিল…

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকনের পক্ষ থেকে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া রোগের চিকিৎসাসেবা ও ওষুধ পেতে ০৯৬১১০০০৯৯৯ নম্বরে টেলিফোন করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এই হটলাইনে টেলিফোন করে সেবা না পাওয়ার বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন একজন ভুক্তভোগী নাগরিক। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তিনি লিখেছেন, ‘গত রাত (২০ জুলাই) থেকে বউ ও আমি—দুজনের শরীরে মারাত্মক ব্যথা। রাতে ডিনার করে নাপা খেয়ে ঘুমাতে যাই। এরপর কিছুক্ষণের মধ্যে দুজনের ১০০+ জ্বর। দুজনের শারীরিক অবস্থা এমন যে কেউ কাউকে সহযোগিতা করার মতো অবস্থা নেই। মনে হচ্ছিল বমি হলে নাড়িভুঁড়ি বেরিয়ে আসবে। এমন অবস্থায় কোনো উপায় না দেখে ফোন দিলাম দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের হটলাইনে। বললাম, গতকাল থেকে প্রচণ্ড জ্বর। নারীকণ্ঠে বলা হয়, ওকে, চিকিৎসক পাঠাচ্ছি বাসায়। কিছুক্ষণ পর একজন ফোন দিয়ে বললেন, আপনার বাসার ঠিকানা দেন। পরে তিনি বললেন, আমার বাসা নাকি ঢাকা উত্তরে। বিষয়টা যাচাই করে তাঁকে বললাম, বাসাটি দক্ষিণেই। প্রতি-উত্তরে ডাক্তার বললেন, ওই এলাকায় আমাদের অন্য টিম আছে। তখন আমি অনুরোধ করে বললাম, কথা বলতে খুব কষ্ট হচ্ছে, আপনারা ওই টিমকে একটু জানিয়ে দেন। বললেন, ওকে, আমাদের হটলাইনে জানাচ্ছি। এক ঘণ্টা পার হলো কোনো ফোন আসেনি। মনে করলাম, হয়তো একটু দেরি হচ্ছে। কিন্তু আর ফোন আসেনি।’

এরপর তিনি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের কাছে প্রশ্ন রেখেছেন, সরকারের টাকায় মেডিকেল টিম কাদের জন্য? লাঠিয়ালদের না জনগণের?’

এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গতকাল দুপুরে দক্ষিণ সিটি করপোরেশন অফিস নগর ভবনে যাই। গিয়ে দেখি মেয়র নেই। প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা নেই। তাঁরা দুজনই শিশু হাসপাতালে গেছেন একটি জনসচেতনতামূলক কর্মসূচিতে। এ সময় একই কর্মসূচিতে মেয়র ও প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তার যাওয়া কতটা জরুরি? শুধু প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা নন, আরও কেউ কেউ মেয়রের সফরসঙ্গী হয়েছেন। পাশের কক্ষটি উপপ্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তার। খোঁজ নিয়ে জানলাম, অনেক দিন ধরে পদটি খালি।

এরপর একজন স্বাস্থ্য কর্মকর্তার সঙ্গে দেখা করে হটলাইন সেবার মান সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতেই বললেন, তিনি কথা বলতে অপারগ। কেননা অফিস থেকে বলা হয়েছে, প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা কিংবা জনসংযোগ কর্মকর্তা ছাড়া কেউ এ বিষয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে পারবেন না।

তবে তিনি একটি বিষয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছেন। ডেঙ্গু নিয়ে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে যে রিট হয়েছে, তাঁর পক্ষে আইনি লড়াইয়ের জন্য কদিন ধরে দৌড়ঝাঁপ করছেন। পরে সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন বিভাগ ঘুরে দেখা গেল, অনেক কর্মকর্তাই অফিসে নেই। মেয়র নেই বলে তাঁরাও গরহাজির। এভাবেই চলছে সিটি করপোরেশনের ডেঙ্গুবিরোধী জোরদার কার্যক্রম!

নগর ভবনেই দেখা হলো পুরান ঢাকার একজন নারী কাউন্সিলরের সঙ্গে। জিজ্ঞেস করলাম, তাঁর ওয়ার্ডের ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব কেমন। বললেন, রোববার সচেতনতা কর্মসূচিতে গিয়ে তিনি তিনজন রোগী পেয়েছেন। এ ছাড়া তাঁর এলাকায় আরও ১১–১২ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন বলে জেনেছেন।

তাঁকে পাল্টা প্রশ্ন করি, যখন ডেঙ্গুতে মানুষ মারা যাচ্ছে, হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে, তখন আক্রান্ত মানুষকে বাঁচানোই কি জরুরি নয়? তিনি স্বীকার করলেন, জরুরি এবং জনসচেতনতামূলক কর্মসূচি আরও আগে নেওয়া উচিত ছিল।

এর আগে সকালে গুলশানে উত্তর সিটি করপোরেশনের নতুন ভবনে গিয়ে মেয়রকে না পেলেও প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোমিনুর রহমানকে পেয়ে যাই। তাঁদের ডেঙ্গুবিরোধী কার্যক্রম সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, ‘কাজে আমরা সন্তুষ্ট নই। তবে চেষ্টা করছি।’ এরপর যোগ করলেন, মশা নিধনে মাঠপর্যায়ের কাজে এত দিন যে ঢিলেঢালা ভাব ছিল, সেটি কাটিয়ে উঠতে প্রতিটি ওয়ার্ডে আলাদা কমিটি করে দেওয়া হয়েছে। পুরোনো ৩৬টি ওয়ার্ডে কাজ করার মতো লোকবলও আছে। কিন্তু নতুন ১৮টি ওয়ার্ডে কাজ করতে হচ্ছে আউটসোর্সিং বা বাইরের লোক নিয়ে। তিনি ডেঙ্গু রোধে জনসচেতনতার ওপর জোর দিয়ে বললেন, বাসাবাড়ির মশা থেকেই ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া ছড়ায়। সিটি করপোরেশনের পক্ষে প্রত্যেকের বাসায় গিয়ে মশার ওষুধ ছিটানো সম্ভব নয়। এ জন্য নাগরিকদেরই সজাগ থাকতে হবে। কোনো বাসায় যাতে মশার প্রজননক্ষেত্র তৈরি না হয়, সে বিষয়ে সবাইকে ব্যবস্থা নিতে হবে। 

বললাম, কিন্তু আপনারা যে ওষুধ ছিটাচ্ছেন, তাতে তো মশা মরছে না। তিনি বললেন, মশা মরছে না, এ কথা ঠিক নয়। মশা মরছে, তবে কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় নয়। গত ২২ মে আইসিডিডিআরবির গবেষণায় যখন ধরা পড়ল ‘লিমিট লিকুইড ইনসেকটিসাইড’ নামের ওষুধটিতে কাজ হচ্ছে না, তখনই আমরা এর ব্যবহার বন্ধ করে দিয়েছি। সংস্থার প্রধান ভান্ডাররক্ষক জাকির হোসেনের মতে, বাতিল করা ওষুধটি তিনবার পরীক্ষা করা হয়েছে। প্রথমবার মরেছে ২ ভাগ মশা। দ্বিতীয়বার ১৮ ভাগ এবং তৃতীয়বার ৫০ ভাগ। ৯০ ভাগের কম মশা মরলে সেটিকে মানসম্পন্ন ওষুধ বলা যায় না।

কিন্তু উত্তর সিটি করপোরেশন ওই লিকুইড ইনসেকটিসাইডের ব্যবহার বন্ধ করলেও এখন পর্যন্ত এর বিকল্প কোনো ওষুধ কিনছে না। নতুন ওষুধ কেনা ও পরীক্ষা–নিরীক্ষার জন্য মেয়র আতিকুল ইসলামের নেতৃত্বে একটি কারিগরি কমিটি করা হয়েছে। তাঁরা এখন পর্যন্ত কোনো বৈঠক করেননি। ফলে নতুন ওষুধ কবে কেনা হবে, তা অনিশ্চিত।

মশা মারার ওষুধ নিয়ে উত্তরে টানাপোড়েনে থাকলেও দক্ষিণ অনেকটা নির্ভার। যে বৈঠকে লিমিট অ্যাগ্রো প্রোডাক্টের ওষুধ বাতিলের সিদ্ধান্ত হয়, সে বৈঠকে মেয়র সাঈদ খোকনও উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু তাঁরা ওই ওষুধ ছিটানো বন্ধ করেনি। গত রোববার তাঁকে জিজ্ঞেস করি, উত্তর সিটি করপোরেশনের বাতিল করা ওষুধ আপনারা কেন ব্যবহার করছেন? তিনি বললেন, তাঁরা কোনো বেসরকারি সংস্থার কাছ থেকে ওষুধ কেনেননি। কিনেছেন নারায়ণগঞ্জ ডকইয়ার্ড থেকে। তবে ঢাকা মশক নিবারণী দপ্তরের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, নারায়ণগঞ্জ ডকইয়ার্ড তৃতীয় একটি কোম্পানিকে কার্যাদেশ দেয়, যারা দ্য লিমিট অ্যাগ্রো প্রোডাক্ট থেকে ওষুধটি নিয়েছে।

 স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত ১ জানুয়ারি থেকে ২১ জুলাই পর্যন্ত ৬ হাজার ৫৪৪ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে। তাদের মধ্যে ৫ জন মারা গেছে। কিন্তু প্রথম আলোর প্রতিবেদন অনুযায়ী, আক্রান্তের সংখ্যা সাড়ে তিন লাখের বেশি। মারা গেছে ২৬ জন। প্রতিদিনই মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিকে ভর্তি হচ্ছে। ঢাকার বাইরেও ছড়িয়ে পড়ছে এ রোগ।

সিটি করপোরেশনের দায়িত্বহীনতায় একাধিকবার ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন উচ্চ আদালতও। গতকাল শুনানিতে হাইকোর্ট বলেছেন, ‘সিটি করপোরেশনের দায়িত্ব আছে। এটি এড়িয়ে যাবে কীভাবে? দায়িত্ব যাঁদের, তাঁদের কাজ করতে হবে। এক সপ্তাহ ধরে কী করেছেন? আগে তো কিছু করেননি। জনসচেতনতা ছাড়া কী করেছেন? মানুষ হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে, মানে কিছু করছেন না।’

গতকাল বেলা দেড়টায় যখন নগর ভবন থেকে বেরিয়ে আসি, তখনো দক্ষিণের মেয়র কিংবা প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা সচেতনমূলক কর্মসূচি থেকে ফেরেননি। তাঁরা জনগণকে ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী এডিস মশা সম্পর্কে সজাগ করছেন। কিন্তু নগর ভবনের বিভিন্ন তলা এবং দক্ষিণের অপরিচ্ছন্ন চত্বর দেখে মনে হলো, প্রদীপের নিচেই অন্ধকার। নগর ভবনে পরিচ্ছন্নতা বিভাগ ও ৭৫ জন পরিচ্ছন্নতাকর্মী থাকলেও এসব দেখার কেউ নেই।

ডেঙ্গু নিরোধ নিয়ে দুই সিটি করপোরেশনের কাণ্ড দেখে সেই পুরোনো প্রবাদের কথাই মনে পড়ে। ‘রোম যখন পুড়ছিল, নিরো তখন বাঁশি বাজাচ্ছিলেন…’।

সোহরাব হাসান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
[email protected]