হতাশা থেকে হিংস্রতার জন্ম

একটি সভ্য ও সুস্থ সমাজেও হঠাৎ একটি বীভৎস ঘটনা কেউ ঘটাতে পারে। তার জন্য সেই সমাজ দায়ী নয়। কিন্তু একই ধরনের বর্বরতা যখন সমাজের সাধারণ মানুষের প্রবণতায় পরিণত হয়, তখন গোটা সমাজ ও রাষ্ট্রকে তার দায় বহন করতে হয়। মানুষের জীবন জীবনই, তা ভিখারির হোক, পাগলের হোক, প্রতিবন্ধীর হোক বা রাজা-বাদশাহর হোক। স্বাভাবিক মৃত্যু নিয়ে কারও কিছু বলার নেই। দৈবদুর্বিপাকে বা দুর্ঘটনায় অপমৃত্যু নিয়ে মানুষ দুঃখ করে, তবে তা নিয়তি হিসেবেই মেনে নেয়। কিন্তু জনতা যখন একজন অপরিচিত মানুষকে রাস্তাঘাটে দিনদুপুরে পিটিয়ে হত্যা করে, তখন তা আদিম বর্বরতাকে 

হার মানায়।

রাষ্ট্রে যখন আইনের শাসন থাকে, ন্যায়বিচার থাকে, মানুষের মনে শান্তি থাকে, তখন অপরাধের মাত্রা থাকে খুব কম। অব্যক্ত চাপা ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে। অব্যক্ত ক্ষোভ ও হতাশার কারণে অসুখী মানুষের মধ্যে নির্যাতনস্পৃহার প্রবণতা দেখা দেয়। শক্তিমানের অপকর্মে যখন প্রতিবাদী হওয়ার পরিবেশ থাকে না, তখন অসহায় ও দুর্বলকে নির্যাতন করে একশ্রেণির মানুষ অপার আনন্দ পায়। গণপিটুনিতে মানুষ হত্যাকে সেই শ্রেণিতে ফেলতে পারি।

মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাবে গত জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ছয় মাসে সারা দেশে ৩৬ জন গণপিটুনিতে মারা গেছে। জুলাই মাসে সে সংখ্যা দাঁড়ায় ৪৩। শনিবার পুলিশ সদর দপ্তর থেকে এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে: ‘পদ্মা সেতু নির্মাণে মানুষের মাথা লাগবে’ বলে গুজব ছড়ানোকে কেন্দ্র করে সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন স্থানে ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনিতে মর্মান্তিকভাবে কয়েকজনের প্রাণহানি ঘটেছে। গুজব ছড়িয়ে ও গণপিটুনি দিয়ে হত্যার ঘটনা ফৌজদারি অপরাধ। দ্রুতই জড়িতদের আইনের আওতায় আনা হবে।

পদ্মা সেতুতে নরবলির গুজব কিছুদিন থেকে, কিন্তু গণপিটুনি চলছে অনেক আগে থেকেই। পদ্মা সেতু নিয়ে সরকারের সাফল্যে ঈর্ষান্বিত হয়ে সরকারবিরোধী কেউ গুজব ছড়াতে পারে। বাঙালির একটি শ্রেণি চিরকালই প্রতিহিংসাপরায়ণ। অন্যের সাফল্যে তার গাত্রদাহ হয়। তবে গুজব গুজবই। পদ্মা সেতু নির্মাণে মানুষের মাথার বুদ্ধি দরকার—তার পুরো মাথাটা নয়। পদ্মা সেতু জড়িয়ে মানুষের মাথার গুজব একটি ডাহা মিথ্যা। যেকোনো সুস্থ মানুষ এটাকে কিছু দুষ্টু লোকের ফাজলামি হিসেবেই মনে করে।

গুজব খুব বাজে জিনিস। গুজব একশ্রেণির মানুষ উপভোগও করে বটে, তবে সাড়ে পনেরো আনা মানুষ তা বিশ্বাস করে না। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে সমালোচনা করা স্বাভাবিক, কিন্তু ভেংচি কেটে প্রতিপক্ষ সম্পর্কে হড়হড়িয়ে মিথ্যা কথা বলা গুজব রটানোর চেয়ে ঘৃণ্য কাজ। তাতে মানুষের মধ্যে ক্রোধের সৃষ্টি হয়। সেই ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ ঘটে গুজব রটনা বা মিথ্যা প্রচারণার মাধ্যমে। সুতরাং সামাজিক পরিবেশ সুস্থ-স্বাভাবিক রাখতে সবারই সংযত আচরণ কাম্য।

অপরাধী শনাক্ত করতে মোবাইল ফোন এখন খুব ভালো ভূমিকা পালন করছে। যেসব গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে, ধারণা করি, তার সবগুলোতেই কেউ না কেউ মোবাইলে ছবি ধারণ করেছেন। অনেকগুলোতেই পুলিশ সদস্যও উপস্থিত ছিলেন। এই সব ঘটনার প্রতিটিতে একজন করে অপরাধীরও যদি দ্রুত বিচারের মাধ্যমে উপযুক্ত শাস্তি না হয়, তবে তা হবে রাষ্ট্রের বড় ব্যর্থতা। তাতে এ–জাতীয় হিংস্র ও নিষ্ঠুর স্বভাবের মানুষকে প্রশ্রয়ই দেওয়া হবে। একজন নিরীহ মানুষকে পিটিয়ে মারা ঠান্ডা মাথায় খুন। অপরাধ প্রমাণিত হলে মৃত্যুদণ্ডই তাদের প্রাপ্য।

বাঙালি সমাজ নিষ্কলুষ ও নিষ্পাপ কখনোই ছিল না। দুর্বৃত্ত এ সমাজে চিরকালই ছিল, কিন্তু এত বেশি মাত্রায় আগে ছিল না। শক্তিশালী রাজনৈতিক সংগঠন ছিল স্বাধীনতার আগেও, প্রশাসন স্বাধীনভাবে কাজ করত। জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার, থানায় সার্কেল অফিসার ও বড় দারোগা রাজনৈতিক দলের প্রভাবমুক্ত হয়ে কাজ করতেন। মানুষ তাদের শুধু যে ভয় করত তা নয়, সমীহ ও শ্রদ্ধাও করত। তখন আইন-আদালত নিজস্ব গতিতে চলত। মাত্রা মতো ঘুষ-দুর্নীতি তখনো ছিল। স্বজনপ্রীতিও ছিল। কিন্তু সমান্তরাল শাসনব্যবস্থা ছিল না। আগের দিনের অশ্বারোহী বাহিনীর কথা ইতিহাস বইতে পড়েছি, এখনকার মোটরসাইকেল বাহিনীর কাছে দুর্ধর্ষতায় তারা দুর্বল।

যারা অজানা–অচেনা নিরীহ মানুষকে পিটিয়ে মারে, এ সমাজে শুধু তারাই যে হিংস্রÊ, তা নয়। এই মানুষগুলো মুহূর্তের মধ্যে হিংস্রÊ হয়ে উঠে একজন নিরীহ নারীকে পিটিয়ে হত্যা করে। এদের চেয়েও শতগুণ হিংস্র মানুষ সমাজে রয়েছে। তাদের নাম শুনলে এলাকার মানুষের গায়ে কাঁটা দেয়। উপজেলা ও জেলার কর্মকর্তাদেরও বুক কাঁপে। হিংস্রদের সঙ্গে ভাব রেখে চলতে হয় তাঁদের। একটু তেড়িবেড়ি করলে সোজা বদলি অথবা ওএসডি হতে হবে। প্রকাশ্যে অপমানিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

আমরা জানতাম আইনজীবীরা স্বাধীন। তাঁরা চোর-ডাকাত-ধর্ষক-খুনির পক্ষেও আইনি সহায়তা দেন। কিন্তু আজ দেখি তাঁরাও এলাকার প্রভুর বিরাগভাজন হওয়ার ভয়ে এক অভিযুক্ত নারীকে আইনি সহায়তা দিতে নারাজ। উপমহাদেশের ইতিহাসে এমন ঘটনা আর কখনো ঘটেনি। মিডিয়ার চাপে যদি–বা একজন তাঁর উকিল হতে সম্মত হন, তিনিও নারীর প্রতিপক্ষের রুদ্ধদ্বার কক্ষে বৈঠক করেন। এখন মাদকসম্রাটরা মোগল সম্রাটদের মতোই পরাক্রমশালী। মেরুদণ্ড বলে যে একটি বস্তু মানুষের থাকার কথা, তা হারিয়েছেন সব শ্রেণি–পেশার নেতারা। আর হারাবেন না কেন, মেরুদণ্ডের চেয়ে জীবনের মূল্য বেশি।

যদি মনে করি সোনাগাজীর ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ ও স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশের মধ্যেই শুধু মৈত্রী গড়ে উঠেছিল এবং সে জন্য একটি মেয়েকে জীবন দিতে হয়েছে, দেশের অন্যান্য জায়গা বেশ চমৎকার চলছে, অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আর কোনো মেয়ের কোনো সমস্যা নেই, তা হবে বড় ভুল। বরগুনায় বন্ড বাহাদুরদের বৃত্তান্ত যদি সংবাদমাধ্যমের কল্যাণে জানাজানি না হতো, তা হলে দেশের কে জানত সেখানে প্রভু ও তাঁর পুত্রের নেতৃত্বে গড়ে উঠেছে এক সাম্রাজ্য এবং সমান্তরাল প্রশাসন। বাস্তবিক পক্ষে সমগ্র সোনার বাংলাই আজ সোনাগাজী, গোটা বাংলাদেশটাই আজ বরগুনা। দেশের অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দেখা যাবে সিরাজ উদদৌলাদের, বাংলাদেশ ভরে গেছে নয়ন বন্ডদের দ্বারা। তারা সক্রিয় প্রতিটি জেলা-উপজেলায় শুধু নয়, সব হাট-বাজার-গঞ্জে। গঞ্জের ব্যবসায়ীরা রাষ্ট্রকে ভ্যাট দিতে না চাইলেও বন্ডদের ভেট না দিলে তাদের কারবার বন্ধ শুধু নয়, এলাকায় থাকাই অসম্ভব।

মানবশিশুর জন্ম হতে লাগে নয় মাস। নয়ন বন্ডদের জন্মও কি একদিনে হয়? তাদের জন্ম দেওয়া হয়। তাদের গড়ে ওঠার পেছনে মুখ্য ভূমিকা ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতা, প্রশাসন, পুলিশ এবং মাদক ব্যবসায়ী। অনেক রকমের চেম্বার অব কমার্স রয়েছে বাংলাদেশে কিন্তু সবচেয়ে শক্তিশালী হলো অপ্রকাশ্য বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অব ড্রাগ মারচেন্টস। তাদের আইনের জালে আটকায়, তেমন বুকের পাটা কার?

মাদক ব্যবসায়ী ছাড়াও উঁচু আসনে যাঁরা বসে আছেন, তাঁদের কার্যকলাপেও মানুষের মধ্যে হতাশার সৃষ্টি হয়। একজন সারা জীবন টাকা জমিয়ে হজ করতে যেতে চান। তাতেও কত ঝক্কি। হজক্যাম্পে দিনের পর দিন বসে থাকার বিড়ম্বনা। বিমানবন্দরে হাজারো মশার কামড়। কেউ হজে না গিয়ে ডেঙ্গু বাধিয়ে হাসপাতালে। বিমানের ফ্লাইটের ঠিক নেই। অন্যদিকে একজন সাংবিধানিক উচ্চাসনে থেকে সরকারি অর্থে আরামে হজ পালন শুধু নয়, হজ ‘পর্যবেক্ষণ’ করতে যান। এসব দেখে মানুষের মধ্যে হতাশা ও বিতৃষ্ণার জন্ম হওয়া স্বাভাবিক।

বাঁচার অধিকার না থাকলে মানবজনমই বৃথা। কেউ যদি অপরাধী হয়, শাস্তি দেবে আদালত, অপরাধের মাত্রাভেদে মৃত্যুদণ্ড দেবে। কিন্তু রাস্তায় বেরিয়ে গণপিটুনির শিকার সভ্যজগতে হতে পারে না। তবে রাষ্ট্রের এটাও মনে রাখা দরকার, নিরীহ মানুষদের মেরে যে জনতা হাত পাকায়, ওই হাত ক্ষমতাবানদের গায়েও যে কখনো উঠবে না, তার নিশ্চয়তা নেই।

সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক