আসামেও ব্যর্থ হচ্ছে জাতিসংঘ

আসামে নাগরিক পঞ্জিতে তালিকাভুক্ত হওয়ার জন্য মানুষের আবেদন
আসামে নাগরিক পঞ্জিতে তালিকাভুক্ত হওয়ার জন্য মানুষের আবেদন

কদিন পরেই আসামে বিপুল মানুষ রাষ্ট্রীয় পরিচয় হারিয়ে ফেলবে বলে শঙ্কা হচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ায় মানবাধিকারের ক্ষেত্রে এ এক বড় বিপর্যয় বটে। জাতিসংঘের উদ্বাস্তুবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর ২০১৪-এ লক্ষ্য নিয়েছিল, এক দশকের মধ্যে ‘রাষ্ট্রবিহীন নাগরিকতা’র সমস্যাটি দূর করা যাবে। এই উচ্চাভিলাষী কর্মসূচির মধ্যেই আসামে খসড়া নাগরিক পঞ্জিতে (এনআরসি) গত বছর ৪০ লাখ মানুষের ‘নাগরিকত্ব হারানো’র ঘটনাটি ঘটে। এটা ছিল একটা বৈশ্বিক পশ্চাদ্ধাবন।

আসামের ঘটনাবলি বহুভাবে বিভিন্ন মানবাধিকার সনদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। সর্বজনীন মানবাধিকার সনদের অনুচ্ছেদ ১৫ অনুযায়ী,
‘প্রত্যেক মানুষের একটা জাতীয়তার অধিকার রয়েছে।’ প্রতিটি দেশের নিজস্ব আইনের আলোকে মানবাধিকারের ওই সনদের প্রতি দায়বদ্ধতা রয়েছে। ‘নাগরিকত্ব’ বিষয়ে কোনো রাষ্ট্র এমন কোনো অভ্যন্তরীণ কর্মসূচি গ্রহণ করতে পারে না, যা মানবাধিকারের আন্তর্জাতিক ওই অগ্রগতিকে পিছিয়ে দেয়। আসামে তা ঘটার শঙ্কা রয়েছে।

মানবাধিকার সনদের ‘অনুচ্ছেদ ১৫’কে বিবেচনা করা হয় রাষ্ট্রের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের নির্দেশনা হিসেবে। এই অনুচ্ছেদ ধরে নেয়, প্রত্যেকের অন্তত একটি দেশে নাগরিকত্ব থাকবে। এই বিবেচনায় কারও রাষ্ট্রবিহীন হওয়া বা কাউকে রাষ্ট্রবিহীন করা অন্তর্নিহিতভাবেই মানবাধিকারের জন্য বিপর্যয়কর।

সর্বজনীন মানবাধিকার সনদের উপরিউক্ত অনুচ্ছেদের পাশাপাশি জাতিসংঘ ১৯৬১ সালে গ্রহণ করে ‘কনভেনশন অন দ্য রিডাকশন অব স্টেইটলেসনেস’। আন্তর্জাতিক এই সনদ অনুযায়ী, প্রতিটি রাষ্ট্রের দায়িত্ব রয়েছে এটা দেখা, মানুষ যাতে রাষ্ট্রবিহীন না হয়ে পড়ে। ভারত এই সনদ অনুমোদন করেনি এবং আসামে ঘটছে উল্টোটা।

শিশু অধিকার সনদেও বলা হয়েছে, পূর্বপুরুষের ‘রাষ্ট্রবিহীনতা’র দায় শিশুর ক্ষেত্রে বর্তানো ন্যায়সংগত নয়। পিতা-মাতার নাগরিকত্ব মর্যাদা যা-ই হোক, শিশুরা জাতীয়তার অধিকারী হবে। ভারত এই সনদের অনুমোদনকারী। তবে আসামে এই সনদের নির্দেশনা অনুসরণ করা হয়নি। অথচ ভারতের সংবিধানের ৫১ (গ) অনুচ্ছেদ ‘আন্তর্জাতিক আইনি সনদসমূহের প্রতি শ্রদ্ধা’র কথাই বলে।

রাষ্ট্রীয় পরিচয়, নাগরিকতা, জাতীয়তা ইত্যাদি প্রশ্নে মানুষকে সুরক্ষা দিতে ভারতে কোনো একক আইন নেই। তবে ভারতীয় সংবিধানে পরোক্ষ রক্ষাকবচ ছিল। ‘অনুচ্ছেদ ২১’কে বলা হয় ওই জাতীয় দলিলের আত্মাস্বরূপ। যেখানে প্রত্যেক ‘ব্যক্তি’র জীবনের অধিকার ও ব্যক্তিস্বাধীনতার নিশ্চয়তা রয়েছে। কিন্তু আসামে নথিপত্র চূড়ান্ত পরীক্ষা না করেই ভোটার তালিকায় বেছে বেছে কিছু মানুষকে ‘সন্দেহজনক’ চিহ্নিত করে তাঁদের নাম পাঠানো হয়েছে ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালে। সেখানে অনেকেই ‘বিদেশি’ সাব্যস্ত হচ্ছেন। এভাবে লাখ লাখ লোক চরম এক মর্যাদাহানিকর পরিস্থিতিতে পড়ছেন। অনেকে আত্মহত্যাও করেছেন। জুলাই ২০১৯-এ এই লেখার সময় পর্যন্ত এনআরসির কারণে গ্লানিবোধকারী অন্তত ৫৭ ব্যক্তির আত্মহত্যার সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে।

শ্রেণি ও জাতিবিদ্বেষের লক্ষণ

সুনির্দিষ্ট আইন না থাকায় রাষ্ট্রহীনতার প্রশ্নটি কীভাবে শাসকশ্রেণির ভূরাজনৈতিক স্বার্থতাড়িত বিষয় হয়ে যায়, তার নজির ভারত। কোথাও তার সঙ্গে যুক্ত হয়ে যাচ্ছে ধর্মও। চীনের তিব্বতিরা ভারতে দশকের পর দশক আদৃত। তাদের পুনর্বাসনের জন্য জায়গা করে দেওয়া হয়েছে, নিবন্ধন কার্ড, স্বাস্থ্য ও শিক্ষাসুবিধার ব্যবস্থা হয়েছে। একই মনোভাব দেখা গেছে শ্রীলঙ্কার জাফনা ছেড়ে আসা তামিলদের ক্ষেত্রে। কিন্তু রোহিঙ্গাদের মতো মুসলমান শরণার্থীর ক্ষেত্রে নয়াদিল্লি তুলনামূলকভাবে ভিন্ন ভূমিকা নেয়। ২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর কথা জানানো হয়। এভাবে ‘জোরপূর্বক ফেরতের বিরুদ্ধে’ সুপ্রিম কোর্টে দুজন রোহিঙ্গার একটা জনস্বার্থ মামলা এখনো চলছে।

তবে রোহিঙ্গারা ভাগ্যবান। অপর দেশের নাগরিক হয়েও আশ্রয়ের অধিকার নিয়ে আদালতে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ পাচ্ছে তারা। ২০১৯-এর ২ জুলাই লোকসভায় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী কৃষাণ রেড্ডি জানিয়েছেন, আসামের ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল ১৯৮৫ থেকে ২০১৯-এর ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৬৪ হাজার ব্যক্তিকে ‘বিদেশি’ ঘোষণা করা হয়েছে কথিত ব্যক্তিদের মতামত না জেনেই।

আসামের এনআরসি প্রক্রিয়ায় শ্রেণিবিদ্বেষ ও জাতিবিদ্বেষের উপাদান ছিল। বেছে বেছে বিশেষ ভাষা ও ধর্ম-সম্প্রদায়ের ব্যক্তিদের জাতীয়তায় সন্দেহ করা, ‘সন্দেহ’ হলেই ট্রাইব্যুনাল ও ডিটেনশন সেন্টারে সোপর্দ করা এবং বন্দীদেরই নিজস্ব জাতীয়তার প্রমাণ প্রদর্শনের দায়ভার বহনে বাধ্য করা হয়েছে। এরূপ সন্দেহভাজনের অনেকেই দরিদ্র চাষি; বন্যা ও নদীভাঙনপ্রবণ চর এলাকার বাসিন্দা। এসব মানুষের পক্ষে অর্ধশতাব্দী আগের দলিল বা ভোটার তালিকার নথি হাজির করা সহজ নয়।

প্রতি ৩০ বর্গমাইলে ট্রাইব্যুনাল!

এ মাসের শেষে চূড়ান্ত নাগরিক পঞ্জি ঘোষিত হলেই আসামে মূল চরিত্র হবে ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালগুলো। ২০১৯-এর শুরুতে ট্রাইব্যুনালের সংখ্যা ছিল ১০০। জুলাইয়ের পর প্রায় এক হাজার ওইরূপ ট্রাইব্যুনাল গঠিত হতে চলেছে। এটা বিস্ময়কর। ৩০ হাজার ২৮৫ বর্গমাইলের আসামে এক হাজার ট্রাইব্যুনালের অর্থ, প্রতি ৩০ বর্গমাইলে একটি ট্রাইব্যুনাল।

এসব ট্রাইব্যুনালের জন্য প্রয়োজন ১২ হাজার বিচারক। যার জোগান দেওয়া দুরূহ। ফলে ‘বিচারক’দের মানের বিষয়ে আপস অনিবার্য। বলা হয়েছে, আইনজীবী হিসেবে কারও সাত বছর অভিজ্ঞতা থাকলে বা মধ্য পর্যায়ের অবসরপ্রাপ্ত প্রশাসনিক কর্মকর্তা হলেও ট্রাইব্যুনালের সদস্য হতে পারবেন। অথচ এসব ‘বিচারক’কে যাচাই-বাছাই করতে হবে প্রশাসনিক ও ভূমিসংক্রান্ত বহু ধরনের দলিল-দস্তাবেজ। তাঁরা সিদ্ধান্ত নেবেন মানুষের সর্বোচ্চ জরুরি মর্যাদার বিষয় ‘নাগরিকত্ব’ ও ‘জাতীয়তা’ নিয়ে।

এনআরসি প্রক্রিয়ায় এরূপ অদ্ভুত সুযোগও রাখা হয়েছে যে কারও নাগরিকত্ব স্বীকৃত হলেও রায়ে আপত্তি উত্থাপন করে আবার মামলা করা যায়। ওই ব্যক্তির নাগরিকত্ব তখন আবার ‘সন্দেহজনক’ বিবেচিত হবে। যে কাউকে এরূপ ‘আপত্তি’ তোলার ‘অধিকার’ দিয়ে রাখা হয়েছে। এই সুযোগে
অসমিয়া তরুণেরা বাংলাভাষীদের বিরুদ্ধে জাতিঘৃণার প্রয়োগ করেছেন নতুন উদ্যমে। ২০১৮-এর ডিসেম্বর পর্যন্ত নাগরিকত্ব নিশ্চিত হওয়া মানুষের বিরুদ্ধে এরূপ দুই লাখ ‘আপত্তি’ পেশ হয়েছে।

রাষ্ট্রবিহীনরা যাবে কোথায়

চূড়ান্ত এনআরসিতে কত মানুষ রাষ্ট্রবিহীন হয়, সেটা নিয়েই এ মুহূর্তে আসামজুড়ে জল্পনাকল্পনা হচ্ছে। যদি শেষ পর্যন্ত ২০ লাখ মানুষও ‘বিদেশি’ ঘোষিত হয় এবং তাদের ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালে আপিল শুরু হয়, তাহলে গড়ে প্রতি ট্রাইব্যুনালে অন্তত দুই হাজার মামলা জমা হবে। ট্রাইব্যুনাল যদি প্রতিটি আবেদন এক দিনেই ফয়সালা করে (যা প্রায় অসম্ভব), তা-ও অনেক আবেদনকারীকে ৫-৬ বছর করে ডিটেনশন সেন্টারে থাকার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। ট্রাইব্যুনাল থেকে চূড়ান্তভাবে নাগরিকত্বহীন হিসেবে রায় পেয়ে ডিটেনশন সেন্টার থেকে ছাড়া পেলে এসব ব্যক্তির ঠাঁই হবে কোথায়, তা-ও অনিশ্চিত।

এনআরসি প্রক্রিয়ায় আসামে বিভিন্ন রূপে মানবাধিকার লঙ্ঘন থামাতে এই লেখা তৈরির সময় পর্যন্ত জাতিসংঘ অন্তত তিনবার ভারতকে চিঠি দিয়েছে। উদ্বেগ ও করণীয়-সম্পর্কিত এরূপ চিঠি দেওয়া হয় ২০১৮-এর ১১ জুন ও ১৩ ডিসেম্বর এবং ২০১৯-এর ২৭ মে। সর্বশেষ তারিখে জাতিসংঘের পাঁচজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা লিখেছেন, ‘ভারত আসাম বিষয়ে জাতিসংঘের কোনো অনুসন্ধান ও উদ্বেগেরই উত্তর দেয়নি।...জাতিসংঘের এ বিষয়ে সংলাপের স্বীকৃত অধিকার রয়েছে, বিশেষত যে ঘটনায় লাখ লাখ মানুষের মানবাধিকার ক্ষুণ্নের শঙ্কা বিদ্যমান এবং যারা সংখ্যালঘু ও রাষ্ট্রবিহীন হওয়া, দীর্ঘস্থায়ী আটকাবস্থা এবং এমন কোথাও জোরপূর্বক প্রেরণের চরম ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে, যেখানে তারা কোনো দিন থাকেনি অতীতে।’

জাতিসংঘের এই বক্তব্যে বেশ দৃঢ়তা থাকলেও বাস্তবতা হলো, আরাকানে প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা রাষ্ট্রীয় পরিচয়হীন হয়ে পড়ার মতোই আসামেও লাখ লাখ মানুষের জাতীয়তা হারানো ঠেকাতে জাতিসংঘ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় চরমভাবে ব্যর্থই হয়েছে।

আলতাফ পারভেজ : দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ে গবেষক