হতাশ ভোটাররা যে নেতাদের বেছে নিচ্ছেন

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।

রাজনীতিকেরা সব সময়ই চালাকি করেন এবং তাঁদের আচরণ সবাইকে হতাশ করে—এ কথা আমরা জানি। কিন্তু একই ধরনের হতাশাজনক আচরণ কি ভোটাররা করতে পারেন?

উত্তরটা হলো: পারেন। অন্তত আমেরিকা এবং ইউরোপের ভোটারদের আচরণ দেখে তেমনটাই প্রতীয়মান হচ্ছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প একজন স্বভাবমিথ্যুক এবং রাশিয়ার সঙ্গে তাঁর যোগসাজশ থাকার যথেষ্ট লক্ষণ দেখা গেছে জেনেও এসব ভোটার ট্রাম্পকে ভোট দিয়েছেন। একইভাবে যুক্তরাজ্যের বরিস জনসন মিথ্যা বলেছেন ও প্রতারণা করেছেন জেনেও দেশটির ভোটাররা তাঁকে সমর্থন দিচ্ছেন। পোল্যান্ডে এ কথা এখন আর কারও অজানা নয় যে সেখানে ক্ষমতাসীন ল অ্যান্ড জাস্টিস পার্টি সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে কুক্ষিগত করছে, সরকারি সংবাদমাধ্যমকে নিজ স্বার্থে ব্যবহার করছে, মন্দ লোকদের পুরস্কৃত করছে এবং আদালতের স্বাধীনতাকে খর্ব করছে। এরপরও গত মে মাসে ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট নির্বাচনে এই ল অ্যান্ড জাস্টিস পার্টি পোল্যান্ডের বিরোধী দলগুলোকে হারিয়ে দিয়েছে।

আসলে পোলিশ, ব্রিটিশ ও আমেরিকান ভোটাররা নৈতিকভাবে দেউলিয়া হয়ে যাওয়া নেতাদের জিতিয়ে দিয়ে এমন একটি অবস্থা তৈরি করেছেন, যা জার্মান দার্শনিক পিটার স্লোটারডিকের কথা মনে করিয়ে দেবে। বর্তমানে যে অবস্থা চলছে, আশির দশকে তার পূর্বাভাস দিয়ে এই দার্শনিক বলেছিলেন ‘হতাশাজনিত কারণ’ই এর প্রধান অনুঘটক হবে। স্লোটারডিক বলেছিলেন, সাংস্কৃতিক অগ্রগতির বিশদ প্রচার কমে যাওয়ার সুযোগে এ অবস্থার সৃষ্টি হবে। আজকের দিনে দেখা যাচ্ছে পশ্চিমা অভিজাত সমাজ আলোকিত হওয়ার শিক্ষা আত্মস্থ করলেও সেই শিক্ষা তাঁরা সবার জন্য মঙ্গলজনক ইস্যুতে ব্যবহার না করে সংকীর্ণ ব্যক্তিস্বার্থের ক্ষেত্রে ব্যবহার করেছে। দাসত্ব, দারিদ্র্য এবং বৈষম্যের মতো বিষয়কে তাঁরা সমস্যা হিসেবে স্বীকার করেছেন ঠিকই কিন্তু সেই সমস্যার সমাধানে দৃঢ়প্রতিজ্ঞবদ্ধ হতে পারেননি।

আমরা বৈষম্য দূর করার হাজারো পথ আবিষ্কার করেছি কিন্তু বাস্তবতা হলো, বৈষম্য আগের মতোই আছে এবং তা বাড়ছে। গণতান্ত্রিক দেশগুলো দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে যতটা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে, তার চেয়ে ভূমিকা রাখছে রাশিয়া ও চীনের মতো কর্তৃত্ববাদী দেশগুলো। এসব দেখে গণতান্ত্রিক দেশগুলোর ভোটারদের মধ্যে হতাশা তৈরি হওয়া স্বাভাবিক। যখন তাঁরা দেখেন অগণতান্ত্রিক দেশের সরকারগুলো নিজেদের নাগরিকদের জীবন–জীবিকার উন্নতির দিকে বেশি মনোযোগী, তখন তাঁরা হতাশ হন। সেই হতাশা তাঁদের রক্ষণশীলতার দিকে ঠেলে দেয়। আর সেই সুযোগকেই কাজে লাগান ট্রাম্প, বরিস জনসন বা ভিক্তর অরবানের মতো নেতারা।

তাঁরা একধরনের গোষ্ঠীবদ্ধতার চেতনা জাগিয়ে তোলেন। বিভিন্ন জনতুষ্টিবাদী ইস্যুতে তাঁরা গোষ্ঠীবদ্ধ হয়ে পড়েন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিজেদের মতাদর্শ প্রচার করতে থাকেন। আগে আমাদের নিজেদের ভালো থাকা নিশ্চিত করতে হবে, পরে অন্যদের কথা ভাবা যেতে পারে—এই নীতি যখন হতাশাগ্রস্ত ভোটারদের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন দ্রুত তাঁরা তা গ্রহণ করে ফেলেন। ফলে এসব জনতুষ্টিবাদী নেতারা দুর্নীতিগ্রস্ত জানার পরও ভোটাররা নিজেদের গোষ্ঠীস্বার্থের কথা ভেবে তাঁদের ভোট দেন।

ইউরোপে পরিবেশবাদী ও জনতুষ্টিবাদীরা এমনভাবে বিভক্ত হয়ে গেছে যে এক পক্ষ অপর পক্ষের কোনো যুক্তি শুনতে রাজি নয়। সেখানে কার্যত রাজনৈতিক দলগুলো এখন আর ভোটারদের প্রতিনিধিত্ব করছে না বরং ভোটাররাই দলগুলোর প্রতিনিধিত্ব করছে। ফ্রান্সের সাম্প্রতিক ‘ইয়েলো ভেস্ট প্রোটেস্ট’-এর সময় এমনটিই দেখা গেছে। নানা দাবিতে জনতা রাজপথে নেমে আসার পর তাদের মন জয়ে সব দলই উঠেপড়ে লেগেছে।

ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট হওয়া, যুক্তরাজ্যে ব্রেক্সিট ভোটের ঘটনা এবং ল অ্যান্ড জাস্টিস পার্টি ও ভিক্তর ওরবানের উত্থান প্রগতির প্রতি মানুষের অনাস্থা বাড়ার সবচেয়ে বড় প্রমাণ। পূর্ব ইউরোপে দীর্ঘদিন ধরে প্রগতির সমার্থক হিসেবে সমাজতন্ত্র থেকে পুঁজিবাদে উত্তরণকে বোঝানো হতো। কিন্তু সেখানে পুঁজিবাদ প্রতিষ্ঠার পরও জনগণের ভাগ্য ফেরেনি। ফলে ওরবানের মতো নেতারা জনগণকে বোঝাতে সক্ষম হন যে, একমাত্র রক্ষণশীলতার মাধ্যমেই ভোটারদের স্বার্থ সংরক্ষণ করা সম্ভব। ভোটাররা যেহেতু গণতন্ত্রমনা নেতাদের নিয়ে হতাশ, সেহেতু তাঁরা সব জেনেও ট্রাম্পকেই বেছে নিতে চান।

ইংরেজি থেকে অনূদিত। স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট

স্লাভমির সিয়েরাকোভস্কি ওয়ারশর ইনস্টিটিউট ফর অ্যাডভান্সড স্টাডির পরিচালক