এ কোন দুঃসময়?

শিশু আয়েশা হত্যার বিচার ও ধর্ষকের ফাঁসির দাবিতে কোথাও আশা না দেখে একলা মায়ের একাই অবস্থান। জাতীয় প্রেসক্লাব, ঢাকা, ২১ জুলাই। ছবি: আব্দুস সালাম
শিশু আয়েশা হত্যার বিচার ও ধর্ষকের ফাঁসির দাবিতে কোথাও আশা না দেখে একলা মায়ের একাই অবস্থান। জাতীয় প্রেসক্লাব, ঢাকা, ২১ জুলাই। ছবি: আব্দুস সালাম

সায়মা আকাশ দেখতে ছাদে যেতে চেয়েছিল, আজ নিজেই জ্বলজ্বলে নক্ষত্র হয়ে রয়েছে পুরো আকাশময়। সায়মার মায়ের আহাজারিতে চোখের পানি আটকে রাখতে পারছি না। গণ্ডিবদ্ধ শহুরে জীবন আর পড়ালেখার ব্যাপক চাপে শিশুদের বাধাহীন আনন্দময় শৈশব তো আমরা দিতে পারছিই না উপরন্তু খেলতে গিয়ে ফিরতে হচ্ছে ধর্ষিত লাশ হয়ে।

‘শিশু ধর্ষণ’ কথাটি ভাবতেই মন লজ্জায়-কষ্টে মুচড়ে যায়। অথচ শিশু ধর্ষণ ও হত্যা যেন নৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। ৭ জুলাই প্রথম আলোয় প্রকাশিত ৭ বছরের শিশু সায়মা ধর্ষণ ও হত্যার খবরটি এক ঝটকায় নিজের ওই বয়সী মেয়েটির মুখ মনে করিয়ে দিল। প্রচণ্ড খারাপ লাগা নিয়ে ভয়ে শঙ্কিত হলাম স্কুলে, কোচিংয়ে বেড়াতে গিয়ে কিংবা নিজ বাসায় আমার মেয়েটা নিরাপদে, সুস্থতায় থাকবে তো? এ কোন দুঃসময় পার করছি আমরা? নুসরাত–বিভীষিকা কাটতে না–কাটতেই সায়মাসহ আরও দুই শিশু (৬ ও ৭ বছরের) ধর্ষণ। যখন এ কথা লিখছি হয়তো তখন আরও কোনো মেয়ের জীবনে ঘটে গেছে এ রকম নারকীয় বিভীষিকা। পত্রিকার পাতায় সব ঘটনা তো খবর হয়ে আসে না। কত ঘটনাই তো গভীর ক্ষত আর নীরব চোখের জলে চাপা পড়ে যায় পারিবারিক আর সামাজিক সম্মান রক্ষার্থে।

দূরবর্তী আত্মীয়, শুভাকাঙ্ক্ষীরা সতর্ক করে ‘মেয়েকে সাবধানে রেখো, কারও ডাকে কোথাও যেন একা না যায়, এমনকি শিক্ষক ডাকলেও না।’ ধরে-বেঁধে আটকে জড়বৎ অপ্রকৃতিস্থ করে কি শিশুসন্তান মানুষ করা যায়? একজন সুস্থ স্বাভাবিক শিশুকে যদি আশপাশের সবার সম্পর্কে ক্রমাগত সাবধান করতে থাকি, তাহলে কী হবে ওর মানসিক অবস্থা? মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যায় বলে একটা ভীতসন্ত্রস্ত ব্যক্তিত্ব তৈরি হবে শিশুটির, যার স্বাভাবিক শৈশব জীবন বলে কিছুই থাকবে না। কৌতূহলী শিশুমন নিয়ে ৭ বছরের মেয়ে আমার পত্রিকা পড়ে বিস্মিত চোখে প্রশ্ন করে ‘মা, ধর্ষণ কী? মেয়েটাকে মেরে ফেলল কেন?’ উত্তর দিতে কণ্ঠ রুদ্ধ হয়। আজ একটা মেয়ের জন্য কোনো সম্পর্কই সন্দেহাতীত নয়, এমনকি শিক্ষকের নিবিড় স্নেহও। অথচ কী আনন্দময় শৈশব কাটিয়েছি, যেখানে এমন অপ্রস্তুত করা ভীতিকর খবর ছিল না। পেশায় শিক্ষক বলেই যখন শুনি শিক্ষক দ্বারা ছাত্রী ধর্ষিত হয় তখন লজ্জায় মাথা নিচু হয়ে যায়। নিজ গৃহ থেকে শুরু করে কোনো জায়গায়ই মেয়েশিশুর জন্য নিরাপদ আশ্রয় নয়।

কানাডাপ্রবাসী এক বান্ধবী কথাচ্ছলে বলল, ‘বাংলাদেশের পত্রিকা পড়লে ধর্ষণের খবরে শরীর গুলিয়ে ওঠে। ভাগ্যিস মেয়েদের নিয়ে দেশ ছেড়ে চলে আসতে পেরেছিলাম।’ টনটনে দেশাত্মবোধ নিয়ে বলি, ‘কেন সে দেশে কি সামাজিক অপরাধ হয় না।’ সে আরও তীব্রতায় বলল, ‘তা নয়, তবে অন্যায়ের বিচার ঘটে চোখের পলকেই, এটাই শান্তি।’ এবার কণ্ঠস্বর ম্রিয়মাণ হলো আমার। ১০ জুলাই প্রথম আলোয় প্রকাশিত ধর্ষণবিষয়ক পরিসংখ্যান চোখের সামনে স্পষ্ট হলো।

২০১৯ সালের প্রথম ছয় মাসে শিশু ধর্ষণ ৬৩০টি, ধর্ষণজনিত হত্যা ২১টি। এ বিষয়ে মামলা হয়েছে ৩০০–এর কিছু বেশি। যার অধিকাংশ নিষ্পত্তির কিংবা সাজা হওয়ার সঠিক হিসাব জানা যায়নি। এ রকম হতাশাজনক পরিস্থিতিতে মেয়েশিশুসহ সব নারীর জীবনই শঙ্কিত।

কী কারণে বাড়ছে এই বিকৃত মানসিকতা তার অনুসন্ধানে প্রথমেই ফ্রয়েডিও মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে পাওয়া যায়। শৈশবের অবদমিত ইচ্ছা আর বাধাগ্রস্ত মানসিক প্রবণতাগুলোই পরবর্তী সময়ে ধর্ষণকামী মনোভাবসহ অপরাপর কুপ্রবণতা ও অপরাধের জন্ম দেয়। কিন্তু শুধু মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণই যথেষ্ট নয় বরং আরও কিছু কারণ সুস্পষ্ট। সর্বাগ্রে বলতে হয় প্রযুক্তির অবাধ ব্যবহারের কথা যার সুপ্রভাব যেমন অনস্বীকার্য তেমন কুপ্রভাবের তীব্রতাও ব্যাপকভাবে প্রমাণিত। Facebook, YouTube, Tubermate ইত্যাদির বাধাহীন ব্যবহার সহজলভ্য করেছে পর্নোগ্রাফিসহ সব বিজাতীয় অশ্লীল সংস্কৃতিকে। যার প্রভাবে ঘটছে পারিবারিক ও ধর্মীয় অনুশাসনের ব্যাপক ধ্বংস। ক্ষয় হচ্ছে সব বয়সী মানুষের আত্মিক বোধ। শিশু-কিশোরদের চলনে-বলনে, পোশাকে, চিন্তায় লক্ষনীয় হচ্ছে উগ্রতা ও বিকৃত রুচি, যা উৎসাহিত করছে ধর্ষণসহ অপরাপর সামাজিক অপরাধ। স্মার্টফোন আমাদের যতটা স্মার্ট করছে তার চেয়ে বেশি আত্মিক, ব্যক্তিক ও নৈতিক অধঃপতন ঘটাচ্ছে নিশ্চিতভাবে।

সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, রাষ্ট্রীয় আইনের শাসনের দুর্বলতা ও বিচারের দীর্ঘসূত্রতা। শুধু তাই নয় মাদকের ব্যবহার, প্রভাবশালী ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রভাব ও হুমকি, অর্থের বিনিময়ে অপরাধীর জামিনে ছাড়া পাওয়া ইত্যাদি বিষয় ধর্ষণসহ নানাবিধ সামাজিক অপকর্মের পুনরাবৃত্তি ঘটাচ্ছে।

বর্তমান অধঃপতিত সামাজিক বাস্তবতায় প্রয়োজন, দ্রুত অপরাধপ্রবণতাকে রুখে দেওয়া। তাই অবিলম্বে শিশু–কিশোরদের স্মার্টফোনসহ অন্যান্য প্রযুক্তির অবাধ ব্যবহারের বয়সভিত্তিক নিষেধাজ্ঞা প্রয়োজন। সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন আইনের আওতায় বিচারাধীন মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি ও অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত করা। সাধারণ মানুষ অন্যায় রুখতে রাষ্ট্রীয় আইনের শক্তিশালী আশ্রয় প্রার্থনা করে। এটির অভাবেই আজ সাধারণের প্রতিবাদের ভাষাও দুর্বল। তাই রাষ্ট্রকে তথা সরকারকেই শক্তি ও ভরসার জায়গাটি নিশ্চিত করতে হবে।

চরিত্র গঠন ও মানবিক বোধের ভিত পরিবারই তৈরি করে দেয়। সে অর্থে পারিবারিক অনুশাসন তথা অভিভাবকের সচেতনতা ও ধর্মীয়বোধের চর্চা সর্বাধিক জরুরি। শুধু তাই নয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সামাজিক পর্যায়ে অপরাধপ্রবণতা ও ধর্ষণের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রচারণা ও কাউন্সিলিং দরকার। শিক্ষার কারিকুলাম ও সিলেবাসে স্কুল পর্যায় থেকেই নৈতিক শিক্ষার ও যৌনশিক্ষার স্বচ্ছ ধারণাটি সংযোজন প্রয়োজন। মানুষের বিবেকবোধের উন্নয়ন ও সচেতনতাই পারে সব অন্যায়ের বিরুদ্ধে শক্তিশালী হাতিয়ার হতে উঠতে।

সবশেষে রাষ্ট্রীয় আইনের প্রতি আস্থা রেখে বলতে চাই নৈতিক বিবেচনায় অপরাধের মাত্রা অনুসারে শাস্তির বিধান রয়েছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে শাস্তির ‘প্রতিরোধাত্মক’ মতটির চূড়ান্ত প্রয়োগ বিবেচনায় আনা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে ‘দণ্ডদাতার উদ্দেশ্য শুধু শাস্তি দেওয়াই নয় বরং এমন দৃষ্টান্ত স্থাপন করা যা ভবিষ্যতে সম্ভাব্য অপরাধীকে অনুরূপ ভয়ংকর অপরাধ করা থেকে বিরত করে।’

আর যেন কোনো নুসরাত-সায়মার মতো বিভীষিকাময় খবর কারও হতে না হয়। আমার সন্তান যেন থাকে নিরাপদ আনন্দময় শৈশব আর বাধাহীন দুরন্তপনায়।

লাইলা পারভীন: শিক্ষক।