সব বৈধ ভোট শুধু নৌকায়

কোনো একটি কেন্দ্রে ভোট গণনার পর যদি দেখা যায়, বৈধ সব ভোট একজন প্রার্থীই পেয়েছেন, তবে তা নিঃসন্দেহে চমকপ্রদ ঘটনা। যদি কোনো নির্বাচনে এ রকম ঘটনা ৫৮৭টি ভোটকেন্দ্রে ঘটে, তবে তাকে কী বলা হবে? ভোট ও নির্বাচনব্যবস্থা নিয়ে গবেষণা করা বেসরকারি সংগঠন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) এমন ঘটনাকে ‘বিস্ময়কর’ বা ‘স্বাভাবিক’ মনে করছে না। উল্টো পুরো ঘটনাটিকেই অবিশ্বাস ও সন্দেহের চোখে দেখছে।

গত বছরের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৫৮৭টি ভোটকেন্দ্রের মধ্যে ৫৮৬টিতেই যত বৈধ ভোট পড়েছে, তার সবই পেয়েছেন নৌকার প্রার্থীরা। ধানের শীষ বা অন্য কোনো প্রতীকের প্রার্থীরা এসব কেন্দ্রে বৈধ ভোটের একটিও পাননি। নির্বাচন কমিশন (ইসি) ভোটের কেন্দ্রভিত্তিক যে ফলাফল প্রকাশ করেছে, তা বিশ্লেষণ করে সুজন এই তথ্য প্রকাশ করেছে।

 সুজনের তথ্য অনুযায়ী, ওই কেন্দ্রগুলো মোট ৭৫টি সংসদীয় আসনের আওতাধীন। এসব আসনের মধ্যে ৭৪টিতেই জয়ী হয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা। একটি আসনে জিতেছেন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটের অন্যতম শরিক ওয়ার্কার্স পার্টির প্রার্থী। তবে ওয়ার্কার্স পার্টির প্রার্থীও নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করেছেন।

ইসির ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা কেন্দ্রভিত্তিক ভোটের ফলাফলে সুজন একটি কেন্দ্রের খোঁজ পেয়েছে, যেখানে আবার উল্টো ঘটনা ঘটেছে। বৈধ ভোটের একটিও পায়নি আওয়ামী লীগ। ঘটনাটি মাগুরা-২ (শালিখা, মহম্মদপুর ও সদর উপজেলার একাংশ) আসনে। ইসির প্রকা​শিত ফল অনুযায়ী, শালিখা উপজেলার থৈপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে বিএনপির প্রার্থী সব বৈধ ভোট একাই পেয়েছেন। এই আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বীরেন শিকদার। তাঁর নিজ উপজেলা শালিখা।

তবে ৩০ ডিসেম্বর ভোট গণনার পর থৈপাড়া কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা ও পরে রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে যে ফল প্রকাশ করা হয়, তার সঙ্গে ইসির ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ফলের কোনো মিল নেই। রিটার্নিং কর্মকর্তা ঘোষিত ফল অনুযায়ী, থৈপাড়া কেন্দ্রে বিএনপির প্রার্থী নিতাই রায় চৌধুরী কোনো ভোটই পাননি। সব ভোট পেয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী। ইসির প্রকাশিত চূড়ান্ত ফলে এমন গুরুতর অসংগতি আরও কয়েকটি কেন্দ্রে রয়েছে বলে জানিয়েছে সুজন।

২০০৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও মাগুরা-২ আসনে মূল দুই প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন বীরেন শিকদার ও নিতাই রায় চৌধুরী। তখন থৈপাড়া কেন্দ্রে বীরেন শিকদার পেয়েছিলেন ১ হাজার ৪২ ভোট। আর নিতাই রায়ের ভোট ছিল ২৩৮টি। নবম সংসদেও আসনটিতে জয়ী হয়েছিলেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী।

মাগুরা-২ আসনটি দেশের সংসদীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসে বেশ আলোচিত। এর কারণ অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবিতে নির্দলীয়-নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার চালুর যে আন্দোলন ১৯৯৪ সালে শুরু হয়েছিল, তার মূলে ছিল মাগুরা-২ আসনের উপনির্বাচন। ওই বছরের মার্চে অনুষ্ঠিত উপনির্বাচনে ব্যাপক অনিয়ম, কারচুপি ও পেশিশক্তি প্রদর্শনের ঘটনা ঘটে। তখন সরকারে ছিল বিএনপি। দেশের রাজনীতিতে ‘ভোট ডাকাতির’ নির্বাচন হিসেবে পরিচিতি পায় মাগুরা-২ উপনির্বাচন। যার পরিণতি হিসেবে সংবিধান সংশোধন (ত্রয়োদশ সংশোধনী) করে দেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা চালু হয়েছিল। ভোট চুরি ঠেকাতে এই ব্যবস্থা চালু হলেও ২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর এই বিধানের প্রতি ‘আস্থা’ হারিয়ে ফেলে আওয়ামী লীগ। পরে সংবিধান থেকেও এই ব্যবস্থা মুছে যায়, ইতিহাসে ঠাঁই হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের।

মাগুরার ভোট জালিয়াতি নিয়ে সে সময় সাপ্তাহিক যায়যায়দিন-এ ‘মা-গুড়া’ নামে একটি প্রচ্ছদ প্রতিবেদন ছাপা হয়েছিল। তৎকালীন বিএনপি সরকার ভোটের বিষয়টিই ‘গুঁড়া’ করে দিয়েছিল ওই উপনির্বাচনে—এটিই ছিল প্রতিবেদনের মূল কথা। প্রতিবেদনটি করেছিলেন খন্দকার মুনীরুজ্জামান। তিনি এখন সংবাদ–এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক। তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, নির্বাচনব্যবস্থা নিয়ে যে আশঙ্কা ১৯৯৪ সালে করেছিলেন, তা থেকে এখনো মুক্ত হওয়া যায়নি। অবশ্য ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত হওয়া চারটি সংসদ নির্বাচন নিয়ে মানুষের মধ্যে তেমন কোনো প্রশ্ন নেই। কিন্তু একাদশ সংসদ নির্বাচনের পর নির্বাচনব্যবস্থা নিয়ে নতুন করে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

১৯৯১ সালে সংসদীয় গণতন্ত্রের যাত্রা শুরুর পর থেকে প্রতিবারই সংসদ নির্বাচনের পর পরাজিত দল নানা অনিয়ম, কারচুপির অভিযোগ তোলে। নির্বাচন পর্যবেক্ষক বিভিন্ন সংগঠনও নিজেদের মতো করে ভোটের মূল্যায়ন করে।

একাদশ সংসদ নির্বাচনের ছয় মাস পর ইসি কেন্দ্রভিত্তিক ফল প্রকাশ করে। সেটার বিশ্লেষণ ৯ জুলাই সংবাদ সম্মেলন করে তুলে ধরে সুজন। এ সময় একাদশ সংসদ নির্বাচনকে ‘অনিয়মের খনি’ বলে উল্লেখ করেন সুজনের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার। একই সংবাদ সম্মেলনে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, ভোটের অনিয়ম প্রমাণে আর কিছু দরকার হবে না। কেন্দ্রভিত্তিক ভোটের ফলাফলই বলে দিচ্ছে, কমিশন জালিয়াতি করেছে।

সুজনের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, সাতক্ষীরা-১ আসনের কেরালকাতা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে বৈধ ভোটের শতভাগ পেয়েছেন নৌকা প্রতীকের প্রার্থী। অবশ্য নৌকা প্রতীকে এই আসনে প্রার্থী ছিলেন মহাজোটের শরিক ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা মুস্তফা লুৎফুল্লাহ। ওই কেন্দ্রে ভোটার ছিলেন ২ হাজার ৯৫৬ জন। ভোট পড়েছে ২ হাজার ৫১৮টি, যার সবই নৌকা পেয়েছে। একই আসনের মদনপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোটার ছিলেন ১ হাজার ৬০ জন। ভোট পড়েছে ৮৬০টি, সবই পেয়েছেন নৌকার প্রার্থী।

কেবল ধানের শীষ প্রতীকের প্রার্থীই নয়, নৌকা প্রতীকের প্রার্থীও একটি কেন্দ্রে শূন্য ভোট পেয়েছেন। ঠাকুরগাঁও-৩ আসনের হাটপাড়া ফাজিল মাদ্রাসা কেন্দ্রে একটি ভোটও পায়নি নৌকা। অবশ্য ওই আসনে নৌকা প্রতীকে আওয়ামী লীগের কেউ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেননি। মহাজোটের কারণে সেখানে নৌকার হয়ে লড়েছেন ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা ইয়াসিন আলী। ভোটে তিনি জিততে পারেননি। এই আসনে জয়ী হন বিএনপির প্রার্থী জাহিদুর রহমান। ভোটে জেতার পর তিনিই আবার দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করতে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন। সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ নিয়ে বিএনপির নেতৃত্বকে তিনি চাপে ফেলে দেন। পরে অবশ্য বিএনপির অন্য বিজয়ীরাও (তবে মির্জা ফখরুল শপথ নেননি) সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ নিয়েছেন। এখন সংসদে তাঁরা সক্রিয় আছেন। যদিও বিএনপি বর্তমান সংসদকে ‘রাতের ভোটে নির্বাচিত’ বলে আসছে।

সুজনের বিশ্লেষণে এসেছে, নৌকা প্রতীকের প্রার্থীরা বৈধ ভোটের সবই পেয়েছেন, এমন প্রবণতা বেশি দেখা গেছে গোপালগঞ্জ ও মাদারীপুর জেলার সব আসনে, সিরাজগঞ্জ-৩, ফরিদপুর-১, নড়াইল-২, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৬ ও বরিশাল-১ আসনে। এর মধ্যে গোপালগঞ্জ জেলার ৩টি আসনের ৩৮৭টি কেন্দ্রের মধ্যে ২৩৯টিতেই সব বৈধ ভোট নৌকায় পড়েছে। মাদারীপুর জেলার ৩টি আসনের ৩৭৬টি কেন্দ্রের মধ্যে ৬৮টিতে বৈধ সব ভোট পেয়েছে নৌকা। ভোটের রাজনীতিতে গোপালগঞ্জ ও মাদারীপুর এমনিতেই আওয়ামী লীগের শক্ত ঘাঁটি। বিশেষ করে গোপালগঞ্জের তিনটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর চেয়ে অনেক বেশি ভোটে বিজয়ী হন আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা।

নির্বাচন কমিশনের দেওয়া কেন্দ্রভিত্তিক ফল বিশ্লেষণ করে সুজন গুরুতর অনিয়মের বিভিন্ন অভিযোগ তুলেছে। সব অনিয়মের তদন্ত না হলে নির্বাচনব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যাবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে সংগঠনটি। প্রায় একই ধরনের অভিযোগ তুলে ছয় মাস আগে তদন্তের দাবি করেছিল ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। একাদশ সংসদ নির্বাচনের দুই সপ্তাহ পর গত ১৫ জানুয়ারি এই নির্বাচন নিয়ে তাদের প্রাথমিক পর্যবেক্ষণ সংবাদ সম্মেলন করে প্রকাশ করে। এতে টিআইবি রাতে ব্যালটে সিল মারা, আগেই ব্যালট বাক্স ভরে রাখা, জাল ভোট, বুথ দখলসহ গুরুতর অনিয়মের অভিযোগ তোলে। অবশ্য টিআইবি ৫০টি সংসদীয় আসনের ওপর তাদের গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করে। ওই গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেছেন, সরকারের নৈতিক অবস্থান নিশ্চিত করার জন্য এবং সরকারের আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধির জন্য অভিযোগগুলোর বিচার বিভাগীয় তদন্ত হওয়া দরকার।

আগামী পর্ব: ভোটারদের মনস্তত্ত্বে হঠাৎ পরিবর্তন!

ইমাম হোসেন সাঈদ: প্রথম আলোর ডেপুটি হেড রিপোর্টিং