লভ্যাংশের লোভ দেখানোর কৌশল কাজে দেয়নি

বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করার আগে অতীতের দুটি শেয়ার মার্কেট বিপর্যয়ের কথা বলতে হয়। ১৯৯২ সালে ’৯২-৯৩ বাজেটে অনাবাসিকদের শেয়ারবাজারে অংশগ্রহণের ঘোষণা দেওয়া হয়। তখন অর্থমন্ত্রী ছিলেন সাইফুর রহমান। এ ঘোষণার পর বিনিয়োগকারীরা বলতে গেলে শেয়ার মার্কেটে হুমড়ি খেয়ে পড়লেন। বিশেষ করে আইপিওতে। কিছুদিনের মধ্যে ধারণা দেওয়া হলো যে বাংলাদেশের টাকা হংকংয়ে গিয়ে ডলারে রূপান্তরিত হয়ে ফের বিনিয়োগ হিসেবে বাংলাদেশে আসবে। তৎকালীন অর্থমন্ত্রী বিষয়টি অনুধাবন করে উদ্যোক্তাদের শেয়ার হোল্ডিংয়ের ওপর লকইন আরোপ করলেন।

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে অর্থমন্ত্রী হলেন শাহ এ এম এস কিবরিয়া। তাঁকে ভুল বুঝিয়ে লকইন ওঠানো হলো। তারপর ঘটল ভয়াবহ বিপর্যয়। আবার ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর শেয়ারবাজারের কিছু প্রভাবশালী উদ্যোক্তা অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বেশ দহরম–মহরম করে এ রকম একটা বার্তা সাধারণ বিনিয়োগকারীদের দিলেন যে সরকারই শেয়ারবাজারের গ্যারান্টি। তখন নিরীহ বিনিয়োগকারীরা শেয়ারবাজারে ভীষণভাবে ঝুঁকে পড়লেন। ফলে দ্বিতীয় দফায় ভয়াবহ শেয়ার কেলেঙ্কারি হলো। তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বিষয়টি অনুধাবন করলেন এবং কিছুসংখ্যক স্টক এক্সচেঞ্জ সদস্যকে শেয়ারবাজার নিয়ে খেলার অবাধ সুযোগ বন্ধ করার জন্য স্টক এক্সচেঞ্জকে ডিমিউচুয়ালাইজেশন করা হলো।

স্টক এক্সচেঞ্জ ছিল প্রাইভেট মেম্বারস ক্লাব, তাকে করপোরেট প্রতিষ্ঠানে রূপ দেওয়া হলো। অবশ্য করপোরেট সুশাসন প্রতিষ্ঠা নির্ভর করবে স্টক এক্সচেঞ্জের পরিচালনা পর্ষদ এবং এর নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) দক্ষতার ওপর। এই দুই বিপর্যয়ের সময় একশ্রেণির অর্থনীতিবিদ এমন আচরণ করেছেন যে তাঁরা যেন এলিয়েন, অন্য গ্রহ থেকে এসেছেন। তাঁদের কাছে আকাশ হলো শেয়ারের মূল্যরেখা। অন্তহীন ঋণ দেওয়ার পক্ষপাতী শেয়ার কেনার জন্য অথচ শেয়ার তাঁরাই কেনার কথা, যাঁদের বিনিয়োগের জন্য উদ্বৃত্ত অর্থ রয়েছে।

এবার বাজেট ঘোষণা আসার আগে নানা ধরনের আশ্বাস ছিল। আর করপোরেট ট্যাক্স কমানো হোক, এ ধরনের গান অষ্টপ্রহর চলছিল। গেল বাজেট ঘোষণায় বলা হলো যে কোম্পানির পরিশোধিত মূলধনের শতকরা ৭০ ভাগের বেশি যে রিজার্ভ/রিটেইন্ড আর্নিং থাকবে, তা লভ্যাংশ হিসেবে দিতে হবে। এ ছাড়া শতকরা ২০ ভাগের বেশি স্টক ডিভিডেন্ড দেওয়া যাবে না।

ব্যক্তিগত লভ্যাংশের পরিমাণ ২৫ হাজার টাকার ঊর্ধ্বে হলে কর আরোপের বিধান ছিল, সেটাকে ৫০ হাজার টাকা করা হলো। ধারণা করা হলো যেহেতু কোম্পানি লভ্যাংশ প্রদান করবে, সেহেতু শেয়ারবাজার চাঙা হবে। প্রথমত, লভ্যাংশ দেওয়া হয় ফেসভ্যালুর ওপর। বিনিয়োগকারী বাজার থেকে শেয়ার কিনলে শতকরা কত টাকা লাভ পাবেন। সাধারণত সঞ্চয়পত্রের মতো কেউ বেশি দিন শেয়ার ধরে রাখেন না। তা ছাড়া আইপিওতে ৫০–১০০টার বেশি শেয়ার পাওয়া যায় না। শেয়ারবাজারে যাঁরা আসেন, তাঁরা শেয়ার কেনাবেচার মাধ্যমে লাভ করতে চান। বেশির ভাগ আইপিও শেয়ার থাকে উদ্যোক্তা এবং বড় শেয়ারহোল্ডারের হাতে।

নিয়ন্ত্রণের স্বার্থে বেশির ভাগ উদ্যোক্তা নামে–বেনামে অনেক শেয়ারের মালিক। তাই লভ্যাংশের জন্য শেয়ারবাজার চাঙা হলে নিরীহ বিনিয়োগকারীরা হুমড়ি খেয়ে পড়তেন, তাহলে অনেক উদ্যোক্তা শেয়ার বেচে প্রচুর অর্থ পেতেন, যেমনটি হয়েছিল ’৯৬ ও ২০০৯-১০ সালে। আমরা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে পারি যে এবার এ রকম একটি দুর্যোগ ঘটেনি। আওয়ামী লীগেরও খুশি হওয়ার কথা যে তারা শেয়ার কেলেঙ্কারির হ্যাটট্রিক করার কলঙ্ক থেকে রক্ষা পেল। শেয়ার মার্কেট তার নিজের ধর্ম অনুযায়ী চলবে। মাঝেমধ্যে আইসিইউতে নেওয়ার চেষ্টা না করা ভালো।

প্রধানমন্ত্রী একটি অতিমূল্যবান উপদেশ দিয়েছেন, তিনি বুঝেশুনে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করতে বলেছেন। এর ফলে শেয়ারবাজারে দুর্বৃত্তায়ন
কমবে। কী উদ্যোক্তা, ব্যাংক, মার্চেন্ট ব্যাংক—সবাই রুল অব বিজনেস অনুযায়ী কাজ করলে শেয়ারবাজার স্বাভাবিক গতিতে চলবে। অতীতের
কথা মনে রাখতে হবে।

সৈয়দ মাহবুবুর রশিদ: ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সাবেক সচিব