ফিটনেসহীন বিআরটিএ

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) নামে অতি শক্তিশালী সরকারি প্রতিষ্ঠান আমাদের আছে। এই প্রতিষ্ঠানের সিল-ছাপ্পর মারা অনুমোদন ছাড়া কোনো মোটরযান আইনত দেশের কোনো সড়কে চলাচল করতে পারে না। কিন্তু বাস্তবে এ রকম কত যানবাহন সারা দেশে চলাচল করছে, তার সঠিক হিসাব খোদ বিআরটিএর কাছেই আছে কি না, এ নিয়ে আমাদের সংশয় আছে।

অবশ্য বিআরটিএ গত বুধবার হাইকোর্টে দাখিল করা এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, এই প্রতিষ্ঠানের দ্বারা নিবন্ধিত ৪ লাখ ৭৯ হাজার ৩২০টি যানবাহনের ফিটনেস সনদ নেই। অর্থাৎ, আইন অনুযায়ী এসব যানবাহন সড়ক-মহাসড়কে চলাচলের উপযোগী নয়। বিআরটিএ সাধারণত এ রকম হিসাব নিজে থেকে প্রকাশ করে না; গত ২৩ মার্চ দ্য ডেইলি স্টার-এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদন হাইকোর্টের নজরে এলে হাইকোর্ট স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে প্রতিষ্ঠানটিকে আদেশ দেওয়ার পর তারা এটা করেছে। তাদের এই হিসাবে শুধু সেই সব যানবাহনের কথা বলা হয়েছে, যেগুলোর ফিটনেস নবায়ন করা হয়নি। অর্থাৎ, ফিটনেস সনদ কখনোই নেওয়া হয়নি, এমন কতসংখ্যক যানবাহন চলাচল করছে, তার কোনো হিসাব নেই।

প্রশ্ন হলো, পৌনে পাঁচ লাখের বেশি যানবাহন ফিটনেস সনদ ছাড়াই কীভাবে চলাচল করতে পারছে। এই প্রশ্নের উত্তর মিলল গত বুধবার হাইকোর্টের শুনানির বিবরণ থেকে। আদালতের এক প্রশ্নের জবাবে বিআরটিএর আইনজীবী বলেছেন, ফিটনেসহীন যানবাহনগুলোর চলাচল নিষিদ্ধ করা হলে বা সেগুলো জব্দ করা হলে বিআরটিএ সেগুলো থেকে রাজস্ব আদায় করতে পারবে না। আমাদের বিবেচনায় বিআরটিএর এ অবস্থান অত্যন্ত উদ্বেগজনক। রাজস্ব আদায়ের লোভে চলাচলের অনুপযোগী যানবাহন অবাধে চলাচল করতে দিলে সড়ক পরিবহনব্যবস্থায় শৃঙ্খলা আশা করা নির্বুদ্ধিতা ছাড়া কিছু নয়। সড়ক-মহাসড়কে মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হওয়ার পেছনে বিআরটিএর এ অবস্থানের প্রভাব আছে। সড়ক দুর্ঘটনার অনেক কারণের মধ্যে ফিটনেসহীন যানবাহনও যে অন্যতম, তা অনেক গবেষণা-সমীক্ষায় প্রমাণিত হয়েছে।

যানবাহনের ফিটনেস নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন হলো, যেসব যানবাহনের ফিটনেস সনদ দেওয়া হয়েছে বা নবায়ন করা হয়েছে, সেগুলোর সবই কি প্রকৃতপক্ষে চলাচলের উপযোগী? মেয়াদোত্তীর্ণ যানবাহনের গায়ে রং লাগিয়ে যারা বিআরটিএর কাছে ফিটনেস সনদ নিতে যায়, বিআরটিএ কি তাদের সবাইকে ফিরিয়ে দেয়? এ বিষয়ে কোনো তথ্য না থাকলেও এটা উল্লেখ করা দরকার যে সব ধরনের সনদ প্রদানের ক্ষেত্রে বিআরটিএর বিরুদ্ধে অনৈতিক যোগসাজশের অভিযোগ অনেক। এ বিষয়ে তদন্ত হওয়া উচিত। নবায়িত ও বৈধ ফিটনেস সনদ আছে, কিন্তু যথাযথ পরীক্ষায় কোনো মোটরযান সড়কে চলাচলের অনুপযুক্ত প্রমাণিত হলে সেই সনদ প্রদানের দায়িত্ব পালনকারী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আইনানুগ পদক্ষেপ ও শাস্তি নিশ্চিত করা উচিত। 

ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়াই যানবাহন চালাচ্ছেন বা নবায়িত ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই কিন্তু যানবাহন চালাচ্ছেন, এমন লোকের সংখ্যা কত? গত বুধবার আদালতের এ প্রশ্নের উত্তরে বিআরটিএর আইনজীবী বলেন, ‘এই সংখ্যা এ মুহূর্তে বলতে পারছি না। তবে দেশে পেশাদার ও অপেশাদার ড্রাইভিং লাইসেন্স আছে ৩৩ লাখ ৭১ হাজার।’ ড্রাইভিং লাইসেন্স বিষয়ে বিআরটিএর বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ আছে। হাজার হাজার ব্যক্তিকে কোনো পরীক্ষা ছাড়াই ড্রাইভিং লাইসেন্স দেওয়ার অভিযোগ সুবিদিত। দুর্নীতির পাশাপাশি রয়েছে রাজনৈতিক বা সাংগঠনিক প্রভাব। একাধিক সরকারের আমলে রাজনৈতিক প্রভাবে একসঙ্গে বিপুলসংখ্যক ব্যক্তিকে পরীক্ষা ছাড়াই ড্রাইভিং লাইসেন্স দেওয়ার খবর সংবাদমাধ্যমে অনেকবার প্রকাশিত হয়েছে। এগুলো বন্ধ করা একান্ত জরুরি।

বিআরটিএর ব্যবস্থাপনা উন্নত করা প্রয়োজন। কিন্তু কোনো প্রতিষ্ঠানের জবাবদিহি না থাকলে তার ব্যবস্থাপনা উন্নত করা সম্ভব নয়। বিআরটিএর জবাবদিহি আছে, এমন স্পষ্ট লক্ষণ নেই। এর জবাবদিহি নিশ্চিত করার উদ্যোগ নিতে হবে।