সর্বাঙ্গে ব্যথা ও ভীত বিড়ালের সমাজ

ক্যানিবালিজম বা নরমাংস ভক্ষণের গল্প সত্য না, রূপক। সেই রূপক গল্প আমাদের দেশে সত্যি হতে দেখছি। ‘সোশ্যাল ক্যানিবালিজম’ নামে একটি কথা চালু আছে। অপরের ক্ষতি চাওয়া এর ছোট রূপ। বড় রূপ হলো অবিরত হত্যা, সন্ত্রাস, ধর্ষণ ও গণপিটুনির হিড়িক। কিছুই নতুন না। 

২০১১ সালে নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জে পুলিশের উসকানিতে পুলিশের গাড়ি থেকে নামিয়ে গণপিটুনিতে ১৬ বছরের এক কিশোরকে হত্যা করা হয়। পুলিশের দেখানো মডেলটা খুব ছড়াল তখন। আমিনবাজারে ডাকাত বলে পাঁচ ছাত্রকে পিটিয়ে মারা হয়। সপ্তাহ পরে নোয়াখালীতে গণপিটুনিতে নিহত হয় ছয় অভিযুক্ত ‘ডাকাত’। ২০১৩ সালে ছেলেধরা সন্দেহে প্রতিবন্ধী নারীসহ তিনজনকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয় গাজীপুরে। সুন্দরবনে নিহত হয় ছয় ডাকাত। প্রায় সব ঘটনাতেই হত্যার পাবলিক উৎসব দেখা যায়। ভিডিও করার লোক পাওয়া যায়, জীবন বাঁচানোর হাত মেলে না। ভয়ে টান টান অবস্থাকে বিস্ফোরিত করার অনুঘটক ছিল ‘ছেলেধরার’ গুজব আর সত্যিকার ‘ডাকাতের’ ভয়। সামাজিক বিপর্যয়ের যে সতর্কসংকেত এসবে লুকিয়ে ছিল, তা পাঠ করতে পারিনি বলে সোশ্যাল ক্যানিবালিজম আরও ছড়াল। 

বিরোধী পক্ষকে বিনাশের রাজনৈতিক ক্যানিবালিজম আর ক্রসফায়ার-গুমের মতো প্রাতিষ্ঠানিক পদ্ধতিও চালু আছে, ঠেকানো যায়নি। ফলে রাস্তায় হাতুড়ি-চাপাতি-রামদা দিয়ে খুন যেন হাল ফ্যাশনের হিংস্রতা। মডেলটা সংক্রমিত ও বিবর্তিত হয়ে ছড়িয়ে পড়তে থাকল। প্রকাশ্যে অভিযুক্তকে মেরে ফেলার হাঁক আসছে—ফেসবুকে, সামাজিক জটলায়। খেলা দেখা নিয়েও গ্রামে গ্রামে খুনোখুনি হচ্ছে। প্রত্যেকেই ভয় পাচ্ছে প্রত্যেককে। অথচ দেশের পুলিশ বাহিনীর আকার, নিরাপত্তা ব্যয় ও সক্ষমতা সর্বকালের মধ্যে এখন সবচেয়ে বেশি। 

প্রতিবাদহীন সহিংসতা মহামারির মতো ছড়ায়। সমাজের বুকে, মানুষের মনে এত এত হিংসার মাইন পোঁতা, যেকোনো সময় মানুষ বিস্ফোরিত হচ্ছে। যারা মরছে, তাদের বেশির ভাগেরই ক্রিমিনাল রেকর্ড নেই। যারা মারছে, তাদের বেশির ভাগই বেকার ও হতাশ। আত্মঘাতী হিংসার শিকার এই আমরাই। হিংসা বাইরে থাকলে ঠেকানো যায়, কিন্তু সেটা নিজের অংশ হয়ে গেলে কে কাকে ঠেকাব? তেজস্ক্রিয় ক্রোধ জমছে ব্যক্তি থেকে সমষ্টির মনে। ওদিকে মজা নিচ্ছেন ফজা ভাইয়েরা, যাঁরা নাকি ধরাছোঁয়ার বাইরে। 

আমাদের মনমগজ গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমের নেটওয়ার্কে এমনভাবে জড়িয়ে গেছে, জাতীয় জীবনের যেকোনো খারাপ ঘটনায় মন অস্থির হয়। বারবার ঘটার দৌলতে আর সংবাদমাধ্যমের পৌনঃপুনিক প্রচারে ভয় ঘনীভূত হলে মানুষ দিশেহারা হয়ে ফেটে পড়ে। পাবলিক ক্যানিবালিজমের এটাই উপযুক্ত পরিবেশ। কারণ, বলপ্রয়োগ ছাড়া আর সব নিয়ম-ব্যবস্থা খেয়ে জঙ্গলের জীবন কায়েম হয়েছে। পরস্পরকে খেয়ে ফেলার তো এটাই সুবর্ণ সময়। 

সমাজটা এভাবে হয়ে উঠেছে সহিংসতার চাক। দিশেহারা ও বিপন্ন মানুষের আচরণ লুকাতে পারছি না। বহু রকম সমস্যায় ভুগছি অধিকাংশই। হয় আমরা জানি না সমস্যার গোড়া কোথায় অথবা দায়ী কে বা কারা। জানলেও গোড়ায় হাত দেওয়ার, দায়ী ব্যক্তিদের মোকাবিলার সাহস হারিয়ে ফেলেছি। বছরের পর বছর এমন চলতে থাকলে স্নায়ু ভেঙে পড়ে, যুক্তিবোধ লোপ পায়। প্রথমজন খুন করল, দ্বিতীয়জন করল আত্মহত্যা। দুটাই আত্মঘাত। হতাশায় নিজেকে খাওয়া আর হিংসার বশে অপরকে হত্যা করায় একদিকে থাকে মৃত মানুষ, অন্যদিকে থাকে মানবতা মরে যাওয়া খুনি। 

আমাদের অবস্থা ভয় পাওয়া বিড়ালের মতো। এক ভদ্রলোকের শান্ত বিড়ালটা আরেকজনের হুলো বিড়ালের খামচানি আর সইতে পারছিল না। একদিন সেও সহিংস হয়ে উঠল। কিন্তু শত্রু বিড়ালটাকে নয়, সে খামচাতে গেল তার মেন্টরকে, যে তাকে খেতে-শুতে দেয়, আদর করে। অনেকটা রাস্তার রাগ ঘরের বউ-বাচ্চার ওপর ঝাড়ার মতো ব্যাপার। সমাজ মনস্তত্ত্বের ভাষায় একে বলে রিডিরেক্টেড অ্যাগ্রেসন বা ‘লক্ষ্য বদলে যাওয়া প্রতিহিংসা’। বন্দীরা কারাগার ভাঙতে না পারলে মাথা ভাঙে আরেক বন্দীর। স্বচক্ষে দেখেছি, অসহায় এক বন্দী কিছুদিন দেয়ালে মাথা ঠুকল, তারপর একসময় ঝাঁপিয়ে পড়ল তার সহবন্দীর ওপর। ওই বিড়ালের মতোই তখন সে দিশেহারা, যুক্তিহারা, আত্মহারা। বাংলাদেশের মানুষের দশা আজ অনেকটাই সে রকম।  

রাজনীতি অপরাধীদের কারখানা হয়েছে। অপশাসনে মানুষের সহনশীলতা শেষ। ক্রসফায়ার ও গণপিটুনির সমর্থক হলে বলবেই, ‘মাইরা ফালা, নাইলে পুলিশ ছাইড়া দিব’, ‘বিচার হইব না, মাইরা ফালা’। চোখ বাঁধা মানুষের যারে পাবি তারে খা ধরনের আচরণ এসব। বিষয়টা বুঝতে বারবার আমরা আলজেরীয় বিপ্লবী ফ্রানজ ফ্যানোর কাছে যাই। তিনি এ অবস্থাকে বলছেন ইন্টারমিডিয়েট ভায়োলেন্স বা মধ্যদশার সহিংসতা। দবির ও খবিরের শত্রুতা হলো ব্যক্তিগত। দল, সরকার, রাষ্ট্র, সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সহিংসতা রাজনৈতিক। আর বিশৃঙ্খল জনতা যখন কাউকে পিটিয়ে মারে, তখন তাকে বলব মধ্যম পর্যায়ের হিংসা। যে দেশে মানুষ আন্দোলন-সংগ্রাম বা বিপ্লব-বিদ্রোহের মাধ্যমে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে পারে না বা চায় না, সেখানে ব্যক্তিগত, রাজনৈতিক ও পাবলিক বা সামাজিক সহিংসতা মহামারি আকারে ছড়ায়। যখন মানুষ রক্ত দিতে ভয় পায়, তখন সমাজদেহে জমা বিষাক্ত রক্ত এভাবে পুঁজ হয়ে বেরোয়। 

রাজনীতি, অর্থনীতি, আইন ও প্রশাসন যদি ১০০-তে ৩০-এর নিচে নেমে যায়, তখন এমন হয়। হ্যাঁ, ভয়ের শাসনে মানুষ এ রকম হয়ে যায়। ভয়ের শাসনে সংস্কৃতি ধসে পড়ে। যুক্তিবুদ্ধি নষ্ট হয়, ভয়ার্ত বিড়ালের মতো আত্মরক্ষার প্রবৃত্তি প্রখর হয়। সহমর্মিতা, মানবতা, ন্যায়বোধ লোপ পায়। মানুষ হিংস্র এটা মেনে নিয়েই তো আমাদের সংস্কৃতি, আইন, প্রতিষ্ঠানকে মানবিক বানাতে হয়। এগুলো যখন ব্যর্থ হয়, তখন মানুষ বেরিয়ে পড়ে তার আদিম ভয় আর হিংসা নিয়ে। ফ্রয়েড বলেছিলেন, ন্যায়বিচার ছাড়া সভ্যতা থাকে না। 

ফারুক ওয়াসিফ প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক, লেখক