ভোটারদের মনস্তত্ত্বে হঠাৎ পরিবর্তন!

দেশের ৩০০ সংসদীয় এলাকার মধ্যে ১৮টি আসন বিএনপির বলে পরিচিত। ১৯৯১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত অনুষ্ঠিত টানা পাঁচটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এসব আসনে জয়ী হয়েছেন বিএনপির প্রার্থীরা। এর মধ্যে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন ছাড়া বাকি চারটিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছে আওয়ামী লীগ। ২০১৮ সালে একাদশ সংসদ নির্বাচনে এই ১৮ আসনের মধ্যে কেবল দুটিতে জয় পেয়েছে বিএনপি। আর দুটিতে তাদের কোনো প্রার্থী ছিল না। বাকি ১৪টিতে জেতা তো দূরের কথা, উল্টো ভোট কমেছে বিএনপির।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) নির্বাচন কমিশনের প্রকাশিত কেন্দ্রভিত্তিক ফল বিশ্লেষণ করে বলেছে, এসব আসনে বিএনপির ভোট কমাটা অস্বাভাবিক। বিএনপির প্রার্থীদের স্বল্পসংখ্যক ভোটপ্রাপ্তি অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। অনেকের মধ্যেই প্রশ্ন জেগেছে, ওই সব এলাকার ভোটারদের মনস্তত্ত্ব কি রাতারাতি পরিবর্তিত হয়ে গেল?

সুজনের বিশ্লেষণে এসেছে, কেবল বগুড়া-৪ ও বগুড়া-৬ আসনে ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রাপ্ত ভোটের তুলনায় বিএনপির ভোট বেড়েছে। এ ছাড়া বগুড়া-৩ আসনে ভোট ৪৮ দশমিক ৮৬ শতাংশ থেকে কমে হয়েছে ২৬ দশমিক ২৯ শতাংশ। বগুড়ার তিনটি আসন বাদ দিলে বিএনপিসহ জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থীদের সর্বোচ্চ ভোটপ্রাপ্তির হার দাঁড়ায় ১৮ দশমিক ৮৪ শতাংশ। এর আগে ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ব্যাপক বিজয়ের মধ্যেও এই আসনগুলো বিএনপি ধরে রাখতে পেরেছিল। লক্ষ্মীপুর-১ আসনে ২০০৮ সালে বিএনপি ৫৫ দশমিক ৬৭ শতাংশ ভোট পেলেও এবার একাদশ সংসদ নির্বাচনে পেয়েছে মাত্র ২ দশমিক ০২ শতাংশ।

একাদশ জাতীয় নির্বাচনের পরদিন ৩১ ডিসেম্বর বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, অতীতের নির্বাচনে যেসব আসনে বিএনপি ক্রমাগত জয়লাভ করেছে কিংবা পরাজিত হলেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় ভোট পেয়েছে, সেসব আসনে এবার ভোটের বিশাল পার্থক্য দেখা যাচ্ছে।

বিবিসির ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ফেনী-১ আসনে ১৯৯১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত প্রতিটি নির্বাচনে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বড় ভোটের ব্যবধানে জয়লাভ করেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে খালেদা জিয়া ১ লাখ ১৪ হাজার ৪৮২ ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছিলেন। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ প্রার্থী পেয়েছিলেন ৫৮ হাজার ৫৫১ ভোট। দুর্নীতির দায়ে দণ্ডপ্রাপ্ত হওয়ায় এবারের নির্বাচনে খালেদা জিয়া প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেননি। আওয়ামী লীগও প্রার্থী দেয়নি। এ আসনে নৌকা প্রতীক নিয়ে জিতেছেন জাসদের শিরীন আখতার। তিনি পান ২ লাখ ১ হাজার ৮১০ ভোট। প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির প্রার্থী পান ২৪ হাজার ৯৭২ ভোট। ভোটের এ বিশাল পার্থক্য বেশ অবাক করেছে স্থানীয় অনেক বাসিন্দাকে।

সুজনের বিশ্লেষণে বলা হয়, বিএনপিকে একাদশ সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করা হলেও ৩০০ আসনের মধ্যে ১৮টিতে ধানের শীষ প্রতীকের কোনো প্রার্থী ছিলেন না। একই সঙ্গে ধানের শীষ নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী ১৬৩ জন প্রার্থীই জামানত হারিয়েছেন; যার মধ্যে ছিলেন বিএনপির অনেক হেভিওয়েট প্রার্থী।

এই বিষয়ে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রথম আলোকে বলেন, ‘এবার তো নির্বাচনই হয়নি। জনগণ ভোট দিতে পারেনি। ভোটের আগের রাতেই তারা ডাকাতি করে নিয়ে গেছে। এর ফলাফলই-বা কী। আবার ওই ফলাফলের ওপর মতামত দেওয়াটা সমীচীন হবে বলে মনে করি না।’

তবে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও ১৪-দলীয় জোটের সমন্বয়ক মোহাম্মদ নাসিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘সারা দেশেই বিএনপির একটা ভালো ভোট আছে বলে মনে করি। ভোটের মাঠ ছেড়ে না দিলে শুধু ওই ১৮টি নয়, আরও অনেক আসনেই জয়ী হতো বিএনপি। ভোটাররা বিএনপির প্রার্থীকে খুঁজে পাননি, তাই ভোট পাওয়ার কথাও নয়। মাঠ ছেড়ে দেওয়াটাই বিএনপির ভরাডুবিতে বড় নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে।’

গত ৩০ ডিসেম্বর বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ করে এর ‘কথিত ফলাফল’ প্রত্যাখ্যান করেছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। জোটের নেতারা একই সঙ্গে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে পুনর্নির্বাচনের দাবি জানিয়েছেন। 

একই দিনে প্রথম আলোর অনলাইনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাম গণতান্ত্রিক জোটের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ‘গোটা দেশকে অবরুদ্ধ করে ভোটারদের ভোটাধিকার হরণ করে আরও একবার জোরজবরদস্তিমূলক প্রহসনের নির্বাচন মঞ্চস্থ করা হলো। বাম গণতান্ত্রিক জোট এই নির্বাচন ও নির্বাচনের ফলাফলকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করছে।’

আগামী শনিবার পড়ুন: ইভিএমে ভোটের হার ও ব্যবধান দুটিই কম

মহিউদ্দিন: প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক