মাদক মামলার বিচার বন্ধ কেন

বরগুনায় রিফাত হত্যার পেছনে মাদক ব্যবসার ভূমিকা রয়েছে বলে সংবাদমাধ্যমে খবর এসেছে। বরগুনা মাদক চোরাচালানের নতুন রুট, সমুদ্রপথে ইয়াবার বড় দুটি চালান ধরেছে র‍্যাব। ২ জুলাই ঢাকা-বরগুনা সপ্তবর্ণা লঞ্চে ৫০ কোটি টাকা মূল্যের ৫ লাখ ৫ হাজার ইয়াবা বড়ি মেলে। গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদে ওই দিনই ঢাকার আবদুল্লাহপুরে একই চক্রের কাছ থেকে আরও প্রায় সাড়ে ৩ লাখ ইয়াবা পাওয়া যায়।

এরই মধ্যে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের একটি দল ৬৫ নম্বর জিগাতলায় হানা দিয়ে ‘আইস’ নামের আরেকটি নতুন ভয়ংকর মাদক কারখানার সন্ধান পেয়েছে। এর সূত্রে যে বিবরণ পাওয়া গেছে, তা শুনে আমরা স্তম্ভিত। কর্মকর্তারা বলেছেন, এ এবং ও লেভেল উত্তীর্ণ এক যুবক মালয়েশিয়ায় পড়তে গিয়ে হতাশা থেকে ‘আইস’ বানাতে শেখেন এবং তা বানানোর কারখানা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এই যুবকের বাবা বুয়েটের প্রকৌশলী, মা সাবেক সহযোগী অধ্যাপক। এ ঘটনা আমাদের ভয় ধরিয়ে দেয় যে আইস বানানো এমন শিক্ষিত তরুণদের সঙ্গে বরগুনার অল্পশিক্ষিত নয়ন বন্ডরা কীভাবে যেন পরম্পরা তৈরি করছেন। দেশের যুবসমাজ কোথায় যাচ্ছে? এ রকম সময়ে দরকার মাদকের বিরুদ্ধে আইনের কঠোর প্রয়োগ।

হেরোইন-ফেনসিডিলের পর ইয়াবা আসে এবং অল্প কয়েক বছরের মধ্যে সারা দেশে তা ছড়িয়ে পড়ে। এখন তো ইয়াবার মামলা রুটিনকাজ। মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা আশ্বস্ত করছেন যে তাঁরা আইস ঠেকাবেন। কিন্তু মোহাম্মদপুর থেকে নটর ডেমের এক ছাত্রের কাছ থেকে ৫ গ্রাম, আরেকজনকে ১০ গ্রামসহ ধরা হয়েছে। এর থেকেও ভয়, ৫২২ গ্রাম আইসসহ নাইজেরীয় ধরা পড়েছেন। এই মাদক দেখতে তালমিছরির মতো। এর নাম ক্রিস্টাল মিথাইল এমফিটামিন। ইয়াবায় এমফিটামিন থাকে। কিন্তু আইসে এর (বাজারজাতকরণের জন্য নতুন নাম) পরিমাণ অনেক বেশি, তাই এর ক্ষতিকর প্রভাবও অনেক বেশি। হৃদ্‌রোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি বহুগুণ বেশি।

জিগাতলায় মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের যে কর্মকর্তারা অভিযান চালান, তাঁরা আইস দমনের প্রথম পদক্ষেপেই হোঁচট খেয়েছেন। কারণ, ঢাকার আদালত থেকে ফোনে শুনলেন, ১১ জুলাই এই মামলার সাক্ষ্য দেওয়ার দিন। পরিদর্শককে নিয়ে একজন কর্মকর্তা জ্যাম ঠেলে কোর্টে গেলেন। কিন্তু গিয়ে শুনলেন, সাক্ষ্য নেওয়া যাবে না। কারণ, আইন মন্ত্রণালয় থেকে চিঠি এসেছে। ২০১৮ সালের নতুন মাদক আইনটির জটিলতার কারণে এই মামলার বিচারকাজ চালানো যাবে না। ২০১৮ সালের ১৪ নভেম্বর নতুন মাদক আইন পাস হয়। ২৭ ডিসেম্বর তা কার্যকর হয়। এরপর মাদক নিয়ে যত নতুন মামলা হয়েছে, তার বিচার করা যাচ্ছে না। বিচার বন্ধ রয়েছে।

আমরা স্মরণ করতে পারি, ২০১৮ সালের মে মাসে সারা দেশে মাদকের বিরুদ্ধে ‘যুদ্ধ’ শুরু করা হয়েছিল। সেই মাদকবিরোধী যুদ্ধে তিন শতাধিক লোক মারা গেছেন। ডিসেম্বরের সাধারণ নির্বাচন সামনে রেখে এই অভিযান শুরু হয়েছিল। বর্তমান সময়ের বাস্তবতা হচ্ছে, মাদকবিরোধী যুদ্ধের দামামা এখন কিছুটা কমেছে, আর মাদক মামলার বিচার বন্ধ রয়েছে।

২০১৮ সালের আইনে বলা হয়েছিল, ‘সরকার প্রয়োজনীয়সংখ্যক মাদকদ্রব্য অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনাল স্থাপন করতে পারবে। তবে ট্রাইব্যুনাল স্থাপিত না হওয়া পর্যন্ত সরকার সংশ্লিষ্ট জেলার যেকোনো অতিরিক্ত জেলা জজ বা দায়রা জজকে তাঁর নিজ দায়িত্বের অতিরিক্ত ট্রাইব্যুনালের দায়িত্ব দিতে পারবে।’ সম্প্রতি বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বাধীন হাইকোর্ট বেঞ্চ একটি মাদক মামলায় জামিনের শুনানি করছিলেন। আসামির কাছ থেকে ১২ গ্রাম হেরোইন ও ১০টি ইয়াবা বড়ি পাওয়ার অভিযোগ ছিল। তখন বেঞ্চটি দেখতে পান, মাদক মামলাটি আমলে নিয়েছেন ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালত। আর বিচারের জন্য পাঠিয়েছেন ঢাকা মহানগর তৃতীয় যুগ্ম দায়রা জজ আদালতে। এটা দৃশ্যত এখতিয়ারবহির্ভূত। তাই আসামি জামিন পান। হাইকোর্ট ২৪ জুলাইয়ের মধ্যে স্বরাষ্ট্র ও আইনসচিবের কাছে ব্যাখ্যা চেয়েছেন। এর আগে একই বেঞ্চ ১০ বছরের পুরোনো মাদক মামলা ছয় মাসের মধ্যে নিষ্পত্তি করার নির্দেশনা দিয়েছিলেন। অধস্তন আদালত তা তামিল করেননি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেল, গত ৩ মার্চ আইন ও বিচার শাখা স্বরাষ্ট্রসচিব ও মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে জানিয়েছে, দেশের বিচারিক হাকিমদের মাদকদ্রব্য-সংক্রান্ত মামলা বিচারে বিচারিক ক্ষমতা না দিয়ে মাদকদ্রব্য অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হলে তা ‘আইনের প্রায়োগিক জটিলতা’ তৈরি করতে পারে। সে কারণে ‘সংশ্লিষ্ট বিধানসমূহ সংশোধন’ করা দরকার। আইন মন্ত্রণালয় এখন আইন সংশোধন করে স্পেশাল ম্যাজিস্ট্রেট (মাদক) হিসেবে দ্রুত বিচার আদালত গঠনের প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব, সুরক্ষা সেবা বিভাগকে পরামর্শ দিয়েছে। এই পরামর্শ কবে বাস্তবে রূপ নেবে, তা আমরা জানি না। 

সরকারের মাদকবিরোধী ‘যুদ্ধ’ শুরুর ১০ দিনে ‘গোলাগুলি’, ‘ক্রসফায়ার’ ও ‘এনকাউন্টারে’ শতাধিক নিহত ও ৯ হাজার ২০ জন গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। যে দেশে ৭০ লাখ মাদকাসক্ত, যার অধিকাংশ ইয়াবাসেবী বলে গবেষণা বলছে, সেই দেশের অভিযুক্তরা এখন একটা দায়মুক্তি ভোগ করছেন কথিত ‘আইনি জটিলতার’ কারণে। দেশে মাদক ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছে কি না, হাইকোর্টের প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেননি ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল। ৮ জুলাই হাইকোর্ট তাঁর আদেশে সে কথা উল্লেখও করেছেন। হাইকোর্ট ঢাকার যুগ্ম মহানগর দায়রা জজের (তৃতীয় আদালত) কাছে জানতে চেয়েছেন, কোন ক্ষমতাবলে তিনি মাদক মামলার বিচার করছেন?

সুপ্রিম কোর্টের দুটি রিপোর্টে দেখা গেল, গত ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের ৬৪ জেলায় ১ লাখ ৫৫ হাজার ৮৬৬টি মাদক মামলা বিচারাধীন ছিল। এর মধ্যে অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর—এই তিন মাসে নতুন মামলা ছিল ৫ হাজার ৭৬৫টি। কিন্তু পরের তিন মাসে (১ জানুয়ারি-৩১ মার্চ ২০১৯) এটা উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে। এই সময়ে নতুন মামলা হয়েছে ৮ হাজার ৫৯৮টি। এই মামলাগুলোর বিচারকাজ বন্ধ রয়েছে।

এখন আইন ও বিচারমন্ত্রী আনিসুল হকের আশ্বাসের ওপর আমরা ভরসা রাখতে চাই। ২২ জুলাই তাঁর কাছে জানতে চেয়েছিলাম, কবে এর নিরসন হবে। তিনি বললেন, শিগগিরই, আগস্টের মধ্যে। আশা করব, প্রয়োজনে রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশের মাধ্যমে হলেও যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই আইনি জটিলতার অবসান ঘটানো হবে।

মিজানুর রহমান খান :প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক