সু চির প্রেসিডেন্ট হওয়ার পথ খুলছে!

মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর অং সান সু চি
মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর অং সান সু চি

ফ্যাসিবাদের সব সময় ‘প্রতিপক্ষ’ প্রয়োজন হয়। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী তার বড় নজির। আরাকানে রোহিঙ্গারা নেই দুই বছর হলো। কিন্তু তুমুল যুদ্ধ লেগে আছে সেখানে। বান্দরবানের বিপরীত দিকে চীন ও আরকান প্রদেশের পালেটওয়া থেকে বুথিডং পর্যন্ত পুরোটাই এখন যুদ্ধক্ষেত্র। ৫০ হাজার মানুষ ওখানে উদ্বাস্তু। এই যুদ্ধে রাখাইনরা তাদের হারানো স্বদেশ ফিরে পেতে চাইছে বামারদের থেকে। রাখাইনদের ‘আরাকান আর্মি’ সামাল দিতে বামার বাহিনী দেশটির অন্যত্র সব ফ্রন্টে যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দিয়েছে।

তবে কামান-বন্দুক ছাড়াই আরেক যুদ্ধ শুরু হয়েছে রাজধানী নেপিডোতে। আরাকানের চেয়ে সেদিকেই এখন বিশ্বের আগ্রহ। অং সান সু চির এনএলডি বহুল প্রত্যাশিত সংবিধান সংশোধন করতে চাইছে এবার। এ নিয়ে মিয়ানমারের পার্লামেন্টে ঝড় উঠছে। আগামী বছর দেশটিতে জাতীয় নির্বাচন। সে উপলক্ষেই রাজধানীতে এই খণ্ডযুদ্ধের উত্তাপ।

সংবিধানের ৩৭০০ সংশোধনীর প্রস্তাব!
মিয়ানমারে স্বাধীনতার পর গত ৭৫ বছরে বামারদের সঙ্গে অল্পবিস্তর যুদ্ধ হয়নি—এমন জাতিসত্তা নেই। এ মুহূর্তে ঘটছে তার ব্যতিক্রম। সংবিধান নিয়ে রাজধানীর এবারের যুদ্ধটি বামাদের নিজেদের মধ্যেই হচ্ছে। এর বিকল্প ছিল না। কারণ, আধুনিক কালে কোনো সভ্য রাষ্ট্র এ রকম একটা সংবিধান নিয়ে এগোতে পারে না।

রোহিঙ্গা সংকটসহ মিয়ানমারের বহু সমস্যার উৎস বর্তমান সংবিধান। সেনাবাহিনী ২০০৮ সালে এই সংবিধান তৈরি করে দেশের ওপর চাপিয়ে দেয়। নব্বইয়ের দশকে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের বড় এক অঙ্গীকার ছিল এই সংবিধান পাল্টানো। ক্ষমতায় আসার তিন বছর পর সংবিধান সংশোধনের ডাক দিয়ে সু চি তাঁর অতীত অঙ্গীকারের পক্ষেই দাঁড়ালেন আবারও।

পার্লামেন্টে সংবিধান সংশোধনের প্রস্তাব তৈরি করতে গত ফেব্রুয়ারিতে ৪৫ সদস্যের একটা কমিটি করেছিল এনএলডি। ১৪টি রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি আছেন কমিটিতে। প্রস্তাব আহ্বান করামাত্র এ পর্যন্ত ৩ হাজার ৭০০ প্রস্তাব এসেছে কমিটির কাছে। যে সংবিধানে অনুচ্ছেদ ৪৫৭টি, সেখানে প্রায় সাত গুণ বেশি সংশোধন প্রস্তাব নিশ্চিতভাবেই এক অবিশ্বাস্য অবস্থা। সেনাবাহিনী দেশটির ওপর কীরূপ জগদ্দল পাথর চাপিয়ে রেখেছে, সংশোধন প্রস্তাবের বিপুলতা তার সাক্ষী। শান জাতীয়তাবাদীরা একাই ১ হাজার ১০০ সংশোধনীর প্রস্তাব করেছে। আরাকানের ন্যাশনাল পার্টি বলেছে ৮০০ সংশোধনীর কথা। মিয়ানমারের বর্তমান রাষ্ট্রকাঠামোয় দূরবর্তী অঞ্চলগুলোয় মানুষ কতটা অসুখী, তার নজির পার্লামেন্টে শান ও আরাকানিদের এরূপ অবস্থান। ক্ষমতাসীন এনএলডির নিজেরও রয়েছে ১১৩টি সংশোধন প্রস্তাব। তাদের সবচেয়ে বড় কষ্টের দিক হলো অং সান সু চির প্রেসিডেন্ট হওয়ার পথ আটকিয়ে রেখেছে এই সংবিধান। কিন্তু তাদের চলতি উদ্যোগের সফলতা নিয়ে গভীর সন্দেহ জারি আছে।

চোয়াল শক্ত করে দাঁড়াতে চাইছেন সু চি
মিয়ানমারে পার্লামেন্টের দুই কক্ষ। উভয় কক্ষে ২৫ শতাংশ আসনে বসেন সেনা প্রতিনিধিরা। পার্লামেন্টের প্রধান বিরোধী দল ইউএসডিপিও সেনাবাহিনী–প্রভাবিত। এটা আসলে তাদেরই ছদ্মদল। এর বাইরে দেশটির প্রশাসন ও জনজীবনের সর্বত্র রয়েছে প্রবল সেনা–আধিপত্য। কেবল চাকরিরত সেনা কর্মকর্তারাই নন, অবসরপ্রাপ্ত জেনারেলরাও সাংবিধানিক সুরক্ষা পান। অনুচ্ছেদ ৪৩২ অনুযায়ী তাঁদের কৃতকর্ম আইনের ঊর্ধ্বে। প্রতিরক্ষা, স্বরাষ্ট্রসহ তিনজন মন্ত্রীও নিয়োগ দেয় সশস্ত্র বাহিনী।

এখন সংবিধান সংশোধনের ব্যাপকভিত্তিক উদ্যোগ নেওয়ার অর্থ হলো সু চি পাঁচ লাখ সদস্যের এই বাহিনীর বিরুদ্ধে চোয়াল শক্ত করে দাঁড়াতে চাইছেন। তাদের ক্ষমতা কমিয়ে জনপ্রতিনিধিদের ক্ষমতা বাড়াতে চান। প্রশ্ন হলো, ‘টাটমা ড’ নামে পরিচিত দেশটির সশস্ত্র বাহিনী কেন সংবিধানের বিবাদিত ধারাগুলো পাল্টাতে দেবে? বিশেষ করে যে সংবিধান তাদের রাজত্বের রক্ষাকবচ। যদি সেনাবাহিনী রাজি না হয়, তাহলে সু চি এবং তাঁর দল যতই তোড়জোড় করুক, কোনো সংশোধন প্রস্তাবই অনুমোদিত হবে না। কারণ, সংবিধানের ৪৩৬ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী এর গুরুত্বপূর্ণ কোনো পরিবর্তনে ৭৫ শতাংশের বেশি সদস্যের সমর্থন দরকার। পার্লামেন্টের উভয় কক্ষ মিলে সু চির দলের সদস্য রয়েছে ৫৯ শতাংশ। সেনাবাহিনী ও তাদের সমর্থক ইউএসডিপির যৌথ সদস্য রয়েছে (২৫+৫) ৩০ শতাংশ। বিভিন্ন আঞ্চলিক দলের সদস্য রয়েছে ১১ শতাংশ। সামগ্রিকভাবে সু চির পক্ষে সমীকরণ দাঁড়াচ্ছে ৭০: ৩০,Ñযা সংবিধান পরিবর্তনের জন্য যথেষ্ট নয়।

সে ক্ষেত্রে সংবিধানের সংশোধন প্রশ্নে সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে সু চিকে আপস করতে হবে। আরও সরাসরি বললে দর-কষাকষি করতে হবে বর্তমান সেনাপ্রধান ‘সিনিয়র জেনারেল’ মিন অং হ্লাইয়ের সঙ্গে। সে ক্ষেত্রে সু চি কতটা অর্জন করতে পারবেন এবং সিনিয়র জেনারেলরা পুরোনো আইনগত সুযোগ-সুবিধা কতটা রক্ষা করতে চাইবেন, তার ওপরই নির্ভর করছে গণতন্ত্রের পথে মিয়ানমারের ভবিষ্যৎ।

তবে জেনারেল মিন অং হ্লাই ব্যাপক চাপে আছেন আন্তর্জাতিকভাবে। মধ্য জুলাইয়ে তিনি ও গুরুত্বপূর্ণ আরও কয়েক জেনারেলকে পরিবারসহ সফরে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে যুক্তরাষ্ট্র। সেনাবাহিনীর উপপ্রধান শো উইনও আছেন তালিকায়। বিষয়টি প্রতীকী হলেও এর নৈতিক তাৎপর্য বিপুল। মিন অং হ্লাইয়ের জন্য এটা অপমানকর। আট বছর তিনি কমান্ডার ইন চিফ হিসেবে আছেন, কিন্তু এতটা বিব্রতকর অবস্থায় পড়েননি। যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি বলেছে, রোহিঙ্গাদের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের জন্য জেনারেল মিন ও তাঁর সহযোগীরা দায়ী।

জেনারেল মিন অংয়ের জন্য সবচেয়ে নাটকীয় খবর এসেছে ইসরায়েল থেকে। মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনী এত দিন ইসরায়েলের শর্তহীন বন্ধুত্ব উপভোগ করেছে। কিন্তু ইতিহাসে এই প্রথমবার ইসরায়েল তাদের এক সামরিক প্রদর্শনীতে মিয়ানমারের তিন সেনা কর্মকর্তাকে ভিসা দিতে অস্বীকৃতি জানায়।

যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের এরূপ ভূমিকা পরোক্ষে দেশের অভ্যন্তরে সু চির অবস্থানকে শক্তি জোগাচ্ছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত (ইইউ) দেশগুলো অনেক দিন থেকেই সু চির বাড়তি ক্ষমতায়নের জন্য কাজ করছে। ফলে, সু চি ও এনএলডিকে এবার কিছু ছাড় না দিয়ে মিয়ানমারের ‘সিনিয়র জেনারেল’দের উপায় নেই। জেনারেল মিনকে ২০২১ পর্যন্ত স্বপদে থাকতে হবে। সু চির সঙ্গে আপসহীন অবস্থান নিলে তাঁর ওপর আন্তর্জাতিক চাপ আরও বাড়বে। হয়তো তখন ভারত ও চীনের পক্ষেও শর্তহীনভাবে তাঁর পাশে থাকা দুরূহ হবে।

গত চার-পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতা বলছে, সশস্ত্র বাহিনীর ক্ষমতা খর্ব করে সশস্ত্র সংগ্রামরত বিভিন্ন অঞ্চলকে যদি আরও প্রশাসনিক ক্ষমতা দেওয়া না হয়, তাহলে ওই সব অঞ্চলে চীন-ভারতের বিনিয়োগ নিরাপদ থাকছে না। বিশেষ করে আরাকানে ভারতের বহুল আলোচিত কালাদান বহুমুখী প্রকল্প ইতিমধ্যে আরাকান আর্মির কারণে স্থবির হয়ে আছে। আঞ্চলিক সরকার ও কেন্দ্রীয় বেসামরিক সরকারের আরও ক্ষমতায়ন চীন-ভারতের বাণিজ্যিক স্বার্থেই জরুরি। এরূপ পরিস্থিতিরই সুযোগ নিতে তৎপর এনএলডি।

পার্লামেন্টে সেনাসদস্য কমাতে চায় এনএলডি
মিয়ানমারজুড়ে জাতীয় দল হিসেবে এনএলডির প্রভাব এখনো একচ্ছত্র। তবে ২০২০ সালের নির্বাচনের জন্য প্রাক্তন ছাত্রনেতাদের অনেকগুলো দল নিবন্ধন চাইছে। এরা আগামী দিনে এনএলডির জন্য মাথাব্যথার কারণ হতে পারে। এদের মোকাবিলা করতে হলে সু চিকে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মূল আকাঙ্ক্ষার জায়গায় কিছু অর্জন করতেই হবে। ফলে, জেনারেলদের সঙ্গে তাঁর আসন্ন মোকাবিলা রাজনৈতিক অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থেও। সে ক্ষেত্রে হয়তো জেনারেলরা এবার সু চির প্রেসিডেন্ট হওয়ার পথ উন্মুক্ত করে দেবেন। কারণ, প্রেসিডেন্ট না হয়েও জনগণের ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত হয়ে ‘স্টেট কাউন্সিলর’ পরিচয়ে গত চার বছর সু চি দেশে-বিদেশে অবলীলায় সর্বোচ্চ নেতার মর্যাদা ফলাতে পেরেছেন। এটা তাঁর বড় এক সফলতা। সেনাবাহিনীর এ ক্ষেত্রে কৌশলগত পরাজয় ঘটে গেছে। ফলে, সংবিধানের ৫৯ (চ) ধারাটি উঠে যেতে পারে। এই ধারার মাধ্যমে বিদেশিকে বিয়ে করা এবং বিদেশে সন্তান থাকার কারণে সু চির প্রেসিডেন্ট হওয়ার পথ রুদ্ধ করেছিল সেনাবাহিনী। এবার তারা সেই অবস্থান পাল্টাতে পারে।

এ ক্ষেত্রে ছাড় সু চির জন্যও বড় নৈতিক বিজয় হবে। তবে মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক রূপান্তরের ক্ষেত্রে এটা মৌলিক কোনো পরিবর্তন আনবে না। সে ক্ষেত্রে সু চিকে আরও কিছু সংস্কার আদায় করতে হবে। সশস্ত্র বাহিনী কর্তৃক তিনজন মন্ত্রী নিয়োগের বর্তমান ব্যবস্থা খর্ব হয়ে অন্তত একটিতে নামিয়ে আনতে চান তিনি। বিশেষ করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্তৃত্ব পাওয়া যেকোনো সরকারের জন্যই অনিবার্য। আর পার্লামেন্টে সেনাবাহিনীর হিস্যা ২৫ ভাগ থেকে অন্তত ২০ ভাগে নামিয়ে আনার জন্যও এনএলডি লড়বে। কয়েক বছর পর এটা একেবারে তুলে দেওয়ার প্রস্তাবও আছে।

তবে চূড়ান্ত বিচারে সবকিছুই নির্ভর করবে বর্তমান ও অবসরপ্রাপ্ত জেনারেলরা পর্দার আড়ালে সু চির সঙ্গে কীরূপ দর-কষাকষিতে পৌঁছাতে পারছেন তার ওপর। উভয় পক্ষই বামার জাতিভুক্ত। শান, কাচিন, কারেনসহ অন্যান্য জাতিসত্তার ওপর আধিপত্য নিরঙ্কুশ রাখতে হলে কোনোরূপ আপসে যেতেই হবে বামারদের। তবে শিগগির পার্লামেন্টে সংশোধনী প্রস্তাবগুলো নিয়ে বিতর্ক শুরু হলেই কেবল বোঝা যাবে, সেনাবাহিনী কতটা ছাড়ের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত। এ লড়াইয়ে বিশ্ব আপাতত সু চির পাশেই থাকছে।

আলতাফ পারভেজ: দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ে গবেষক