ব্রিটেনের ট্রাম্প ও ব্রেক্সিট মন্ত্রিসভা

বরিস জনসন।
বরিস জনসন।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কথায় ব্রিটেনের ট্রাম্প সাহেব নতুন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন। অতি-উচ্চাকাঙ্ক্ষী হিসেবে পরিচিত আলেকজান্ডার বরিস ডি ফেফেল জনসনের তরুণ বয়সের স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। ব্রিটিশ ভোটারদের ০.৩ শতাংশেরও কমসংখ্যক ভোটে তিনি ব্রিটিশ আধুনিক ইতিহাসের সবচেয়ে জটিল সংকট সমাধানের অঙ্গীকার করে সরকার গঠন করেছেন। প্রতিদ্বন্দ্বীর চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ হলেও ক্ষমতাসীন দল কনজারভেটিভ পার্টির দুই-তৃতীয়াংশেরও কম সদস্যের ভোটে তিনি নির্বাচিত হয়েছেন।

ঈর্ষণীয় উদ্যম ও আকর্ষণক্ষমতার কারণে তিনি সমর্থকদের কাছে যেমন সমাদৃত, ঠিক তেমনই সমালোচকদের কাছে ভাঁড়ামো এবং বাকপটুতায় অসত্যকে সত্য হিসেবে প্রচারে অভ্যস্ত হিসেবে নিন্দিত। সত্যকে হেলায় অবহেলা এবং অসত্যতে বিকল্প সত্য (অল্টারনেটিভ ট্রুথ) প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে ব্রিটেনের ট্রাম্পের অভূতপূর্ব মিল আছে। মাথার ফোলানো চুল ছাড়াও তাঁদের উভয়ের মধ্যে আরও যেসব বিষয়ে মিল পাওয়া যায়, সেগুলোর মধ্যে আছে উগ্র জাতীয়তাবাদী চেতনাকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার, বর্ণবাদী আদর্শের প্রতি প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সমর্থন, ধনীদের প্রতি পক্ষপাতমূলক করনীতি, প্রতিষ্ঠিত বৈশ্বিক রীতিনীতি উপেক্ষা ইত্যাদি। তাঁদের মধ্যে আরও একটি বড় মিল হচ্ছে তাঁদের উভয়ের মধ্যেই বিব্রতকর ভুল করা বা বলার প্রবণতা প্রবল।

সুবিধাবাদিতার জন্যও বরিস জনসন সুখ্যাত। এই সুবিধাবাদিতার দুটো নজির এখানে তুলে ধরা যায়। লন্ডনের মেয়র থাকাকালে লন্ডনের বহুজাতিক সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের কারণে ভোটারদের আকৃষ্ট করতে তিনি অবৈধ অভিবাসীদের বৈধ হওয়ার সুযোগ দিতে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পক্ষে ছিলেন। কিন্তু, ব্রেক্সিট প্রশ্নে গণভোটের সময়ে তিনিই অভিবাসনবিরোধী অবস্থান নেন। ইউরোপীয় ইউনিয়নে তুরস্কের সম্ভাব্য অন্তর্ভুক্তি ছয় কোটি তুর্কি মুসলমানের অনুপ্রবেশের পথ খুলে দেবে বলে তিনি যুক্তি দেন। যদিও তুরস্কের সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সে রকম কোনো সমঝোতার সম্ভাবনা তখন ছিল না এবং এখনো নেই। মুসলমান নারীদের বোরকার বিরোধিতা করে তিনি তাঁদের ডাকবাক্স এবং ব্যাংক-ডাকাতদের সঙ্গে তুলনা করে ব্যাপকভাবে সমালোচিত হন। দলীয় নেতৃত্বের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতার লড়াইয়ে তাঁকে যখন দলের মধ্যেই মুসলিমবিদ্বেষের অভিযোগের মুখে পড়তে হয়, তখনই তিনি তাঁর প্রপিতামহের মুসলমান পরিচয় উল্লেখ করে আত্মরক্ষার চেষ্টা চালান।

এ রকম সুবিধাবাদিতার আরেকটি দৃষ্টান্ত হলো, ব্রেক্সিট প্রশ্নে তাঁর অবস্থান। যে ‘টেলিগ্রাফ’ পত্রিকায় তাঁর নিয়মিত কলাম প্রকাশিত হয়, তাঁদের জন্য গণভোটের আগে তিনি পক্ষে ও বিপক্ষে দুটো কলাম লিখে জমা দেন। কেননা, তখনো তিনি মনস্থির করে উঠতে পারেননি। ধারণা করা হয়, ব্রেক্সিটের বিপক্ষে তখন প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরন, লেবার পার্টির জেরেমি করবিন, লিবারেল ডেমোক্র্যাটদের নিক ক্লেগ প্রমুখ নেতার ভিড়ে তাঁর প্রথম সারিতে কোনো জায়গা ছিল না। কিন্তু, ব্রেক্সিটের পক্ষে উগ্র ডানপন্থী নাইজেল ফারাজ ছাড়া মূলধারার পার্টিগুলোর বড় কোনো নেতা না থাকায় তাঁর জন্য এক চমৎকার সুযোগ তৈরি হয়। তিনি তখন ব্রেক্সিটের পক্ষে কলামটি ছাপতে দেন এবং প্রচারে নেতৃত্ব দেন।

ইউরোপের সংবাদপত্রগুলো যে বরিস জনসনের প্রধানমন্ত্রিত্বকে স্বাগত জানাবে না, তা মোটামুটি প্রত্যাশিত। কিন্তু, যুক্তরাষ্ট্রের পত্রপত্রিকাও তাঁর এই সাফল্যে তাদের বিস্ময় চেপে রাখতে পারেনি। ‘নিউইয়র্ক টাইমস’ লিখেছে, মি জনসন, যাঁর আলসেমি এবং সুবিধাবাদিতা প্রবাদতুল্য, এমন একজন ব্যক্তি যিনি শঠতা চর্চায় পটুত্ব অর্জন করেছেন, তিনি সহজেই মানুষের কুসংস্কারে সুড়সুড়ি দিতে সক্ষম। তাঁর ব্যক্তিগত জীবন যেমন অসংযমী, সরকারি কাজের রেকর্ডও অসংগতিপূর্ণ।’ আর ‘দ্য নিউইয়র্কার’ এক ব্যঙ্গ রচনায় লিখেছে, ‘ব্রিটিশরা আমেরিকানদের বোকা বলার অধিকার হারাল।’

ইউরোপের পত্রিকাগুলোর শিরোনাম ছিল আরও নিষ্ঠুর। ফরাসি পত্রিকা ‘লিবারেসিও’র শিরোনাম ‘রানির ভাঁড়’। জার্মানির ‘ডার স্পিগেল’ প্রচ্ছদে তাঁর ছবি ছেপে শিরোনাম দিয়েছে ‘উন্মাদ‘ এবং বলেছে, আগামীকাল থেকেই শুরু হবে তাঁর অঙ্গীকার ভাঙা। ‘ফ্রাঙ্কফুর্টার অ্যালজেমিন-যেইটুং’-এর শিরোনাম ছিল, ‘যে ভাঁড় বিশ্বের রাজা হতে চেয়েছিল’। ‘আইরিশ টাইমস’ প্রশ্ন রেখেছে, ‘ব্রিটেন আর কতটা অধঃপতিত হবে?’

প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর ডাউনিং স্ট্রিটের ১০ নম্বর ভবনে ঢোকার আগেই তিনি ঘোষণা দিয়েছেন, কোনো যদি এবং কিন্তু নেই, ৩১ অক্টোবর ব্রিটেন ইউরোপের সঙ্গে বিচ্ছেদ কার্যকর করবে। ওই ঘোষণা বাস্তবায়নে তিনি যে কতটা কঠোর হবেন, তার একটা ধারণা দিতে তিনি মন্ত্রিসভায় যে রদবদল করেছেন তাকে বিবিসি বলছে রদবদল নয়, নতুন সরকার গঠন। আগের মন্ত্রিসভার পরিচিত ও গুরুত্বপূর্ণ ১৭ জনকে তিনি বাদ দিয়েছেন। মন্ত্রিসভার নতুন যে চেহারা, তাকে কট্টর ব্রেক্সিটপন্থী সরকার ছাড়া ভিন্ন কিছু বলার উপায় নেই। সরকার পরিচালনার মূল দায়িত্ব যাঁদের হাতে থাকছে, তাঁরা সবাই গণভোটে ইউরোপ থেকে বিচ্ছেদের পক্ষে প্রচারে নেতৃত্ব দিয়েছেন। কনজারভেটিভ পার্টির সাবেক এক মন্ত্রী, যিনি কিছুদিন আগে দল ছেড়ে স্বতন্ত্র হয়েছেন, সেই নিক বোলস বলছেন, ডানপন্থীরা দলটিকে দখলে নিয়েছে। কোনো বিশ্লেষকের ভাষায়, নতুন মন্ত্রিসভাকে কনজারভেটিভ পার্টির সরকার না বলে ব্রেক্সিট পার্টির সরকারও বলা চলে। তাঁদের মতে, নাইজেল ফারাজের ব্রেক্সিট পার্টির উত্থান ঠেকাতে কনজারভেটিভ পার্টির এই ডানপন্থী অংশটি তাদের দলের গতিপথকেই ঘুরিয়ে দিয়েছে।

বরিস জনসন ইউরোপের সঙ্গে দর-কষাকষি করে বিচ্ছেদ চুক্তিকে বদলানোর যে আশাবাদ ও প্রত্যয় প্রকাশ করেছেন, ইউরোপীয় নেতারা প্রায় তাৎক্ষণিকভাবেই সেই সম্ভাবনাকে নাকচ করে দিয়েছেন। ইউরোপের মুক্তবাণিজ্য এলাকার সুরক্ষা এবং আইরিশ শান্তি চুক্তির ধারাবাহিকতা ধরে রাখার প্রশ্নে এ দুটিতে কোনো ধরনের পরিবর্তনের সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। আইরিশ প্রধানমন্ত্রী বুধবার রাতেই তা স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছেন। এ রকম বাস্তবতায় প্রধানমন্ত্রী বরিসের সামনে দুটো পথ খোলা আছে— ১. কোনো চুক্তি ছাড়াই বিচ্ছেদ কার্যকর করা, যার পরিণতিতে বড় ধরনের বিশৃঙ্খলা এবং অর্থনৈতিক ক্ষতি মেনে নেওয়া; ২. রাজনৈতিক অঙ্গীকার প্রশ্নে ইউরোপের আশ্বাসে সন্তুষ্ট হয়ে বিচ্ছেদ চুক্তিকে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করা, যাকে ব্রেক্সিটপন্থীরা বিশ্বাসভঙ্গ হিসেবেই দেখবে। কনজারভেটিভ পার্টির ব্রেক্সিটপন্থীদের নেপথ্যচারী নেতা ইয়ান ডানকান স্মিথ বৃহস্পতিবার স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন, ইউরোপের সঙ্গে সমঝোতা না হলেও আইনগত অবস্থা দাঁড়াবে—বিচ্ছেদ কার্যকর হওয়া। নতুন কোনো আইন করা না হলে বিচ্ছেদই পরিণতি এবং তা ঠেকানোর জন্য পার্লামেন্টে নতুন আইন করার মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা কোনোভাবেই সম্ভব হবে না।

তবে, এ ধরনের সম্ভাব্য বিপর্যয় এড়াতে কনজারভেটিভ পার্টির মধ্যেই অনেকে সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা ভোটে ভোট দিতে পারেন বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন। সুতরাং, দ্রুতই আরেকটি সাধারণ নির্বাচনের সম্ভাবনা জোরদার হচ্ছে। অবশ্য, শুক্রবার থেকে অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত পার্লামেন্টের গ্রীষ্মকালীন অবকাশ থাকায় বরিস মন্ত্রিসভা আপাতত কিছুটা দম ফেলার সময় পাচ্ছে। তবে, অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহের পর খুব বেশি সময় থাকবে বলে মনে হয় না। সম্ভবত সে কারণেই ব্রিটিশ বাজিকরেরা প্রধানমন্ত্রী বরিসের মেয়াদ নিয়ে ইতিমধ্যেই বাজি ধরতে শুরু করেছেন। ইত্যবসরে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও তাঁর নতুন বিশ্বস্ত মিত্র বৈশ্বিক রাজনীতিকে আরও অস্থিরতার মুখে ঠেলে দিলে বিস্মিত হওয়ার কিছু থাকবে না।

কামাল আহমেদ: সাংবাদিক