হাজার কোটি টাকার উন্নয়নের এই সুফল

প্রথম আলো ফাইল ছবি।
প্রথম আলো ফাইল ছবি।

উন্নয়নের মহাযজ্ঞ চলছে চট্টগ্রামজুড়ে। ফ্লাইওভার হয়েছে, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে হচ্ছে, নগরবাসীকে চাহিদামতো সুপেয় পানি সরবরাহের তৎপরতা চলছে। সব মিলিয়ে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে হাজার হাজার কোটি টাকা। কিন্তু এর সুফল কতটা ভোগ করছে নগরবাসী? বর্ষা মৌসুমের মাত্র তিন-চার দিনের বৃষ্টিপাতেই যখন উন্নয়নের প্রলেপ মুছে গিয়ে এই শহরের উৎকট চেহারাটি বেরিয়ে আসে, তখন হতাশ ও বিস্মিত নাগরিকের মনে প্রশ্ন জাগে, এত ঢাকঢোল বাজিয়ে কাজের কাজটা তাহলে কী হলো?

বেশ কয়েক বছর ধরে জলাবদ্ধতা চট্টগ্রামের প্রধান সমস্যা হয়ে উঠেছে। চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ, আগ্রাবাদ, হালিশহর এলাকা নদীর জোয়ার-ভাটায় প্লাবিত হওয়া নিয়মিত ঘটনা। তার ওপর অতিবর্ষণে ডুবে যায় নগরের এক বিরাট অংশ। হাঁটুপানি থেকে কোমরপানি পর্যন্ত ডুবে যাওয়া শহরে স্থবির হয়ে পড়ে যান চলাচল। সাধারণ গৃহস্থালি থেকে ব্যবসা-বাণিজ্য, অফিস-আদালত থেকে হাসপাতাল পর্যন্ত সর্বত্র এই করুণ অবস্থার মধ্যে দিশেহারা এ অঞ্চলের মানুষ। আবার পানি নেমে যাওয়ার পর ভাঙাচোরা খানাখন্দে ভরা রাস্তাঘাট যেন ‘উন্নয়ন’ শব্দটিকেই ব্যঙ্গে পরিণত করেছে।

চট্টগ্রামের নাগরিক সেবা ও উন্নয়নকাজে নিয়োজিত সিটি করপোরেশন, উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ), পাউবো, ওয়াসাসহ বিভিন্ন সংস্থা নিজেদের মতো উন্নয়ন প্রকল্প মন্ত্রণালয়ে পেশ করে। একনেকে পাস হয়ে এসব প্রকল্পের জন্য অর্থ বরাদ্দ হয়। কিন্তু এসব প্রকল্প যে জনগণকে সুফল দিতে পারছে না, তার প্রধান কারণ এই সেবা সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতা। তা ছাড়া অনিয়ম ও অযোগ্যতার অভিযোগ তো আছেই।

২০১৭ সালে নগরের জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য ৫ হাজার ৬১৬ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল সিডিএকে। এ ধরনের কাজের অভিজ্ঞতা ইতিপূর্বে সিডিএর ছিল না। কিন্তু বরাদ্দ পেয়ে সিডিএর তৎকালীন চেয়ারম্যান বলেছিলেন, এক বছরের মধ্যেই নগরবাসীর দুর্ভোগ লাঘব হবে। তখন সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে এই প্রকল্পের নানা অসংগতির কথা উল্লেখ করা হয়েছিল। এ নিয়ে দুটি প্রতিষ্ঠানের দফায় দফায় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। নানা জটিলতার পর প্রকল্পের কাজ শুরু করতেই সময় পেরিয়ে যায় ৯ মাস। এখন ১৫ মাস পর খোদ প্রকল্প বাস্তবায়নকারীরাই যখন বলছে কাজের অগ্রগতি মাত্র ১৭ শতাংশ, তখন পরিকল্পনার দুর্বলতা ও অদূরদর্শিতার করুণ চিত্রটিই তো ফুটে ওঠে আমাদের সামনে।

এই প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা আগামী বছরের জুনের মধ্যে। সিডিএ আশা করছে, এটি পুনরায় রিভিউ করা হবে। বলা হচ্ছে, এবার শুধু ৩৬টি খাল খনন নয়, পুরো নগরের জলাবদ্ধতা নিয়ে নতুন নকশা তৈরি করে কাজ শুরু হবে। অর্থাৎ শেষ থেকে শুরু! স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, কয়েক হাজার কোটি টাকার একটি প্রকল্প পাস করার আগেই এসব বিষয়ে ভাবা হলো না কেন?

সিডিএর জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের ব্যর্থতার সূত্রে সিটি করপোরেশনের কার্যক্রম সম্পর্কেও কথা উঠবে। ১৯৯৫ সালের ড্রেনেজ মাস্টারপ্ল্যান এখন পর্যন্ত বাস্তবায়ন করতে পারেনি সিটি করপোরেশন। তিনটি নতুন খাল খননের কথা বলা হয়েছিল মাস্টারপ্ল্যানে। তার মধ্যে মনজুর আলম মেয়র থাকাকালে (২০১১) একটি খাল খননের প্রকল্প অনুমোদনও পেয়েছিল। কিন্তু এখনো যে তা বাস্তবায়ন হলো না, তার দায় কার? নগরের নালা-নর্দমাগুলো পরিষ্কার রেখে পানি যাওয়ার উপযোগী করে রাখার দায়িত্বও সিটি করপোরেশনের। নালা-নর্দমাগুলোর পাড় উঁচু করে এগুলোর সংস্কার করা হয়েছে, কিন্তু রাস্তায় হাঁটু বা কোমরপানি উঠলেও নালা-নর্দমাগুলো দিয়ে প্রবাহিত হলো না কেন, সেই প্রশ্নও তো উঠবে। সিডিএ মেগা প্রকল্পের বরাদ্দ পাওয়ার আগে বর্তমান মেয়র দুই বছর সময় পেয়েছিলেন। জলাবদ্ধতা নিরসনের ক্ষেত্রে তাঁরই বা কী উদ্যোগ ছিল?

চট্টগ্রাম শহরের রাস্তাঘাট নির্মাণ ও এর রক্ষণাবেক্ষণে গত ৯ বছরে ব্যয় হয়েছে দেড় হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ প্রতিবছরে গড়ে এই ব্যয়ের পরিমাণ প্রায় ১৬৭ কোটি টাকা। বর্তমান অর্থবছরে এই খাতে (২০১৮-১৯) সাড়ে চার শ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। কিন্তু অতিবর্ষণে নগরের রাস্তাঘাটের ছাল-চামড়াহীন চেহারা দেখে এই বিরাট অর্থ ব্যয়ের পক্ষে কী যুক্তি তুলে ধরবেন মেয়র? অতিবর্ষণে ক্ষতিগ্রস্ত সড়কের কারণে নগরবাসীর স্বাভাবিক চলাচলে ‘সাময়িক’ অসুবিধার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন মেয়র। ক্ষতিগ্রস্ত সড়কগুলোর মেরামতকাজ সম্পন্ন করার জন্য নগরবাসীর সহযোগিতাও চেয়েছেন তিনি। কিন্তু একটি সড়ক নির্মাণের পর কত বছরের মধ্যে তা ‘ক্ষতিগ্রস্ত’ হতে পারে, তার হিসাবটা দেবে কে? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিয়ম মেনে মানসম্পন্ন কাজ করলে একটি সড়ক অন্তত পাঁচ থেকে সাত বছর অক্ষত থাকার কথা। এখন বছর বছর শতকোটি টাকা ব্যয় করেও যদি দুর্ভোগের অবসান না হয়, তাহলে মেয়রের দুঃখ প্রকাশ নগরবাসীকে সান্ত্বনা জোগাবে না। বরং কাজের গুণমান নিয়ে তদারকি ও দক্ষতার অভাবের কথা উঠবে, অনিয়মের কথা উঠবে।

চট্টগ্রাম ওয়াসার দুটি প্রকল্পের কাজ চলছে এখন। রাস্তা মেরামতের অব্যবহিত পরেই ওয়াসার রাস্তা খনন পর্ব শুরু হয়ে যায়। এসব ক্ষেত্রে ওয়াসা যত যুক্তি ও সীমাবদ্ধতার কথাই তুলে ধরুক না কেন, এ প্রক্রিয়ায় মানুষের ভোগান্তিকে অস্বীকার করা যায় না কিছুতেই। দেখা যাচ্ছে, নাগরিক সেবা প্রদানকারী সংস্থাগুলো গণমাধ্যমের কাছে নিজেদের সীমাবদ্ধতা বা অসুবিধার কথা তুলে ধরে। আকারে-ইঙ্গিতে অনেক সময় পরস্পরকে দোষারোপও করে। তখনই প্রশ্ন আসে, এই শহরটার অভিভাবক আসলে কে? জবাবদিহির দায় কার?

জলাবদ্ধতা সমস্যা নিরসনের কথা বলতে গিয়ে মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন বলেছেন, পুরো শহর নিয়ে একটি সমন্বিত পরিকল্পনা করতে হবে। ভালো কথা। কিন্তু সমন্বয়টা করবে কে? সিটি করপোরেশনের মেয়র? সিডিএর চেয়ারম্যান? নাকি অন্য কোনো সংস্থার প্রধান? প্রয়াত মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরী একসময় ‘নগর সরকারের’ দাবি তুলেছিলেন। সে দাবি উপেক্ষিত হয়েছে। এখন এ বিষয়ে সরকারের কোনো নির্দেশনাও জানতে পারছি না আমরা।

সরকার হাজার কোটি টাকার বরাদ্দ দিচ্ছে বিভিন্ন সংস্থাকে। এসব সংস্থা উন্নয়ন কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে যে যার মতো। উন্নয়নের মহোৎসব চলছে নগরজুড়ে। কিন্তু সাধারণ মানুষ চলতি পথে হোঁচট খেয়ে পড়ছে, খাবি খাচ্ছে অতল জলের ঘূর্ণিতে।

বিশ্বজিৎ চৌধুরী: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক, কবি ও সাহিত্যিক
[email protected]