ডেঙ্গুর দিনগুলোতে মহারথীদের বচনামৃত

ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত ঢাকাবাসীর প্রাণ ওষ্ঠাগত। সব বয়সী মানুষ আক্রান্ত হলেও শিশুদের নিয়ে উদ্বেগ বেশি। সংকটাপন্ন শিশুদের নিয়ে এই হাসপাতাল, সেই হাসপাতাল ঘুরে আইসিইউতে সিট পাওয়া গেলেও শকে চলে যাওয়া অনেক শিশুই আর ফিরে আসছে না। ঢাকায় শিশুদের রীতিমতো পাহারা দিয়ে রাখতে হচ্ছে এডিস মশার হাত থেকে। দরজায় নেট, জানালায় নেট। এরপরও রক্ষা নেই। সারা দিনই মশারির ভেতরে অনেক শিশুকে রাখতে হচ্ছে বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমে দেখেছি। প্রথম আলোতে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুসারে, আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা সাড়ে তিন লাখ ছাড়িয়ে গেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও পরিস্থিতি উদ্বেগজনক বলে জানিয়েছে। একদিকে যখন আতঙ্কে ভুগছে নগরবাসী, অন্যদিকে ডেঙ্গু নিয়ে নানা হালকা, ওজনহীন, বর্ণবাদী কথা বলছেন সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা।

রীতিমতো প্রতিযোগিতা চলছে কে কাকে ছাড়িয়ে যাবেন। সকালে একজন কিছু একটা বললেন তো বিকেলে আরেকজন তাঁকে ছাড়িয়ে যাওয়ার দৌড়ে শামিল। কী নিয়ে কথা বলছেন, বিষয়ের গুরুত্ব কতটুকু, এসব বিবেচনায়ই নিচ্ছেন না বা বিবেচনা করার সক্ষমতাই হারিয়েছেন তাঁরা। ঢাকা সিটি করপোরেশন দক্ষিণের মেয়র সাঈদ খোকন ডেঙ্গু নিয়ে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কথা বলছেন। একবার বললেন, মশা অনেক শক্তিশালী। মশা মারার ওষুধে এই কারণেই কাজ হচ্ছে না। কখনো বলছেন রোগীরা চিকিৎসা নিতে হাসপাতালে যাচ্ছেন না। সর্বশেষ তিনি এক উদ্ভট কথা বললেন, ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা নিয়ে নাকি ছেলেধরার গুজবের মতোই গুজব ছড়ানো হচ্ছে। ছেলেধরার বিষয়টি প্রকৃতই গুজব। আর ডেঙ্গু কোনো গুজব না। এই দুইয়ের প্রভেদ করতে দক্ষিণের মেয়র পুরোপুরিই ব্যর্থ। হতে পারে নিজের ব্যর্থতাকে অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য তিনি এসব বলছেন। কিন্তু মেয়র যতই বিভিন্ন কথা বলে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করুন না কেন, বাস্তবতা ভিন্ন। প্রতিদিনই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংবাদে নগরবাসীর মধ্যে উদ্বেগ বাড়ছে। উপরন্তু দায়িত্বপ্রাপ্ত নগরপিতার মুখে এ বক্তব্য শুনে সবাই স্তম্ভিত।

ওদিকে আবার স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালিক আরও ভয়ংকর মন্তব্য করেছেন। ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশার প্রজনন নাকি রোহিঙ্গাদের মতোই। তিনি বোঝাতে চেয়েছেন, রোহিঙ্গাদের প্রজনন হার অনেক বেশি। এডিস মশাও রোহিঙ্গাদের মতোই বংশ বিস্তার করছে। কার্যত, তিনি বর্ণবাদী আচরণ করে ফেললেন। বর্ণবাদ কী, এ বিষয়ে সম্যক ধারণা থাকলেই একজন এ ধরনের মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকতে পারেন। মন্ত্রীর তা আছে কি না, আমি নিশ্চিত না। আরও আগে সাবেক নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান চালকদের লাইসেন্স অর্জনে শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে বলেছিলেন, রাস্তায় গরু–ছাগল চিনলেই চলবে। এতেই লাইসেন্স পাওয়া যাবে। ওই সময় সারা দেশেই সড়ক দুর্ঘটনায় ব্যাপক প্রাণহানির কারণে চালকদের যোগ্যতা নিয়ে বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠলে শাজাহান খান এই মন্তব্য করেন।

নাগরিকদের নিরাপত্তা, সুযোগ–সুবিধা নিয়ে রাজনীতিবিদদের হালকা মন্তব্য, বেফাঁস কথাবার্তা খুব সাম্প্রতিক না। আল্লাহর মাল আল্লাহ নিয়ে গিয়েছে বলে সামলোচনা উসকে দিয়েছিলেন বিএনপির নেতৃত্বাধীন চার–দলীয় জোট সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) আলতাফ হোসেন চৌধুরী। বাড্ডায় সন্ত্রাসীদের গোলাগুলিতে নিহত এক শিশুকে দেখতে গিয়ে তিনি এই মন্তব্য করেছিলেন। এর আগে–পড়ে তিনি আরও কিছু বলেছিলেন নিশ্চয়ই। কিন্তু ওই কথাটুকুই সবার মনোযোগ কেড়ে নেয়। কারণ, তিনি তখন এমন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন, যার কাজই দেশের মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। সাফল্য ব্যর্থতা নিক্তিতে মাপা কঠিন। কিন্তু দায়িত্ব পালনের একাগ্রতা ভিন্ন বিষয়। আর দায়িত্বশীল পদে যখন থাকেন রাজনীতিবিদেরা, তখন মুখের লাগাম টানার পদ্ধতি জানতে হয়। নতুবা আলোচনার খোরাক তৈরি করে তাঁদের বিভিন্ন বেসামাল কথাবার্তা।

ইদানীং বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতার কথা শুনে মনে হচ্ছে, তাঁরা খুবই বেসামাল অবস্থায় আছেন—তা যে দলেরই রাজনীতিবিদ হোন না কেন। হতে পারে গণমাধ্যমে নিজেদের উপস্থিতি নিশ্চিত করার জন্য উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবেই এসব কথা বলছেন। অথবা কী বলছেন, তা নিজেরাই বুঝতে পারছেন না।

বিশেষ করে, মেয়র ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী যা বলেছেন, তা কোনো দায়িত্বশীল মানুষের পক্ষে বলা সম্ভব না। এটা কোনো ঠাট্টা–তামাশার বিষয় না। ঢাকায় ডেঙ্গুর মহামারি চলছে বলে অনেকে দাবি করছেন। যদিও স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকে ডেঙ্গুর বিস্তারকে মহামারি হিসেবে ঘোষণা করা হয়নি। তবে মহামারি থেকে খুব ভালো অবস্থায়ও নেই। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল মশার ভয়ে নাকি অফিসেই যাচ্ছেন না। তিনি ডেঙ্গু জ্বরের ভুক্তভোগী। তিনি বিষয়টি ভালোভাবেই অনুধাবন করতে পেরেছেন।

প্রতিদিনই ঢাকার হাসপাতালে রোগীদের ভিড় বাড়ছে। ঢাকার বাইরেও আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে। ঢাকার বেসরকারি কয়েকটি হাসপাতাল ঘোষণা দিয়ে বলেছে, নতুন রোগী ভর্তি করা হবে না। সরকারি হাসপাতাল না করতে পারে না। সেখানে মেঝেতেই জায়গা মিলছে রোগীদের। ঢাকায় এখন ঠিক কতজন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে বা কতজন মারা গেছে, এর সঠিক তথ্য মিলছে না। কিছু কিছু গণমাধ্যম বলছে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কমিয়ে বলছে। আক্রান্ত ও মৃত্যু, দুটোর সংখ্যাই অনেক বেশি সরকারি হিসাব থেকে।

সব মিলিয়ে ঢাকার নাগরিকেরা ডেঙ্গু ভয় নিয়ে দিন যাপন করছেন। আর রাজনীতিবিদেরা নানা ধরনের লঘু মন্তব্য শুরু করেছেন। বিএনপির নেতা রিজভী আহমেদ বলেছেন, সরকার ডেঙ্গু দিয়ে মানুষ হত্যা করছে। রিজভী আহমেদ খুব ভালো ভালো কথা বলেন। তাঁর বক্তব্যে প্রায়ই নানা লেখক, জ্ঞানীগুণী ব্যক্তিদের উদ্ধৃতি থাকে। আমরা বুঝতে পারি, তাঁর জানার পরিধি অনেক বিস্তৃত। তাঁর কাব্যিক বক্তব্য অনেকের চিত্তাকর্ষণ করে, কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতিকে তুলে ধরে না বা পরিবর্তন করে না। সেটা কী ডেঙ্গু, কী রাজনীতি। রিজভী সাহেব বলতে পারেন, ‘আমরা তো ক্ষমতায় নেই। কী করতে পারি?’ ক্ষমতায় নেই ভালো কথা। কিন্তু গুরুতর পরিস্থিতি নিয়ে চটুল মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকতে পারেন। সব জায়গায় সরকারের হাত খোঁজা ঠিক না। যেখানে সরকারের হাত রয়েছে, তা নিয়ে মন্তব্য করুন।

নাগরিকদের সঙ্গে রাজনীতিবিদেরা কি নির্মম স্থূল রসিকতা করছেন? নাগরিকদের সঙ্গে এসব আচরণ অত্যন্ত গর্হিত ও জঘন্য। এ কারণেই রাজনীতিবিদদের সঙ্গে নাগরিকের দূরত্ব বাড়ছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী বুঝতে পারেননি তিনি বর্ণবাদী মন্তব্য করে ফেলেছেন। অন্য কোনো সভ্য দেশের মন্ত্রী হলে তিনি এতক্ষণে ক্ষমাপ্রার্থনা করে দায়িত্ব থেকে চলে যেতেন।

এর মূলে রয়েছে রাষ্ট্রকাঠামোয় স্বচ্ছতা, দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহির অভাব। তাই যা খুশি তা–ই বলছেন। একটি জবাবদিহি ও অংশগ্রহণমূলক রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন দেখেছিল আমাদের পূর্বপুরুষ ও নারীরা। সেই জন্যই ভাষা আন্দোলনে জীবনদান। ১৯৭১ সালে জীবন বাজি ধরে রণাঙ্গনে যাওয়া। একাত্তর সালে যুদ্ধে যাওয়া যুবকটি যখন বর্তমানে পেছন ফিরে হিসাব মিলাতে যান, দেখেন অনেক হিসাবই মেলে না। অনেক স্বপ্ন খোয়া গিয়েছে। রাজনীতিবিদদের হাত ধরেই সেই স্বপ্নের চুরি হওয়া। রাজনৈতিক ব্যক্তিরা তাই নাগরিক অধিকার নিয়ে নিয়ত ঠাট্টা–মশকরা করার সাহস পান। নাগরিকেরা রাজনীতিবিদদের অনুগত নন। বরং নাগরিকের প্রতি দায়িত্ব পালনের জন্যই রাজনীতিবিদেরা দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। আর উভয়েই রাষ্ট্রের প্রতি অনুগত থাকেন। তাই বালখিল্য আচরণ না করে বরং দায়িত্ব পালনে রাজনীতিবিদদের সচেষ্ট হওয়া উচিত। তবেই রাষ্ট্রের ভিত্তি মজবুত হবে।

ড. মারুফ মল্লিক: ভিজিটিং রিসার্চ ফেলো, ইনস্টিটিউট অব অরিয়েন্ট অ্যান্ড এশিয়ান স্টাডিজ, ইউনিভার্সিটি অব বন