ডিসি সম্মেলনের চাওয়া-পাওয়া

সম্প্রতি পাঁচ দিনব্যাপী সম্মেলন হয় জেলা প্রশাসক (ডিসি নামে যাঁরা পরিচিত) ও বিভাগীয় কমিশনারদের। এ সম্মেলনে বহুসংখ্যক দাবি ও প্রস্তাব নিয়ে এসেছিলেন তাঁরা। বহুলাংশে আলোচিত হয়েছে সেসব প্রস্তাব। এগুলোর প্রায়ই তাৎক্ষণিক সমাধান মেলে না। সরকারের নীতিনির্ধারকেরা জেনে রাখেন। কোনো কোনো প্রস্তাব খণ্ডন করে পাল্টা বক্তব্যও আসে সম্মেলনে। সব দিক মিলিয়ে অতীতের ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় সম্মেলনটি কিছুটা আলোড়ন সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। সমালোচিতও হয়েছে কিছু প্রস্তাব। আর এ ধরনের সমালোচনাই প্রকৃত সিদ্ধান্তের ক্ষেত্র তৈরি করে।

জেলা প্রশাসক পদবিটা কোনো কোনো মহলের অপছন্দের বিষয়। কিন্তু এতে তাঁদের কোনো হাত নেই। সরকার তাঁদের নিয়োগ দেয় জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট পদবিটি তাঁরা পেয়েছেন ফৌজদারি কার্যবিধি থেকে। এর আক্ষরিক অনুবাদ জেলা শাসক। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরায় এ নামেই পরিচিত হন তাঁরা। এতে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার কোনো বিচ্যুতি ঘটে, এমন অভিযোগ শুনিনি। এই কর্মকর্তাদের আবার ভূমি ব্যবস্থাপনা কাজে কালেক্টর বলে আইনি পরিচয় রয়েছে। সব আইন, সরকারের নির্দেশনা ইত্যাদি মিলিয়ে তাঁরা ফৌজদারি কার্যবিধির সংজ্ঞা অনুসারে জেলার নির্বাহী শাসনব্যবস্থার প্রধান কর্মকর্তা। তবে সাধারণত ডিসি হিসেবেই পরিচিত।

ডিসি সম্মেলনটির সাংগঠনিক দিক প্রথমে আলোচনায় আসবে। আগে সাধারণত তিন থেকে চার দিনের সম্মেলন হতো। প্রথাগতভাবে সরকারপ্রধান এর উদ্বোধন করেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের রীতিসিদ্ধ দিক ছাড়াও তিনি তাঁদের সঙ্গে একটি রুদ্ধদ্বার মতবিনিময় সভাও করে থাকেন। এবারও তা–ই হয়েছে। একই প্রথা অনুসারে তাঁরা রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেছেন। এ সৌজন্য সাক্ষাতের পরিসর বাড়িয়ে এবার স্পিকার ও প্রধান বিচারপতির সঙ্গেও সাক্ষাতের ব্যবস্থা হয়েছে। তাঁরা রাষ্ট্রীয় কাজে দেশের বাইরে থাকায় ভারপ্রাপ্ত স্পিকার ও ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি সে সাক্ষাৎ দিয়েছেন। এতে রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগের মাঠপর্যায়ের প্রধান কর্মকর্তাদের সঙ্গে আইন ও বিচার বিভাগের শীর্ষ পদাধিকারীদের কিছুটা মিথস্ক্রিয়ার সুযোগ হলো।

পাশাপাশি সামরিক বাহিনীর তিন প্রধান সম্মেলনের কার্য অধিবেশনে যোগ দিয়ে মতবিনিময় করেছেন। কোনো স্থানের আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা দ্রুত অবনতির ক্ষেত্রে ডিসিরাই সামরিক বাহিনী নিয়োগের সুপারিশ করেন। তা ছাড়া দুর্যোগ মোকাবিলাসহ অনেক কাজেই বেসামরিক প্রশাসনকে সামরিক বাহিনীর সহায়তা নিতে হয়। এসব বিবেচনায় এ কার্য অধিবেশনগুলোর আবশ্যকতাও উপেক্ষা করা যায় না। সুতরাং, সাংগঠনিক বিবেচনায় সম্মেলনটি ছিল তাত্পর্যপূর্ণ।

এবার থাকছে ডিসিদের বিভিন্ন প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এসব প্রস্তাব পাওয়ার পর কিছুটা বাছাইপ্রক্রিয়ায় গেলে ভালো হতো। বাদ দেওয়ার মতো কিছু বিষয়ও ছিল। ছিল কোনো কোনোটির ব্যাখ্যা–বিশ্লেষণ দেওয়া। সেভাবে কার্যপত্র তৈরি করে গণমাধ্যমকে দিলে নেতিবাচক সমালোচনা বেশ কিছু ক্ষেত্রে এড়ানো যেত। যেমন যখন সমগ্র ব্যাংক ব্যবস্থাই আজ বিভিন্ন কারণে নানামুখী চ্যালেঞ্জে আছে, তখন প্রশাসনের কর্মকর্তাদের জন্য একটি ব্যাংকের যৌক্তিকতা অনেকের কাছে বোধগম্য নয়। অবশ্য বিভিন্ন বাহিনী এর মধ্যেও তাদের জন্য ব্যাংক নিচ্ছে। এর দেখাদেখি প্রশাসনের ছোটার কোনো কারণ আছে বলে বোধগম্য হয় না। বরং বাংলাদেশে এখন ব্যাংকের সংখ্যা কমানোর দাবি আসছে।

গাড়ির জ্বালানি ব্যবহারের ওপর সীমারেখা তুলে দেওয়ার দাবিটিও বোধগম্য নয়। এ সীমারেখা তো ভ্রমণকারী কর্মকর্তাদের জন্য কখনোই প্রয়োগ করা হয়নি। ডিসিদের মাসে নিজ অধিক্ষেত্রে ন্যূনপক্ষে ১৫ দিন ভ্রমণ করতে হয়। মাসে অন্তত একবার যেতে হয় বিভাগীয় কমিশনারদের ডাকা সমন্বয় সভায়। শুধু ডিসি কেন, মাঠপর্যায়ে এ ধরনের কাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আছেন, এমন কেউ এ ধরনের সীমারেখা মেনে জ্বালানি ব্যবহার করতে পারবেন না। এতে অস্পষ্টতার জন্য কোনো ক্ষেত্রে অডিট আপত্তি থাকলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় বিষয়টি দেখতে পারে। অতীতে কখনো এ ধরনের কোনো সমস্যা হয়নি।

পৃথক পুলিশ বাহিনী গঠনের একটি প্রস্তাব যথেষ্ট ঔৎসুক্য তুলে ধরেছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যথার্থই বলেছেন, ডিসিদের নির্দেশেই পুলিশ পরিচালিত হয়। সুতরাং, এর প্রয়োজন নেই। তবে মেট্রোপলিটন পুলিশের ক্ষেত্রে এ বিধান কার্যকর নয়। তাই পৃথক পুলিশ বাহিনী না করলেও ডিসিদের বরাবর অন্তত ওই সব শহরে একটি বিশেষ ইউনিট ন্যস্ত করা প্রয়োজন। এমনটা দুদকের ক্ষেত্রে করা হয়েছে। এরূপ করা হলে ডিসিদের অধস্তন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের মোবাইল কোর্ট, উচ্ছেদ অভিযান চালানোসহ অনেক কাজ সহজতর হবে। একটি কেন্দ্রীভূত পুলিশ বাহিনী দিয়ে গোটা দেশ চালানোর বিষয়টিও নতুনভাবে ভাবনার ক্ষেত্র তৈরি করেছে। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা যায়, ১৮৬৬ সাল থেকেই কলকাতা পুলিশ পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের সরাসরি অধীনে কাজ করছে।

ক্ষমতার আওতা প্রসারের একটি প্রবণতা আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্রে বরাবরই লক্ষ করা যায়। এমনই একটি প্রস্তাব এসেছিল পিআইওদের এসিআর ইউএনওদের হাতে দেওয়ার জন্য। বিষয়টি অপ্রয়োজনীয় বিবেচনায় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ প্রাথমিক বাছাইয়ে বাদ দিতে পারত। কেননা, ত্রাণ ও পুনর্বাসন–সংক্রান্ত সব কাজ উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কর্তৃত্বে পরিচালিত হয়। পিআইও তাঁদের সহায়তা করেন মাত্র। সুতরাং, স্বভাবতই এই কর্মকর্তা ইউএনওদের অনুগতই থাকেন।

তবে দুদকের কার্যাবলি তদারকের ক্ষমতা ডিসিরা চেয়েছিলেন বলে জানা যায় না। এ সম্মেলনে ভাষণ দিতে গিয়ে দুদক চেয়ারম্যানের বক্তব্যে অস্পষ্টতার সুযোগ নিয়েছে একটি মহল। স্থানীয়ভাবে দুদক কর্মকর্তাদের কার্যক্রম ডিসিদের আওতাভুক্ত হতে পারে না। দুদককে আমরা স্বাধীন সংস্থা হিসেবে চাই। কোনো দুদক কর্মকর্তা দুর্নীতি বা অনৈতিক কোনো কাজে সংশ্লিষ্ট বলে ডিসি নির্ভরযোগ্য সূত্রে তথ্য পেলে তাঁর সহজাত ক্ষমতাবলে দুদক চেয়ারম্যানকে একটি গোপনীয় পত্রের মাধ্যমে জানিয়ে দিতে পারেন।

অন্যদিকে ‘সরল বিশ্বাসে’ কৃত অপরাধ সম্পর্কে দুদক চেয়ারম্যানের মন্তব্যও অকারণ বিতর্ক সামনে আনল। দণ্ডবিধির এ বিধানটি স্পষ্ট। আর বিচারের ক্ষমতা আদালতের। এ সম্মেলনে এটা নিয়ে আলোচনা নিষ্প্রয়োজন ছিল। মোবাইল কোর্ট নিয়েও অনেক কথা হয়েছে। প্রথম আলোর এক সজ্জন সাংবাদিক বন্ধু তাঁর নিবন্ধে আমার কিছু বক্তব্যও সঠিকভাবেই উদ্ধৃত করেছেন। তবে সময়ান্তরে কিছু অতিরিক্ত বক্তব্য সংযোজন প্রয়োজন। অপরাধী বলে কথিত ব্যক্তিদের একটি অংশ হাল আমলে ‘বন্দুকযুদ্ধ’ বা ‘ক্রসফায়ারে’ নিহত হন। কেউবা হয়ে যান গুম। এগুলো হত্যা বলে কেউ স্বীকার করেন না। এক–দুটি বিষয় নিয়ে ব্যাপক তদন্ত করলে প্রকৃত রহস্য বেরিয়ে আসবে।

মোটামুটি আমরা দেখতে পাচ্ছি, এটি একটি সমান্তরাল বিচারপ্রক্রিয়া হিসেবে চালু হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও একশ্রেণির লোক এর জোরদার সমর্থক। এটা না থেমে ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। পক্ষান্তরে, এর ফলে অপরাধ কমছে, এমন দাবিও করা যাচ্ছে না। এ ধরনের ‘বন্দুকযুদ্ধ’ বা ‘ক্রসফায়ারের’ চেয়ে কি মোবাইল কোর্টকে অধিকতর মন্দ বলা যাবে? সে আদেশের বিরুদ্ধে তো বিভিন্ন স্তরে আপিল আছে। আর অর্থদণ্ড আরোপের ক্ষমতা তো পুলিশসহ অনেক সংস্থারই রয়েছে। এমনকি ট্রেনের টিকিট চেকারদেরও। সেগুলোকে অবশ্যই আধা বিচারিক কার্যক্রম বলতে হবে।

এ–জাতীয় সম্মেলনে কিছুটা ঝড় তোলা অস্বাভাবিক নয়। বার্ষিক পুলিশ সপ্তাহেও অনেকটা তা–ই দেখা যায়। থাকে অনেক দাবির বহর। সরকার সবকিছু মেনে নিতে পারে না। আর আন্তবিভাগীয় সম্পর্ক অনেক স্পর্শকাতর। আলোচনা ও সমাধানও জটিল। তবে হাল আমলের রাষ্ট্রব্যবস্থায় কর্তৃত্বের চেয়ে নেতৃত্ব অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থান নিয়েছে। জেলায় কর্মরত অন্য সহকর্মীদের প্রতি আইনানুগ সহযোগিতা দ্রুত দিয়ে ডিসিরা তাঁদের কাছে নিজেদের উপযোগিতা তুলে ধরতে পারেন। মেধা ও দক্ষতার জোরে তাঁরা অন্যদের মধ্যে করতে পারেন নিজেদের প্রতিষ্ঠিত। আইনি কর্তৃত্বও অনেক আছে। এটা যত কম ব্যবহার করা যায়, ততই প্রশংসিত হবেন তাঁরা।

আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব
[email protected]