উত্তরবঙ্গ কাঁদছে, 'কেউ নেই তেমাথায়'

টানা বৃষ্টি ও উজান থেকে আসা পাহাড়ি ঢলে উত্তরাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির আবার অবনতি ঘটেছে
টানা বৃষ্টি ও উজান থেকে আসা পাহাড়ি ঢলে উত্তরাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির আবার অবনতি ঘটেছে

মানুষ ছুটছে। জেলা বোর্ডের সড়ক সবচেয়ে উঁচু। প্রথমে সবাই সেখানে আশ্রয়ের আশায় গিয়েছিলেন। সেই সড়কে এখন কোমরপানি। ঘরে চাল আছে, কিন্তু রাঁধবেন কোথায়? নলকূপ আছে, তা পানির তলায়। বাড়িঘর ছেড়ে উলিপুর-কুড়িগ্রামের দিকে উঁচু জায়গার সন্ধানে ছুটছে মানুষ। 

কুড়িগ্রাম কলেজ মোড়ে দাঁড়ালেই বুঝবেন, গাড়ি গাড়ি ভেজা কাপড়ের মানুষেরা কারা। ১০-১২ দিন ধরে এ অবস্থা চলেছে। যেন যুদ্ধাবস্থা!

সাত দিন আগে এ অবস্থা ছিল। এখন প্রধান সড়কগুলো থেকে পানি নেমে গেছে। রাস্তা ভেঙে স্থানে স্থানে গভীর গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। বালাবাড়ি থেকে রমনা রেলস্টেশনের মাঝামাঝি স্থানে রেললাইন ভেঙে গভীর গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। সম্প্রতি চিলমারী-ঢাকা আন্তনগর ট্রেন চালুর ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। তাও অনিশ্চিত হয়ে গেল।

চিলমারীর পুরোনো জোড়গাছ বাজার থেকে দক্ষিণে মনতলা, রাঘব এলাকার দুই কিলোমিটারের মধ্যে থাকা ৪০০ বাড়ি ব্রহ্মপুত্রের গ্রাসে চলে গেছে। সবজির খেত ডুবে গেছে। মানুষ তো শুধু ভাত খায় না। ২০ টাকার মরিচ এখন ১৫০ টাকা, ১০ টাকার বেগুন ৫০ টাকা, ৫ টাকার পেঁপে ৩৫ টাকা—একই অবস্থা সর্বত্র। অবলা গরু-ছাগলের দুর্দশার শেষ নেই। গরু-ছাগল-হাঁস-মুরগি কেনার লোক নেই। হাসপাতাল নিজেই পানির তলায়। মোবাইল নেটওয়ার্কও নেই। ফেসবুকও বন্ধ। আমরা দেখি ফেসবুকের চোখে, তাই ভয়াবহতম এই বন্যাটিও ‘নাই’ হয়ে গেল! তাই এলাকাটি দুর্গত এলাকার ‘যোগ্য’ হয়নি।

একটি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে কুড়িগ্রামে বন্যাদুর্গত এলাকায় পানিবাহিত রোগ ছড়ানোর বর্ণনা এসেছে। সেখানে আড়াই বছরের সন্তানের অসুস্থতার মধ্যে নিজের অসহায়ত্ব প্রকাশ করে মুন্নি আক্তার নামের এক নারী বলেছেন, ‘চাইর পাকে (পাশে) পানি, খাওয়াদাওয়ার কষ্ট। ইয়ার মধ্যে ছাওয়াটার তিন দিন থাকি পাতলা পায়খানা। খালি স্যালাইন খোয়য়া থুছি। পানিত ডাক্তারও ডাকপার পাই না, চিকিৎসা করি কেমন করি।’

শুধু মুন্নি না, কুড়িগ্রামে পানিবন্দী ৮৯৪টি গ্রামের অনেকের বাড়িতেই এখন পানিবাহিত রোগ ছড়িয়ে পড়েছে। বিশুদ্ধ পানি, খাবার ও চিকিৎসকের সংকটেও ভুগছেন তাঁরা। যদিও কুড়িগ্রাম সিভিল সার্জন আমিনুল ইসলামের দাবি, জেলায় ৮৫টি মেডিকেল টিম কাজ করছে এবং কোথাও কোনো চিকিৎসাসংকট নেই। আশ্রয়ের অভাবে নৌকায় গরু-ছাগল নিয়ে অনেকে সংসার পেতেছেন।

২০ জুলাইয়ের প্রথম আলোর যথার্থ শিরোনাম ছিল, ‘পানি আসছে কম, ডুবছে বেশি’। ’৮৮–র বন্যায়ও যেসব এলাকা জেগে ছিল, এবার তাও গেছে। ব্রহ্মপুত্রে পানি কিঞ্চিৎ কমলেও কাইম এলাকায় পানি বাড়ছেই। সব রাস্তাঘাট তলিয়ে গেলেও নদ–নদীর উচ্চতা সমান না হওয়া পর্যন্ত পানি বাড়তেই থাকে। কিন্তু নদ–নদীতে যত দ্রুত পানি কমে, কাইমে কমে না। কারণ, জলাবদ্ধতা।

জলাবদ্ধতা মানে নতুন নতুন বালাই। পানি চলাচলের মুখ দখল হয়েছে মার্কেট ও মাছের ঘেরের নামে। ফলে আবাদি জমির দামও কমে এসেছে। আবাদ না হলে দাম হয় কীভাবে? সমস্যার আরেক নাম তাই জলাবদ্ধতা।

২.

মুক্তিযুদ্ধে শহরকে ঠাঁই দিয়েছে গ্রাম। এই দুর্দিনে গ্রাম শহরে আসছে। কিন্তু শহরের আছে নানা ইস্যু। গ্রামের বেদনা শহরের বুকে বাজে না। পলাশীর পর থেকে বাংলায় বছর বছর মন্বন্তর লেগেই থাকত। ইউরোপীয় গণহত্যার এদেশীয় সংস্করণ ছিল মন্বন্তর। মন্বন্তরে কোম্পানির খাজনাপ্রাপ্তি কমত না। খাজনা আদায়কারীদের ফুর্তির কমতি ছিল না। নায়েব-গোমস্তাদের দায় ছিল না। বর্তমানের নায়েব-গোমস্তাদেরও কোনো দায় নেই। ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ থেকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত গ্রামের মানুষ যে দেশ বানালেন, এই তার প্রতিদান? এ কোন শিক্ষিত সমাজ, যাঁদের মোবাইল স্ক্রিনে ডুবন্ত মানুষের বদলে ট্রাম্প আর মোদি ঠাঁই পায়! দেশের বেদনায় যাঁদের হৃদয় জাগে না! রাষ্ট্র নেই, মিডিয়া নেই, জনগণও যদি জনগণের বেদনায় না জাগে, তাহলে আশা কোথায়?

গ্রামদেশ পানিতে কিন্তু জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা থেমে নেই। ইতিমধ্যে কুড়িগ্রামের ১৫ জনসহ মোট ৫৭ জন মারা গেছে। অথচ কুড়িগ্রামের কলেজগুলোতে পরীক্ষা চলছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কি অন্ধ? কিন্তু অন্ধ হলে কি বন্যা বন্ধ থাকে! এমনকি ২২ জুলাই স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ১৫টি বন্যাদুর্গত জেলার তালিকা ঘোষণা করে, সেখানেও কুড়িগ্রামের নাম ছিল না। পরদিন কুড়িগ্রামের নাম যুক্ত হয়। এখন পর্যন্ত কিছু ত্রাণ তৎপরতা থাকলেও জেলাজুড়ে
পুনর্বাসন কার্যক্রম নেই। এই যে জাতীয় উদাসীনতা, তার ফল কি ভালো হবে? জনগণের নিজস্ব উদ্যোগ প্রস্তুত হতে তো সময় লাগে। স্থানীয় মন্ত্রীসহ কয়েকটি সংগঠন ত্রাণ তৎপরতা চালাচ্ছে। গণকমিটি ঢাকায় ‘কনসার্ট ফর কুড়িগ্রাম’ আয়োজন করে দেশবাসীর মনোযোগ কাড়ার চেষ্টা করছে। চিলমারী-রৌমারী-সদর উপজেলার ঘোগাদহে খাদ্য ও চিকিৎসা সহায়তা কেন্দ্র খুলবে, তার জন্য অর্থ সহায়তা সংগ্রহ করতে তো সময় লাগবে, দেশবাসী নিশ্চয়ই এগিয়ে আসবেন, কিন্তু তত দিনে...।

কুড়িগ্রাম দারিদ্র্যের শীর্ষে অবস্থানকারী জেলা। এই সংকট কীভাবে মোকাবিলা করবে? গত দুই দিনে আবার এক হাত পানি বেড়ে গেছে। জনমনে শঙ্কা জেগেছে ফের। এই পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে কি না, এটা রাষ্ট্রের তরফে অবহিত করা উচিত। যদি পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকে, তাহলে স্বেচ্ছাসেবক, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও রাষ্ট্র প্রস্তুত থাকতে পারবে। রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর ভাষায়, ‘কেউ নেই তেমাথায়/ শুধু এক ব্যথিত কুকুর কাঁদে।’

নাহিদ হাসান: রেল-নৌ, যোগাযোগ ও পরিবেশ উন্নয়ন গণকমিটির কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সভাপতি
[email protected]