যুক্তরাষ্ট্রের চীন নীতি ব্যাখ্যা করা উচিত

প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন যুক্তরাষ্ট্রের বিদেশনীতিতে যেসব পরিবর্তন এনেছে, তার মধ্যে একটি হচ্ছে চীনের প্রতি সংঘাতমূলক অবস্থান গ্রহণ করা। এক দশকের পুরোনো নীতি বদলে ফেলার পেছনের কারণ শুধু বিশ্বের দুই বৃহত্তম অর্থনীতির মধ্যে অর্থনৈতিক ঠান্ডা যুদ্ধের ফল নয়। দক্ষিণ চীন সাগরে এবং তাইওয়ান প্রণালিতে সশস্ত্র সংঘাতও এর পেছনে কারণ হিসেবে কাজ করেছে।

প্রেসিডেন্সির প্রথম বছরেই ট্রাম্প চীনকে একটি কৌশলগত ‘প্রতিযোগী’ এবং ‘শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী’ বলে অভিহিত করেছেন। তবে কেবল ট্রাম্প নন, মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থা ও কংগ্রেসের শীর্ষস্থানীয় রিপাবলিকান সদস্যরা এবং কিছু ডেমোক্র্যাটের মতে, চীন বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের প্রাধান্য এবং স্বার্থের সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদি হুমকি।

গত দুই বছরে যুক্তরাষ্ট্র-চীন সম্পর্কের দ্রুত অবনতির প্রাথমিক কারণ হচ্ছে ভূরাজনীতি। তবে ট্রাম্পের বাণিজ্যযুদ্ধকেও অবশ্য এই প্রসঙ্গে দেখতে হবে। চীন থেকে আমদানি করা পণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের চড়া শুল্ক আরোপ হয়তো চীনের দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক সম্ভাব্যতাকে হ্রাস করার জন্য, তবে অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য হচ্ছে কৌশলগত প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে চীনকে দুর্বল করে দেওয়া।

ট্রাম্প এই যুক্তি দেখাচ্ছেন যে মার্কিন ব্যবসা-বাণিজ্যের বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদের সুরক্ষা এবং দুই দেশের মধ্যে বিশাল দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যিক ভারসাম্যহীনতা সংশোধন করার জন্যই তিনি চীনের প্রতি তাঁর বিদেশনীতি পরিবর্তন করেছেন, তবে প্রকৃত ঘটনাটি অবশ্যই পরিষ্কার হতে হবে। চীনের ওপর এই শুল্ক আরোপ মার্কিন অর্থনীতির গুরুতর ক্ষতি করতে পারে। কারণ, চার দশক ধরে দেশ দুটি একটি খোলামেলা অর্থনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল।

যুক্তরাষ্ট্রের চীন নীতির এই পরিবর্তনে চীন বিষয়ে মার্কিন বিশেষজ্ঞরা এবং সাবেক নীতিনির্ধারকেরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। তাঁদের প্রায় ১০০ জন একটি খোলা চিঠিতে সম্প্রতি চীনকে ‘শত্রু’ হিসেবে গণ্য না করার জন্য ট্রাম্পের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে রিপাবলিকান, ডেমোক্র্যাটস এবং চীনের নীতি ও আচরণের সমালোচকেরাও রয়েছেন।

তবে মার্কিন সাধারণ জনগণের বেশির ভাগই বোধ হয় চীনকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবেই দেখে। গবেষণা প্রতিষ্ঠান পিউ রিসার্চ সেন্টারের সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে (২০১৮ সালের আগস্টে পরিচালিত), মাত্র ৩৮ শতাংশ মার্কিনের চীনের প্রতি অনুকূল মনোভাব রয়েছে এবং ৪৭ শতাংশ মার্কিনের মনোভাব প্রতিকূল। কিন্তু মাত্র ২৯ শতাংশ উত্তরদাতা চীনের সামরিক শক্তিকে উদ্বেগের কারণ বলে উল্লেখ করেছেন। একটি বৃহত্তর অংশ, ৫৮ শতাংশ চীনের অর্থনৈতিক দক্ষতা সম্পর্কে চিন্তিত। জরিপের এই ফলাফলে এটা বোঝা যায়, বেশির ভাগ আমেরিকানের চোখে চীনের সঙ্গে সম্পর্কের প্রাথমিক উদ্দেশ্য হওয়া উচিত তাদের জীবিকা রক্ষা করা, ভূরাজনৈতিক সংঘাত শুরু করার জন্য নয়।

এই ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, যা ট্রাম্প প্রশাসন নিখুঁতভাবে শুরু করেছে, তা সম্ভবত অনেক মার্কিনের জীবন ও জীবিকার ওপর আঘাত হানবে। এতে বোঝা যায়, জনগণের মতামত ছাড়াই এবং কোনো ধরনের বিতর্ক ছাড়াই যুক্তরাষ্ট্রের চীন নীতি পরিবর্তিত হয়েছে।

এ ধরনের বিতর্ক জরুরিভাবে প্রয়োজন। যদিও বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে পত্রিকার পাতায় এটাই প্রধান সংবাদ হিসেবে ছাপা হচ্ছে, কিন্তু বেশির ভাগ মার্কিন নাগরিক চীনের প্রতি মার্কিন নীতি রূপান্তরের সীমা সম্পর্কে অবগত নন, যা তাঁদের দেশকে অন্তহীন দ্বন্দ্বের দিকে ঠেলে দেবে এবং খুব শিগগির চীন বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতি হিসেবে আবির্ভূত হবে।

একটি গণতান্ত্রিক দেশে, সরকার ওয়াকিবহাল জনসাধারণের কাছ থেকে টেকসই রাজনৈতিক সমর্থন ছাড়া শক্তিশালী ভূরাজনৈতিক প্রতিপক্ষের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি সংগ্রাম চালিয়ে যেতে পারে না।

চীনের প্রতি নীতি পরিবর্তনের ব্যাপারে কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর ট্রাম্প প্রশাসনকে দিতে হবে। প্রথম প্রশ্নটি হচ্ছে, চীনের প্রতি এই নীতি পরিবর্তনের মূল উদ্দেশ্য কী? ট্রাম্প প্রশাসনকে এরপর উত্তর দিতে হবে, কীভাবে তারা এই উদ্দেশ্য অর্জন করবে।

ট্রাম্পকে লেখা খোলা চিঠির লেখকেরা বলেছেন, বিশ্ব অর্থনীতি থেকে চীনকে বিচ্ছিন্ন করার মার্কিন চেষ্টা যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক ভূমিকা ও খ্যাতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে এবং বিশ্বের সব দেশের অর্থনৈতিক স্বার্থকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। তাঁরা প্রশ্ন তুলেছেন, অন্য দেশগুলো এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের ঐতিহ্যবাহী মিত্ররা কি এই চেষ্টাকে সমর্থন করবে? নাকি যুক্তরাষ্ট্র এ ব্যাপারে একাই এগিয়ে যেতে চায়?

খোলা চিঠির স্বাক্ষরকারীরা এবং সেই সঙ্গে বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ, রাজনীতিবিদ ও চিন্তাবিদেরা চীন সম্পর্কে তাঁদের সমষ্টিগত দৃষ্টিভঙ্গির একটি ওয়াকিবহাল ও চিন্তাশীল বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন। ট্রাম্প প্রশাসনকে অবশ্যই চীন নীতির ব্যাপারে তাঁর নিজের দৃষ্টিভঙ্গি ও লক্ষ্য জনগণের কাছে উপস্থাপন করতে হবে।

ইংরেজি থেকে অনূদিত। স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট

মিনসিন পেই : চীন প্রজাতন্ত্রের সুশাসন বিষয়ে একজন বিশেষজ্ঞ