নাগরিক সমাজের নীরবতা জাতির সঙ্গে বেইমানি

গীতি আরা নাসরীন
গীতি আরা নাসরীন
>

ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনিতে মানুষ মারা যাচ্ছে। নারী-শিশু ধর্ষণ ও হত্যা থামছে না। শিক্ষাঙ্গনে চলছে অস্থিরতা। সব মিলিয়ে মানুষের মধ্যে প্রচণ্ড নিরাপত্তাহীনতা তৈরি হলেও রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে প্রতিকার পাওয়া যাচ্ছে না। এসব নিয়ে কথা বলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক গীতি আরা নাসরীন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সোহরাব হাসান

প্রথম আলো: নিছক গুজব ছড়িয়ে ছেলেধরা সন্দেহে একের পর এক মানুষ হত্যা করা হচ্ছে, বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?

গীতি আরা নাসরীন: ছেলেধরা সন্দেহে হত্যা আমাদের চারপাশে নির্বিচারে যে হত্যা-সন্ত্রাস চলছে, তারই আরেকটি দিক। দেশে নির্বিচারে হত্যার ঘটনা কিন্তু ঘটেই চলেছে। ধর্ষণের পর হত্যা, ব্যবসায়িক কারণে হত্যা, রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণে হত্যা, ব্লগার হত্যা ইত্যাদি। বাদানুবাদের মতো ব্যক্তিগত রোষ থেকেও একজন আরেকজনকে মেরে ফেলছে। সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষ মারা যাচ্ছে। নিরাপদ সড়ক আন্দোলন বন্ধ করা হয়েছে, কিন্তু দুর্ঘটনায় মৃত্যু বন্ধ হয়নি। এখন ট্রেন দুর্ঘটনাও মানুষের জীবন কেড়ে নিচ্ছে। তার মানে, হত্যা এবং অপঘাতে মৃত্যু জনজীবনে রীতিমতো ‘স্বাভাবিক’ হয়ে উঠছে।

প্রথম আলো: তাহলে মানুষের নিরাপত্তা কোথায়?

গীতি আরা নাসরীন: নিরাপত্তা তো নেই। আমরা একটি আতঙ্কিত জনপদে বাস করি। মানুষ বিপদে পড়লে তাকে বাঁচানোর কেউ নেই। উদ্দেশ্যমূলকভাবে হত্যা বা নির্যাতন যেমন হচ্ছে, তেমন কেউ কেউ দুর্বলের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে আক্রোশ দেখাচ্ছে। বাড্ডার তাসলিমার পরে ও আগে গণপিটুনির নামে আরও কয়েকজনকে হত্যা করা হয়েছে। এই আইনহীনতার প্রতিকার হতে পারে তো শুধু মানুষকে নিরাপদ জীবন ফিরিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে। জনজীবন সুরক্ষা আইন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে।

প্রথম আলো: মানুষ একদিকে আইন নিজের হাতে তুলে নিচ্ছে, অন্যদিকে বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনাও ঘটছে। 

গীতি আরা নাসরীন: নির্বিচার হত্যা ও বিচারবহির্ভূত হত্যা—দু-দুটি ক্ষেত্রেই কিন্তু উপস্থিত আছে ‘হত্যা’ আর অনুপস্থিত আছে ‘বিচার’। কাজেই দুই ধরনের হত্যাই একটা আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করে। যার মূল কারণ হচ্ছে ১. অস্বাভাবিক মৃত্যুর ক্ষেত্রে যথাযথ বিচারহীনতা এবং ২. অস্বাভাবিক মৃত্যু হলে তার বিচার হবে, এই বিষয়ে আস্থাহীনতা। এই অনিরাপত্তাবোধ সর্বগ্রাসী আতঙ্ক তৈরি করে। সাধারণ মানুষ মনে করে, তাকে নিরাপত্তা দেওয়ার কেউ নেই।

প্রথম আলো: কেন এই অবস্থার সৃষ্টি হলো?

গীতি আরা নাসরীন: এ রকম অবস্থা তৈরি হতে পারে যখন রাষ্ট্র মানুষের কল্যাণার্থে কাজ না করে বিশেষ শ্রেণি কিংবা স্বার্থগোষ্ঠীর সুবিধার জন্য পরিচালিত হয় এবং জনগণের কাছে জবাবদিহি না থাকে। অনেক বিপর্যয়ের মুহূর্তেও আমরা দেখতে পাই, প্রশাসন বা সরকারের বিভিন্ন দায়িত্বে আছেন এমন ব্যক্তিরা অসংবেদনশীল বা দায়িত্বহীন মন্তব্য করছেন। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, প্রধানমন্ত্রীর দিকনির্দেশনার জন্য অপেক্ষা করতে। এমনকি গুজব প্রতিহত করতেও তাঁকে নির্দেশ দিতে হয়েছে। অথচ দেখুন, আমাদের এতগুলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। গণমাধ্যম রয়েছে। থানা পর্যায় পর্যন্ত সরকারি অফিস রয়েছে, কিন্তু দেখা যাচ্ছে, বিপর্যয়ের মুখে ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্টে কোনো সম্মিলিত কৌশল নেওয়া হচ্ছে না। ফলে সমাজের মধ্যে যে ভালো উদ্যোগগুলো ছিল, তা আমরা ক্রমাগত ক্ষয়ে যেতে দেখছি।

প্রথম আলো: শিক্ষাঙ্গন কিংবা শিক্ষাঙ্গনের বাইরে—সবখানে নিরাপত্তাহীনতা কাজ করছে। একজন শিক্ষাবিদ হিসেবে আপনার মন্তব্য কী?

গীতি আরা নাসরীন: শিক্ষাঙ্গন তো আসলে বৃহত্তর সমাজের অংশ। বিশ্ববিদ্যালয় বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশের জায়গা; সেখানে মুক্ত পরিবেশে মুক্তচিন্তার চর্চা হবে, সেটাই প্রত্যাশিত ছিল। কিন্তু জ্ঞানচর্চা কিংবা ক্ষমতায়নের বদলে আমরা এখন পদ-পদবি লাভের ও ক্ষমতা বিস্তারের চর্চাই বেশি দেখতে পাই। অনেক শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে প্রথমেই একটি নিশ্চিত পড়ার পরিবেশ পাওয়ার বদলে জবরদস্তির মধ্যে পড়ে। হলের একটি জায়গার জন্য তাকে বিশেষ সংগঠনের মিছিলে-সমাবেশে যেতে বাধ্য করা হয়। গণতন্ত্রের  অনুশীলনের বদলে সে দেখে ‘জোর যার মুলুক তার’। ফলে একধরনের মাস্তানির সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে।

শিক্ষকদের এখন আর রোল মডেল ভাবা হয় না। যেসব শিক্ষক গবেষণা করেন, শিক্ষাদানকে জীবনের ব্রত হিসেবে নেন, তাঁরা পুরস্কৃত না হয়ে তিরস্কৃত হন। জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট গবেষণার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক আ ব ম ফারুককে মন্ত্রণালয় থেকে হুমকি পর্যন্ত দেওয়া হয়েছে। কতিপয় অনিয়মিত শিক্ষার্থীর পরীক্ষা না নেওয়ায় চট্টগ্রামে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক মাসুদ মাহমুদের গায়ে কেরোসিন ঢেলে দেওয়া হয়েছে।

প্রথম আলো: ফেনীতে নুসরাত জাহানকে আগুনে পুড়িয়ে মারা হলো। বরগুনায় নয়ন বন্ড বাহিনীর হাতে নিহত হলেন রিফাত শরীফ নামের এক তরুণ। দুটো ঘটনার পেছনেই ক্ষমতার রাজনীতি। আবার বরগুনার ঘটনায় আয়শা সিদ্দিকা নামের এক নারীকে সামনে নিয়ে আসা হয়েছে। 

গীতি আরা নাসরীন: সাধারণ মানুষের অধিকার যেখানে সুরক্ষিত নয়, সেখানে নারী ও অবস্থানগতভাবে দুর্বল মানুষ আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হয়ে ওঠে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ একই সঙ্গে নারী নির্যাতনমূলক সমাজও বটে। নারীর ওপর যখন আক্রমণ হয় তখনো দেখা যায়, দোষ নারীর ওপরই চাপানো হয়। ফেনীর ঘটনায় নুসরাত যৌন নিপীড়নের প্রতিবাদ করেছিলেন ও বিচার চেয়েছিলেন। তাঁকেই আগুনে পুড়িয়ে শাস্তি দেওয়া হয়েছে।

তদন্তে দেখা যাচ্ছে, ঘটনায় শুধু মাদ্রাসার অধ্যক্ষই জড়িত নন, স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী আরও অনেকে জড়িত। বরগুনার ঘটনায় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, নয়ন বন্ড ও সঙ্গীরা প্রকাশ্যে রিফাতকে কুপিয়ে হত্যা করেছে। তাঁর স্ত্রী আয়শা তাদের নিবৃত্ত করতে চেষ্টা করেছেন। কিন্তু এখন নয়ন বন্ডকে ক্রসফায়ারে দিয়ে সহযোগীদের রক্ষা করতে মেয়েটিকে দোষী সাব্যস্ত করার চেষ্টা চলছে। এমনকি অনলাইনে পর্নোগ্রাফি ছবি থেকে বানানো একটি ভিডিও পর্যন্ত ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। কারা এই ভিডিও ছেড়েছে, কেন মেয়েটির পক্ষে একজন আইনজীবী দাঁড়ালেন না? নারীর প্রতি সমাজ যে কত বৈরী আচরণ করতে পারে, বরগুনার ঘটনা তার প্রমাণ।

প্রথম আলো: নারী ও শিশু ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা মহামারি আকারে রূপ নিলেও কোনো প্রতিকার দেখছি না।

গীতি আরা নাসরীন: যতই খারাপ লাগুক শুনতে, আমাদের মেনে নিতে হবে, আমরা একটি ধর্ষণের সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করেছি। ধর্ষণ সামাজিকভাবে অনুমোদিত এবং নির্যাতিতকে অভিযুক্ত করলে ধর্ষণ বৈধতা পায়। সামাজিক মাধ্যমে, ওয়াজে নারীর প্রতি ঘৃণামূলক মনোভাবের প্রকাশ অহরহ হয়। পর্নোগ্রাফি, বিজ্ঞাপন, সিনেমা ইত্যাদি আরও অনেক মাধ্যমে নারীকে শুধু যৌনবস্তু হিসেবেই উপস্থাপন করা হয়। এই প্রবণতা ধর্ষণকামিতাকে বাড়িয়ে দেয়। সর্বোপরি ধর্ষণের বিচার ও শাস্তি না হওয়া, ধর্ষণের শিকারকেই অভিযুক্ত করা—এসবই ধর্ষণের মহামারি হয়ে ওঠার কারণ। বিভিন্ন গবেষক ধর্ষণকে একটি নিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়া হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন। এই সহিংস আচরণ দখলদারি এবং ক্ষমতা প্রকাশের জন্য ব্যবহার করা হয়।

প্রথম আলো: রাষ্ট্র যখন এসব অনাচার বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারছে না, তখন তো নাগরিক সমাজকেই এগিয়ে আসতে হয়। অতীতে এসেছে।

গীতি আরা নাসরীন: সাধারণ মানুষ বা যাঁদের কণ্ঠস্বর নিষ্পেষিত, তাঁরা নিজের অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে ব্যস্ত। এ ছাড়া নানা নিবর্তনমূলক আইন এবং হয়রানির কারণে অনেক সময় মানুষ প্রতিবাদ করার সাহস হারিয়ে ফেলে। কিন্তু যাঁরা সমাজের সুবিধাজনক অবস্থায় আছেন, যাঁদের কথা বলার সুযোগ আছে, তাঁদের তো অবশ্যই এগিয়ে আসতে হবে। সেটি না করলে তা হবে দেশ ও মানুষের প্রতি বেইমানি।

প্রথম আলো: তাহলে কি আশা রাখার কোনো জায়গা নেই?

গীতি আরা নাসরীন: মানুষ অত্যন্ত দুরূহ অবস্থা পাড়ি দিতে পারে, যদি তার মধ্যে স্বপ্ন থাকে; সুন্দর ভবিষ্যতের আকাঙ্ক্ষা থাকে। একাত্তরে মানুষের সেই স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষা ছিল বলেই তারা একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে জয়ী হয়েছিল। কিন্তু মানুষের সেই আশা যে ধূলিসাৎ হয়েছে, তার প্রমাণ হলো তরুণদের দেশ ছেড়ে চলে যাওয়া বা যেতে চাওয়া।

আমাদের এমন দুর্ভাগ্য যে দেশ থেকে এখন মানুষ চলে যেতে চায়। আমি তাঁদের কথা বলছি না, যাঁরা আরাম-আয়েশের জন্য বিদেশে সেকেন্ড হোম বানিয়েছেন। কিন্তু মাটি কামড়ে কিছু করার স্বপ্ন দেখেছিলেন যাঁরা, তাঁদেরও অনেকে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন। এরপরও যেতরুণেরা স্বপ্ন দেখছেন, পরিবর্তনের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন, তাঁরাই আমাদের আশা।

প্রথম আলো: যা ভাবেন, চিন্তা করেন, বলতে পারেন কি?

গীতি আরা নাসরীন: সব সময় নয়। একধরনের সেলফ-সেন্সরশিপ কাজ করে। কাকে কী বলব, কীভাবে তার অর্থ করা হবে, কী ধরনের প্রতিক্রিয়া আসবে, সেটি ভাবতে হয়। আমরা একটা ভয়, আতঙ্ক ও অবিশ্বাসের সময়ে বাস করছি। আমার মনে হয় না যাঁরা এ দেশ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তাঁরা কখনো এ রকম পরিবেশের কথা ভেবেছিলেন।

প্রথম আলো: আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

গীতি আরা নাসরীন: ধন্যবাদ।