বাবা-মা স্মরণে

আজ ২৮ জুলাই মা ও বাবাকে স্মরণ করছি অনেক বেশি। কারণ দুজনেরই জন্মদিন একই দিনে, আজকে। ব্যাপারটার মধ্যে আশ্চর্য মিল খুঁজে পাওয়া যায়।

মা-বাবা আর আমরা তিন ভাই। এই ছিল আমাদের পরিবার। কলকাতার অ্যান্থনি বাগান লেন, এরপর টালিগঞ্জের বাসার কথা অনেকটাই মনে পড়ে। বাবার গভীর রাতে ঘরে ফেরা ছিল নিয়মমাফিক। মা পরিপক্ব শিল্পী হয়েও আমাদের তিন ভাইয়ের পরিচর্যা, রান্নাবান্নার কাজে সদা ব্যস্ত। একটু সময় পেলেই মা হারমোনিয়াম নিয়ে প্র্যাকটিস করতে বসে যেতেন।

অ্যান্থনি বাগান লেনের বাসাতেই বাবার কাছে অঙ্ক শেখা। উঠোনের ইটগুলোর ওপরে পা রেখে রেখেই সংখ্যা গণনা। আমাদের টালিগঞ্জের বাসায় দুষ্টুমি বাড়তে থাকে। পটকা ফোটানো, ঘুড়ি ওড়ানো। তত দিনে স্কুলে ভর্তি হয়ে গেছি ওখানে।

বাবাকে নিয়ে সপরিবার ঢাকায় আসার সিদ্ধান্ত নিলেন মা। ১৯৬৭ সালের আগস্ট মাসের বৃষ্টিভেজা এক দিনে মা আর আমরা তিন ভাই হাওড়া স্টেশন থেকে রওনা দিলাম। বর্ডার পার হয়ে রাজশাহীতে ঢুকলাম। মামা আসাফউদ্দৌলা তখন রাজশাহীর ডিসি। অল্প কয় দিন রাজশাহীতে থেকে ঢাকায় এলাম।

নর্থ সার্কুলার রোড, হাতিরপুল, ভূতের গলি—ওই এলাকাতেই প্রথম থাকা হয়। কয় দিন পরেই বাবা আসেন ঢাকায় ওই বাসায়। কোনো এক বিকেলে, হঠাৎ বাবার আগমনে অনেক আনন্দ বয়ে গেছে বাসায়। পরে বাসা বদল হয়েছে।

মা খুব দ্রুত সময়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন ঢাকার সংগীতজগতে। বাবা নিজেকে ব্যস্ত রাখতে জেনারেল স্টোর খুললেন হাতিরপুলে। নাম ‘পথিকার’।

মা শত ব্যস্ততার মধ্যে আমাদের সবার পাসপোর্ট করালেন। ঢাকা তখন পূর্ব পাকিস্তানের অংশ। তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের হিন্দুবিদ্বেষের প্রভাব পড়ল বাবার ওপর। অ্যাফিডেভিট করে নাম পরিবর্তন করে পাসপোর্ট নিতে হলো কামালউদ্দিন আহমেদ নামে। আমরা ভর্তি হতে পারলাম স্কুলে।

এল ভয়াল ১৯৭১-এর মার্চ মাস। ‘জয় বাংলা, বাংলার জয়’ গানটা রেকর্ডিং শেষ করেই মা ২৪ মার্চের সর্বশেষ ফ্লাইটে করাচি থেকে ঢাকা চলে এলেন। না হলে হয়তো আসাই হতো না বহু মাস। পরিবারের একজন কমল দাশগুপ্ত আর একজন ‘জয় বাংলা’ গান রেকর্ড করেছেন মাত্র। তাই পালিয়ে বেড়াতে হলো এক বাসা থেকে আরেক বাসা, এক এলাকা থেকে আরেক এলাকা। কিছুদিন পরপরই খাকি পোশাকের দেখা মেলে গেটের ওপারে। তারা গেটে চকের দাগ দিয়ে যায়। আমরা পালিয়ে যাই সেখান থেকে। এরপর ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধ শেষে আমরা পেলাম মুক্তি।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর বাবাকে দায়িত্ব দেওয়া হলো বাংলাদেশ বেতার ট্রান্সক্রিপশন সার্ভিসের চিফ মিউজিক ডিরেক্টরের পদে। দেশের সব উল্লেখযোগ্য গানের যন্ত্রসংগীত রেকর্ড করে, স্বরলিপি করে আর্কাইভ করে রাখার দায়িত্ব তাঁর। মনে আছে, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানটার রেকর্ডিংয়ের সময় ওই দিন আমি উপস্থিত ছিলাম ট্রান্সক্রিপশন সার্ভিসে।

বাবা কমল দাশগুপ্ত ও মা ফিরোজা বেগম
বাবা কমল দাশগুপ্ত ও মা ফিরোজা বেগম

মা ক্রমে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন কলকাতার ডাকে। পশ্চিমবঙ্গের ছোট-বড় সব শহরে নজরুলসংগীত আর বাবার সুরের পুরোনো আধুনিক গান নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ তোলপাড় করে তুলেছেন। এক মাসের মধ্যে চার-পাঁচবার যেতে দেখেছি একক অনুষ্ঠান করতে। কয়েকবার সঙ্গেও গিয়েছি। কলামন্দির আর রবীন্দ্রসদনে উপচে পড়া ভিড় দেখেছি। ভক্তদের মায়ের পায়ে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করতে দেখেছি।

১৯৭৪ সাল। তখন গুলশানে থাকি তৎকালীন সরকারের দেওয়া এক বাসভবনে। বাবার ভয়ানক রকম নিউমোনিয়া হলো। লাঙসে পানি। ভর্তি করা হলো তদানীন্তন পিজি হাসপাতালে। বাবা কমল দাশগুপ্ত মারা গেলেন ভর্তির কয়েক দিন পরেই (২০ জুলাই)। দাফন করা হলো বনানী কবরস্থানে।

মা একাই আমাদের তিন ভাইয়ের হাল ধরলেন একদিকে, অপর দিকে তাঁর ব্যস্ততা বাড়তেই থাকল, বিশেষ করে দেশের বাইরের অনুষ্ঠান নিয়ে।

মনে মনে এটাও সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে ছেলেদের দেশের বাইরে পাঠিয়ে লেখাপড়া করাবেন। নিজের সঞ্চিত অর্থ দিয়ে প্রথমে বড় ভাই তাহসিনকে পাঠালেন যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টনে। নর্থ-ইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএ কোর্স। আমাকে পাঠালেন লন্ডনে। লন্ডন ইন্টারন্যাশনাল কলেজে বিএসসি কম্পিউটার সায়েন্স কোর্স পড়তে। মেজ ভাই হামিন রয়ে গেল মায়ের সঙ্গে ঢাকায়।

মা ফিরোজা বেগম সংগীতের স্কুল দিয়েছিলেন ধানমন্ডির বাসায়। যে বাসায় পরবর্তী সময়ে কবি কাজী নজরুল ইসলামকে রাখা হয়েছিল সরকারি তত্ত্বাবধানে। স্কুলটির নাম ছিল ‘কলগীতি’। অল্প সময়েই খুব ব্যস্ত হয়ে উঠেছিল স্কুলটি ছাত্রছাত্রীদের ভিড়ে। আমি সেখানে গিটার শেখাতাম।

এভাবে বহু বছর পার হয়ে গেল। মা নিজের স্বাস্থ্যের দিকে নজর দিতে সময়ই পাননি। কিছু কিছু সমস্যা দেখা দিতে শুরু করল। কঠিন মনের জোর নিয়ে চালিয়ে গেলেন কাজ। আমি দেশে ফিরলাম ১৯৯১ সালে। মায়ের অপূর্ব রান্নার স্বাদ পেলাম আবার, কত যত্ন নিয়ে আমাদের ও পরিবারের সবাইকে ডেকে খাওয়াতেন প্রায়ই।

একের পর এক শারীরিক অসুস্থতা ক্রমে বাড়তে থাকল। শেষে ২০১৪ সালের ১২ সেপ্টেম্বর মা ফিরোজা বেগম শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন।

শাফিন আহমেদ: সংগীতশিল্পী