বিরাট এক শূন্যতার সামনে দাঁড়িয়ে মানুষ

ভ্লাদিমির পুতিন, নরেন্দ্র মোদি ও ডোনাল্ড ট্রাম্প
ভ্লাদিমির পুতিন, নরেন্দ্র মোদি ও ডোনাল্ড ট্রাম্প

মানুষের ইতিহাসে রক্ষণশীলতা ও উদারবাদ হাতে হাত ধরে চলেছে সব সময়। পুরোনোকে আঁকড়ে ধরতে রক্ষণশীলদের নানা আয়োজন ভাঙতেই জন্ম হয়েছে উদারবাদিতার। আবার এই উদারবাদীদের মোকাবিলা করতে গিয়ে নিজেকে নানা সময়ে নবায়ন করেছে রক্ষণশীলরাও। একটা সময় এ দুই ধারাকে বেশ স্পষ্টভাবে চেনা যেত। সংকট হলো পুঁজিবাদের উত্থানের পর। বিপরীতে সমাজতন্ত্রকে দাঁড় করিয়ে পুঁজি কাঠামো নিজের মধ্যেই রক্ষণশীল ও উদারবাদের দুটি কেন্দ্র তৈরি করল। সমাজতন্ত্রকে ‘ভয়াবহ’ হিসেবে চিত্রিত করে এ দুই ধারার একটি আরেকটিকে টিকিয়ে যেমন রেখেছে, তেমনি দ্বৈরথের মধ্য দিয়ে ইতিহাসের বিভিন্ন বাঁকে পরস্পরের আবেদন বৃদ্ধিতেও কাজ করেছে। কিন্তু এখন এ দুটি ধারার কেন্দ্রই রয়েছে সংকটে। এককথায় দুটি ধারাই নানা প্রতিক্রিয়ার মধ্য দিয়ে কট্টর হয়ে উঠছে।

সারা বিশ্বেই ডানপন্থী উদারবাদ সংকটে রয়েছে অনেক দিন। দেশে দেশে কট্টর রাজনীতিই বিস্তার পাচ্ছে। সাদাচোখে একে রক্ষণশীলতার উত্থান বলে মনে হলেও, তা আদতে এক নতুন ধারা, যা লোকরঞ্জনবাদের হাত ধরে বিস্তার ঘটাচ্ছে নিজের। বিশ্বের বহু নেতা খোলাখুলি উদারবাদের বিপরীতে নিজের অবস্থান তুলে ধরছেন। এর মধ্যে অবধারিতভাবে সামনের সারিতে রয়েছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। পুতিন তো সেই কবেই উদারবাদকে ‘সেকেলে’ বলে আখ্যা দিয়ে রেখেছেন। তাঁর দৃষ্টিতে এটি এই যুগে অচল। ফিন্যান্সিয়াল টাইমসকে তিনি বলেছেন, অভিবাসন, বহুসংস্কৃতিবাদ ও লৈঙ্গিক প্রশ্নে যে উদারবাদের কথা বলা হয়, তা হাস্যকর।

মজার বিষয় হচ্ছে, ভ্লাদিমির পুতিনের বক্তব্যে উদারবাদকেই শুধু হুমকির মুখে বলে মনে হলেও একই কথা কিন্তু প্রযোজ্য রক্ষণশীলতার ক্ষেত্রেও। অন্তত পশ্চিমা বিশ্বে রক্ষণশীলতাই সবচেয়ে বেশি হুমকিতে রয়েছে বললে অত্যুক্তি হবে না। বিশেষত যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের মতো দ্বিদলীয় রাজনীতির দেশে এটি খুব স্পষ্টভাবে দেখা দিতে শুরু করেছে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের কথাই ধরা যাক, তাঁর ক্ষমতায় আসা নিয়ে সবচেয়ে বেশি ভাবনায় পড়েছিল কিন্তু তাঁরই দলের রক্ষণশীল অংশটি। কারণ রক্ষণশীল যে মূল্যবোধ, তার সঙ্গে ট্রাম্পের অবস্থান ছিল সাংঘর্ষিক। ব্রিটেনে যে বরিস জনসন এখন সামনে চলে এসেছেন, তাঁর অবস্থানও কিন্তু একই রকম। ফ্রান্স বা ইতালির মতো বহুদলীয় রাজনীতি যেসব দেশে রয়েছে, সেখানেও ডানপন্থার রক্ষণশীল কেন্দ্রটি অসুখে ভুগছে অনেক দিন হলো। পশ্চিমের দেশগুলোয় ডানপন্থা রক্ষণশীলতাকে পাশ কাটিয়ে সরাসরি লোকরঞ্জনবাদিতাকেই আলিঙ্গন করছে। ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্টের বিশ্লেষণ অন্তত সে কথাই বলছে।

কথা হচ্ছে রক্ষণশীলতা কী? অচেনা যেকোনো কিছুর প্রতি অনাসক্তি শুধু নয়, বিকর্ষণই মূলত রক্ষণশীলতা। ফলে রক্ষণশীলেরা শঙ্কা থেকে দূরে থাকতে সম্ভাবনাহীনতাতেই স্বস্তিবোধ করে বেশি। পরীক্ষিত সম্পর্কের প্রতিই তাদের আস্থা। একই সঙ্গে অচেনা অজানার সঙ্গে সংযোগে থাকে একধরনের নির্লিপ্ততা। বর্তমানে উদারবাদ বলে যাকে চিহ্নিত করা হয়, তার মতোই রক্ষণশীলতাও সেই রেনেসাঁ থেকেই চলতে শুরু করেছে হাতে হাত ধরে। উদারবাদ যখন মুক্ত পৃথিবীর কথা বলেছে, রক্ষণশীলতা তখন তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে। প্রথাকে টিকিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করেছে সে। এই বঙ্গীয় রেনেসাঁতেই এই দ্বৈরথের প্রমাণ পাওয়া যাবে ভূরি ভূরি। বামপন্থী প্রগতির চাকায় চড়ে কখনো কখনো ডানপন্থী উদারবাদ এগিয়ে গেছে। আবার বৈরিতাও ছিল এবং আছে। কিন্তু রক্ষণশীলতা বরাবরই নিজের অবস্থান এ দুইয়ের বিপরীতে স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করেছে। এই দ্বন্দ্বের ফলকে ভিত্তি হিসেবে নিয়েই আজকের দুনিয়ার সব রাষ্ট্র দাঁড়িয়ে আছে। এই বাংলাদেশেও প্রতিনিয়ত এই দ্বন্দ্ব ক্রিয়াশীল থেকেছে। একাংশ পরিবর্তনকে স্বাগত জানিয়েছে, পরিবর্তনের চেষ্টা করেছে, অন্য পক্ষ সর্বশক্তি দিয়ে পরিবর্তনের পথকে রুদ্ধ করতে চেয়েছে। কিন্তু এখন এই দ্বৈরথে এক মৌলিক পরিবর্তনের আভাস দেখা যাচ্ছে, যা রোধে বা সঠিক পথ দেখাতে কোনো পক্ষই ঠিক কাজ করছে না।

বর্তমান বৈশ্বিক রাজনীতির প্রেক্ষাপটে বলা হয় যে, সারা বিশ্বে কট্টরবাদ বাড়ছে। পুঁজিকে অক্ষুণ্ন রেখে বাজার, অভিবাসন থেকে শুরু করে লৈঙ্গিক প্রশ্নে–নামে উদার বা রক্ষণশীল যা-ই হোক না কেন, কট্টরপন্থা বাড়ছেই। এ ক্ষেত্রে লোকরঞ্জনবাদেরই জয়জয়কার দেখা যাচ্ছে। ইকোনমিস্ট বলছে, বর্তমান ডানপন্থা সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হিসেবে নিয়েছে লোকরঞ্জনবাদিতাকে, যেখানে রক্ষণশীলতার বদলে প্রতিক্রিয়াশীলতাই মূল প্রবণতা। মানুষের হতাশাই তাদের মূল পুঁজি।

রক্ষণশীলতার অন্যতম লক্ষণ হচ্ছে চেনা পথে প্রয়োগবাদী প্রবণতা দিয়ে সমস্যার সমাধান করা। এ ক্ষেত্রে অচেনাকে আলিঙ্গন না করলেও তারা সমস্যাকে এড়িয়ে যায় না। কিন্তু এখন ডানপন্থার যে দশা হয়েছে, তাতে সমস্যাকে এড়িয়ে যাওয়াই মূল প্রবণতা হয়ে উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্রের দিকে তাকালে দেখা যাবে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে, যিনি যেকোনো সমস্যা ও রূঢ় সত্যকে তাঁর ভাবমূর্তি খর্বের ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখেন। তাঁর দৃষ্টিতে নাগরিকের যেকোনো দাবিই আদতে তাঁকে হটানোর পাঁয়তারা। এই একই প্রবণতা কি বাংলাদেশেও হাজির নেই? আছে। ডেঙ্গুর প্রকোপের তথ্যকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন দেখছেন, ‘আরেকটি গুজব’ হিসেবে। শুধু দেখছেনই না, তিনি এটি বলছেনও। এতে কিন্তু ডেঙ্গুতে মারা যাওয়া মানুষের মুখগুলো চাপা পড়ছে না। আবার এর বিপরীতে বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলছেন, ‘এডিস মশার বিস্তার ঘটাচ্ছে সরকার।’ দুটি বক্তব্যের কোনোটিই কিন্তু সমাধানের পথ দেখাচ্ছে না। একটিতে রয়েছে সমস্যার অস্বীকার, আরেকটিতে রয়েছে সমস্যাকেই হাতিয়ার বানানোর প্রবণতা।

রক্ষণশীলতা বরাবরই পরিবর্তনকে সংশয়ের দৃষ্টিতে শুধু নয় শঙ্কার দৃষ্টিতে দেখেছে। কিন্তু এখন কী উদার কী রক্ষণশীল ডানপন্থা ‘পরিবর্তনময়’। পরিবর্তনের হুজুগ তুলেই তারা ক্ষমতায় আসছে এবং টিকে থাকছে। ভারতে নরেন্দ্র মোদি, যুক্তরাষ্ট্রের ডোনাল্ড ট্রাম্প কিংবা এমন যার কথাই বলা হোক না কেন, তাদের উত্থানের কেন্দ্রে ছিল পরিবর্তনের স্লোগান। বাংলাদেশ এক দশকের বেশি সময় ধরে যে রাজনীতি দেখছে, তাও কিন্তু পরিবর্তনের নামেই। সবগুলো ক্ষেত্রেই ডানপন্থা পরিবর্তনকে হাতিয়ারে পরিণত করেছে। অবশ্য বিশ্বজুড়ে এই ডানপন্থী পরিবর্তনের জিগির আদতে মুখেই। পুঁজিকে নিরাপদ করতেই কিছু উপরভাসা পরিবর্তনের কথা এসব ক্ষেত্রে উচ্চারিত হয়। ব্যতিক্রমহীনভাবেই এ ক্ষেত্রে দুর্নীতিবিরোধী অবস্থান থাকে সবার সামনে।

রক্ষণশীলতা এখন ব্যক্তির ওপর সওয়ার হতে চাইছে। আর কে না জানে ব্যক্তির ওপর সওয়ার হলে তা কোনো মতবাদের বিজয় আর থাকে না। এ ধরনের বিজয় কট্টরপন্থাকেই নিরাপদ রাস্তা করে দেয়। ব্রাজিল, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, তুরস্ক, ফিলিপাইন, ভারত থেকে শুরু করে বাংলাদেশে পর্যন্ত এটিই এখন সবচেয়ে বড় সত্য হিসেবে সামনে হাজির হয়েছে। এতে আইনের শাসন বলে আর কিছু থাকছে না। একধরনের উগ্র জাতীয়তাবাদ ছড়াচ্ছে চারদিকে। পশ্চিমা দেশগুলোয় এর উত্থান ঘটছে অভিবাসন বিরোধিতার হাত ধরে। দক্ষিণ এশিয়ায় দেখা দিচ্ছে পুরোনো অসুখ—ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ। যেখানে যার হাত ধরেই এর উত্থান হোক না কেন, এই উগ্র জাতীয়তাবাদ বৈষম্যের সমাজের দিকেই নিয়ে যাচ্ছে বিশ্বকে, যেখানে এখনই অর্থনৈতিক অসাম্য রয়েছে চূড়ান্ত অবস্থায়। ফলে নিপীড়িতকে সরে যেতে হচ্ছে আরও প্রান্তে।

উদার ও রক্ষণশীল কেন্দ্র দুইয়েরই এই ক্ষয়ের মুহূর্তে অন্য কেউ দাঁড়াচ্ছে না। একটি যখন কট্টর হয়ে উঠছে, তখন অন্যটি আরও কট্টর অবস্থান দিয়ে তার মোকাবিলা করতে চাইছে। ফলে দিন শেষে কট্টরবাদই সম্প্রসারণের জ্বালানিটি পাচ্ছে। দুটিই ছুটছে লোকরঞ্জনবাদী পথে। আর লোকরঞ্জনবাদের জ্বালানিটি থাকে লোকচাহিদা ও এর জোগানে। এই লোকরঞ্জনবাদ শুধু লোকের চাহিদা নয়, একটি নির্মিত লোকচাহিদাকে হাতিয়ার করছে। সুশাসনের সর্বজনবিদিত চাহিদাকে পাশ কাটিয়ে একটি ‘স্ট্রংম্যান’ শাসনের চাহিদা তৈরি করা হচ্ছে। আর একেই লোকচাহিদা হিসেবে সামনে হাজির করা হচ্ছে, যা দেশে দেশে চেপে বসা কট্টরবাদকে একটি দায়মুক্তি দিতেই করা হচ্ছে। প্রতিটি দেশে নেতারা কাজের বদলে মুখের কথা দিয়ে এই নির্মিত জনচাহিদা মেটানোর চেষ্টা করছেন। তাঁরা তা-ই বলছেন, যা লোকপ্রিয় হবে, বা লোকপ্রিয় হওয়ার মতো কৌশলী মন্তব্য করছেন। ফলে সুস্পষ্ট কোনো মতবাদ বা আদর্শ আর মানুষের সামনে থাকছে না। এটি একটি শূন্যতার জন্ম দিচ্ছে, যা অস্থির করে তুলছে মানুষকে। এতে সব অঞ্চলেই বাড়ছে প্রতিক্রিয়াশীলতা।

প্রতিক্রিয়াশীলতা যে বাড়ছে, তা নিজেদের আশপাশে তাকালেই স্পষ্ট হবে। সম্প্রতি ভারতে ৪৯ জন বিশিষ্টজন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে যে খোলা চিঠি দিয়েছেন এবং তা নিয়ে যা হচ্ছে, তার দিকে তাকালেই এ বিষয়ে আর সংশয় থাকার কথা নয়। ভারত, বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে কিছু থেকে কিছু হলেই রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা করার একটি সাধারণ প্রস্তাব উঠে আসতে দেখা যাচ্ছে হালে। এ প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে।

ডানপন্থার দুই ঘরানার এই অন্তর্গত ক্ষয়কে কাজে লাগিয়ে বামপন্থাও নিজেকে আগে বাড়াতে পারছে না। হ্যাঁ, পশ্চিমা কয়েকটি দেশে কিছু উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হলেও এর সফল প্রয়োগক্ষেত্র প্রাচ্যে, তা একদমই পিছিয়ে আছে বলা যায়। এই মতবাদের তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য নবায়ন এই অঞ্চলে হয়নি, অন্তত গত কয়েক বছরে। বিশেষত পুঁজির মৃত্যুঘণ্টা বলে মনে করা ২০০৮ সালের মন্দাকে পাঠ করে, সেভাবে নিজেকে নবায়নের প্রবণতা এখানে দেখা যায়নি। ফলে এক বিরাট শূন্যতার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে বিশ্ব। এই শূন্যতা দীর্ঘায়িত হলে মানুষের অসহিষ্ণুতাকে পুঁজি করে অস্থিরতা বৃদ্ধির আশঙ্কা বাড়বে। সব মিলিয়ে সারা বিশ্বই এখন এই শঙ্কার সামনে দাঁড়িয়ে।

ফজলুল কবির: সাংবাদিক
ই–মেইল: [email protected]