সঞ্চয়পত্রের উৎসে কর

রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সঞ্চয়পত্র চালুর উদ্দেশ্য ছিল মূলত স্বল্প ও সীমিত আয়ের মানুষের বিনিয়োগকে উৎসাহিত করা, যাতে খুদে সঞ্চয় দিয়ে তাঁরা জাতীয় অর্থনীতিতে অবদানের পাশাপাশি নিজেদের আয়ের একটি উপায় করে নিতে পারেন। খুদে সঞ্চয়কারীদের জন্যই এই প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল এবং বিনিয়োগসীমাও বেঁধে দেওয়া আছে। সাধারণ বিনিয়োগকারীদের জন্য সর্বোচ্চ ৩০ লাখ এবং নারী ও প্রতিবন্ধীদের জন্য ৪৫ লাখ টাকা। কিন্তু বাস্তবে এই প্রকল্পে বৃহৎ সঞ্চয়কারীদের আধিপত্যই লক্ষ করা যাচ্ছে। বিগত সংসদ নির্বাচনে অনেক প্রার্থী হলফনামায় আয়ের উৎস হিসেবে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ দেখিয়েছেন। এর বাইরেও অনেক বিত্তবান মানুষ নামে–বেনামে প্রচুর সঞ্চয়পত্র কিনেছেন। ফলে সঞ্চয়পত্রের উদ্দেশ্য অনেকটাই ব্যাহত।

তবে জাতীয় সঞ্চয় প্রকল্পের মাধ্যমে কেবল বিনিয়োগকারীরা লাভবান হন না, সরকারও লাভবান হয়। প্রতিবছর যে বিপুল পরিমাণ অর্থের বাজেট ঘোষণা করা হয়, তাতে আয়ের চেয়ে ব্যয়ের পরিমাণ অনেক বেশি। সরকার ঋণের মাধ্যমে এই ঘাটতি পূরণ করে থাকে। আর সেই ঋণ পাওয়ার দুটো মাধ্যম হলো ব্যাংকিং ব্যবস্থা ও সঞ্চয়পত্র। সরকার সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমে যে অর্থ জনগণের কাছ থেকে সংগ্রহ করে, সেটাই আবার উন্নয়নকাজে খাটায়। ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে সরকার ঋণ নিলে ব্যাংকের মালিকেরা লাভবান হন আর সঞ্চয়পত্র থেকে নিলে খুদে বিনিয়োগকারীরা। বিশেষ করে নারী, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, বয়োজ্যেষ্ঠ নাগরিক—যাঁদের অনেকের এটাই একমাত্র আয়ের উৎস।

অতএব, সঞ্চয়পত্রের সুদের হারের সঙ্গে ব্যাংকিং ব্যবস্থার সুদের হারকে এক করে দেখা সমীচীন নয়। কয়েক বছর ধরে ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন মহল সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমানোর আবদার জানিয়ে আসছিল। সরকার এত দিন সেই আবদার আমলে না নিলেও চলতি অর্থবছরের বাজেটে উৎসে কর ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে। তবে অবসরভাতাভোগী, মুক্তিযোদ্ধা ও প্রতিবন্ধীদের কাছ থেকে উৎসে কর কাটা হবে না বলেও জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। সরকারের এই সিদ্ধান্ত যৌক্তিক। তবে একই সঙ্গে প্রকৃত খুদে বিনিয়োগকারীদের মুনাফার ওপর উৎসে কর ৫ শতাংশ রাখা সমীচীন বলে মনে করি।

এখন সরকার যদি বৃহৎ পুঁজির মালিকদের সঞ্চয়পত্র কেনা থেকে বিরত রাখতে পারে, তাহলে খুদে বিনিয়োগকারীরা লাভবান হবেন এবং বিত্তবানদের কর ফাঁকিরও সুযোগ কমবে। উল্লেখ্য, অনেক বিত্তবান মানুষ কর ফাঁকি দেওয়ার উদ্দেশ্যে সঞ্চয়পত্রে বড় অঙ্কের অর্থ বিনিয়োগ করছেন, যা অনৈতিক ও বেআইনি। বিত্তবানদের সঞ্চয়পত্রের প্রতি ঝুঁকে পড়ার আরেকটি কারণ বিনিয়োগের বিকল্প উপায় না থাকা। শেয়ারবাজার একটি বিকল্প হতে পারত। কিন্তু একটি স্বার্থান্বেষী মহলের কারসাজিতে শেয়ারবাজারে মারাত্মক ধস নেমেছে।

উৎসে কর কাটার ক্ষেত্রে সরকার যে নীতি নিয়েছে, তা অগ্রহণযোগ্য ও বিভ্রান্তিকর। বাজেটে বলা হয়েছে, ১ জুলাই থেকে ১০ শতাংশ উৎসে কর নেওয়া হবে। এ কারণে ৩০ জুন পর্যন্ত ব্যাংক ও জাতীয় সঞ্চয়পত্রের অফিসগুলোতে বিনিয়োগকারীদের প্রচণ্ড ভিড় ছিল। অনেক রাত পর্যন্ত বসে থেকে তাঁরা মুনাফার অর্থ তুলে নিয়েছেন। কিন্তু যাঁরা ৩০ জুনের মধ্যে মুনাফা তুলে নিতে পারেননি, তাঁরা কেন ক্ষতিগ্রস্ত হবেন? সরকার জুলাই থেকে যে বিধান কার্যকর করেছে, সেই বিধান ভূতাপেক্ষভাবে কার্যকর করতে পারে না।

অতএব, ১ জুলাইয়ের আগের মুনাফায় কোনোভাবে উৎসে কর ১০ শতাংশ নেওয়া যাবে না। এ বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয় ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের স্পষ্ট ব্যাখ্যা চাই। ১ জুলাইয়ের আগের মুনাফার উৎসে কর ৫ শতাংশের বেশি কেটে নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।