এরশাদের অর্থনৈতিক নীতি আজও সচল

অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় সামরিক একনায়কেরা যে একেবারেই ভালো নয়, এ নিয়ে বিস্তর গবেষণা রয়েছে। বিশেষ করে সত্তর ও আশির দশকে এ ধরনের বেশ কিছু গবেষণার কথা বেশি জানা যায়। ওই দশকে সামরিক একনায়কতন্ত্র এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার অনেক দেশে বেশ জাঁকিয়ে বসেছিল। এর মধ্যে লন্ডন থেকে ১৯৮২ সালে প্রকাশিত নাইজেরিয়ার অধ্যাপক টি ও ওডেটলার মিলিটারি রেজিমস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট বইটির কথা বিশেষভাবে বলা যায়। এর আগে ১৯৭০ সালে এরিক আ নর্ডলিঙ্গার ‘সোলজার ইন মুফতি: দ্য ইমপ্যাক্ট অব মিলিটারি রুল আপন ইকোনমিক অ্যান্ড সোশ্যাল চেঞ্জ ইন নন-ওয়েস্টার্ন স্টেটস’ এবং ১৯৭৫ সালে আর ডি ম্যাকেনলে ও এ এস কোহানের ‘আ কম্পারেটিভ অ্যানালাইসিস অব দ্য পলিটিক্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক্যাল পারফরম্যান্স অব মিলিটারি অ্যান্ড সিভিলিয়ান রেজিমস’ নামের আরেকটি গবেষণা বেশ আলোচিত হয়েছিল। তাঁরা সবাই দেখিয়েছেন, সামরিক একনায়কেরা অর্থনীতি ব্যবস্থাপনায় মোটেই যোগ্যতার পরিচয় দেননি, বরং অর্থনীতির ব্যবস্থাপনায় তাঁরা বেশ দুর্বল, অনভিজ্ঞ এবং প্রয়োজনীয় জ্ঞানও তাঁদের নেই।

জেনারেল এইচ এম এরশাদ ছিলেন বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে শাসন করা সামরিক একনায়ক। অনেক গবেষক ওই ৯ বছরকে অনুন্নয়নের কাল বলে অভিহিত করেন। বাংলাদেশ এ সময় এগোয়নি, বরং অনেক পিছিয়েছে বলেও অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন। তার বিপরীতে এরশাদের সময় বাংলাদেশের অনেক উন্নতি হয়েছিল—এ ধারণা পোষণকারীর সংখ্যাও খুব কম নয়। এখনো অনেকে এরশাদ আমলের রাস্তাঘাট নির্মাণের কথা এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করেন। রাস্তাঘাট নির্মাণের দুটি বড় সুবিধা হচ্ছে, এতে দৃশ্যমান উন্নয়ন দেখানো সম্ভব এবং নিজেদের লোকজনকে কাজ দেওয়াসহ অর্থের অপব্যবহার করাও সহজ। এখনো আমাদের উন্নয়ন বাজেটে সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ রাখা হয় রাস্তাঘাট নির্মাণে।  

১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ সামরিক শাসন জারি করেই জাতির উদ্দেশে একটি ভাষণ দিয়েছিলেন জেনারেল এরশাদ। সেখানে মূলত দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা আর অর্থনীতি ঠিক করার কথা বলা ছিল। তিনি বেশি কথা বলেছিলেন ব্যাংক খাতের কারচুপি বা ঋণ ফেরত না দেওয়ার প্রবণতার কথা। তিনি এর সমুচিত শিক্ষা দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলেন। সে অনুযায়ী ঋণ ফেরত দিতে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের সচিবালয় থেকে নির্দেশ জারি, ব্রিগেডিয়ার এ কাশেমের নেতৃত্বে অনাদায়ি ঋণ আদায় ও এ-সংক্রান্ত জটিলতা পর্যালোচনার জন্য একটি কমিটি গঠন এবং ব্যাংক লুটপাট ও দুর্নীতির অভিযোগে কয়েকজন বড় ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছিল। তবে পরে ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার জন্য এরশাদ ওই সব ব্যবসায়ীকে ব্যবহার করেছিলেন। তাঁদের অনেকেই পরে তাঁর রাজনৈতিক দলের অর্থদাতা, সদস্য ও মন্ত্রী হয়েছিলেন। এখনো যে ঋণখেলাপিদের রাষ্ট্রীয়ভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করা হয়, সেটা তো আমরা সবাই জানি।

এরশাদের সময় আরেকটি বিপজ্জনক কাজ ছিল বাছবিচার ছাড়াই ঋণ বিতরণ। কোনো ধরনের সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়া ব্যাংকঋণ দেওয়ার মূল উদ্যোক্তা ছিলেন ওই সময়ে শিল্প মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা উপরাষ্ট্রপতি মওদুদ আহমদ। তিনি তাঁর বইয়ে জনসভা করে ঋণ দেওয়াকে বিশাল এক সাফল্য হিসেবে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু এর ফল হচ্ছে খেলাপি ঋণের ব্যাপক বৃদ্ধি। বাংলাদেশ শিল্প ঋণ সংস্থা আর শিল্প ব্যাংক ধ্বংস হয়েছিল এরশাদের সময়েই। পরবর্তী সরকারগুলো সেই ধ্বংস আরও ত্বরান্বিত করেছিল।

এরশাদের মন্ত্রী মওদুদ আহমদ এবং শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন তাঁদের বইয়ে সে সময়কার অর্থনীতির নানা সাফল্যের বিবরণ দিয়েছেন। শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন তো মনেই করেন যে তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে উত্তরণের কাজটি এরশাদ সরকারের। যদিও তথ্য-উপাত্ত উল্টোটাই বলে। এরশাদের অর্থনীতির ব্যবস্থাপনা কেমন ছিল, তা জানার জন্য সেরা বই সম্ভবত সাবেক সচিব কাজী ফজলুর রহমানের আমলার দিনলিপি। ১৯৮৭ থেকে ১৯৯০ সময়ে এরশাদের শেষ দিন পর্যন্ত পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ছিলেন তিনি। প্রকল্প তৈরিতে স্বেচ্ছাচার, কমিশনের লোভে বড় বড় কেনাকাটা, অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পে অর্থ ব্যয়, তীব্র আর্থিক সংকট, ঋণের লোভে সব ধরনের শর্ত পালন—সবকিছুরই বর্ণনা আছে বইটিতে। 

এরশাদের আমলে সবচেয়ে লজ্জাজনক অধ্যায় ছিল উন্নয়ন বাজেট পুরোপুরি বৈদেশিক সাহায্যনির্ভর করে তোলা। এমনকি সরকার পরিচালনার ব্যয়, এর মধ্যে বেতন-ভাতাও আছে, তা-ও করতে হয়েছে বিদেশি সাহায্যের অর্থ দিয়ে। ১৯৮৯ সালের দাতাদের আসন্ন প্যারিস বৈঠক উপলক্ষে মন্ত্রিপরিষদের এক বৈঠকে এরশাদ একপর্যায়ে বলেছিলেন, ‘আমরা শুধু ভিখারি নই, ভিখারিদের অন্তত এনামেলের একটা ভাঙা বাসন থাকে, যেটা সামনে পেতে রাখে। আমাদের তা-ও নেই।’ 

অর্থসংকট প্রবল, কোষাগার শূন্য। যেকোনো শর্তে অর্থ লাগবেই। সেই উপায়ও এরশাদ জানতেন। একই বছরের ২৯ জুলাই এক বৈঠকে এরশাদ তো বলেই দিলেন, ‘থিংক বিগ অ্যান্ড বরো বিগ’। অর্থাৎ ভাবতে হবে বড় করে, ধারও করতে হবে বড় করে। কাজী ফজলুর রহমান এ নিয়ে লিখেছেন, ‘এরপর তিনি একটা মোক্ষম উপদেশ দিলেন—বরো মোর অ্যান্ড ডোন্ট পে (বেশি বেশি ধার করবে, আর তা শোধ করবে না)।’ আমাদের দেশে যাঁরা ব্যাংক থেকে টাকা ধার নেন, তাঁদের বড় অংশ যে এরশাদের সেই উপদেশ এখনো মনে রেখেছেন, বলাই বাহুল্য।

পরিকল্পনা কমিশনে প্রকল্প বাছাই কমিটির প্রধান ছিলেন কাজী ফজলুর রহমান নিজেই। কিন্তু সে সময় প্রকল্প গ্রহণের পদ্ধতি ছিল অন্য রকম। কাজী ফজলুর রহমান লিখেছেন, ‘গোদের উপর বিষফোড়ার মতো হয়েছে মহামান্য রাষ্ট্রপতির বিশেষ আদেশব্যঞ্জক প্রকল্পগুলো। তাদের দাপটে গোটা প্ল্যানিং কার্যক্রমই প্রায় অর্থহীন হয়ে দাঁড়াচ্ছে।’

এরশাদের আদেশব্যঞ্জক প্রকল্পের বেশ কিছু উদাহরণও দেওয়া আছে বইটিতে। উপজেলা টেলিফোন কেন্দ্র স্থাপনের জন্য ফিনল্যান্ড পুরো অর্থ অনুদান দেবে বলে আলোচনা চূড়ান্ত। কিন্তু এরশাদ আদেশ দিলেন, ফিনল্যান্ডের অনুদান নেওয়া চলবে না। তার বদলে ঋণ নিয়ে ফরাসি যন্ত্রপাতি কিনতে হবে। কারণ, অনুদান হলে কমিশন পাওয়া যায় না। এ ছাড়া এরশাদের আরেক আদেশে সাড়ে ৩ কোটি ডলারের ৬০ হাজার টেলিফোন লাইন-সংযোগ প্রকল্প কী করে চার দিনের মধ্যে ৯ কোটি ৩০ লাখ ডলার হয়ে গেল, সে রকম এক চমকপ্রদ উদাহরণও দিয়েছেন কাজী ফজলুর রহমান। এভাবে প্রকল্পের ব্যয় বাড়ানোর উদাহরণ তো এখনো আছে, বরং আরও পরিশীলিত হয়েছে। 

কেবল এরশাদের কথা বলেই লেখাটা শেষ করা ঠিক হবে না। তিনি যাঁদের নিয়ে চলতেন, তাঁদের কথাও বলি। কারণ এ ধরনের মানুষ ও কথার কোনো শেষ নেই, যুগে যুগে ফিরে ফিরে আসে। এরশাদের বাসভবনে সভা চলছে। আলোচনার বিষয় হচ্ছে রাষ্ট্রপতির অনুমোদন থাকলে প্রকল্প বাছাই, সম্ভাব্যতা যাচাই—এসবের কোনো প্রয়োজন নেই। সময়টি ছিল ১৯৯০ সালের ১০ জুন। তখন প্রধানমন্ত্রী কাজী জাফর আহমদ। একপর্যায়ে তিনি বললেন, ‘সব উন্নয়ন কার্যক্রমই হবে একমাত্র রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে, অন্য কোনো বিবেচনায় নয়। সবকিছুই দেশের সর্বক্ষমতা ও সর্বজ্ঞানের উৎস রাষ্ট্রপতির নির্দেশমতো হতে হবে।’

পরিস্থিতি আসলে কতটা বদলেছে?

শওকত হোসেন: প্রথম আলোর বিশেষ বার্তা সম্পাদক
[email protected]