প্রধানমন্ত্রিত্বের এক বছরে ইমরান খান

ইমরান খান। ছবি: ফাইল ছবি
ইমরান খান। ছবি: ফাইল ছবি

ইমরান খান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন এক বছর হয়ে গেছে। যে সাধারণ নির্বাচনে তাঁর দল জয়ী হওয়ার পর তিনি প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন, অনেকের মতে তা দেশটির ৭৩ বছরের ইতিহাসের সবচেয়ে নোংরা সাধারণ নির্বাচন। বিরোধী দলগুলো এবং আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকেরা অভিযোগ করেছেন, শক্তিমান পাকিস্তান সেনাবাহিনী সাবেক এই ক্রিকেটারের বিজয়কে সম্ভব করেছিল। ইমরান খানের নির্বাচনী প্রচারের স্লোগানটি ছিল ‘নয়া পাকিস্তান’, তবে প্রধানমন্ত্রিত্বের এক বছর পার হলেও তিনি নতুন পাকিস্তান গড়ার ধারেকাছেও নেই। সবচেয়ে খারাপ বিষয় হচ্ছে, তাঁর শাসনের এই এক বছরে বিশেষত অর্থনীতি, রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং মানবাধিকার পরিস্থিতি নানাভাবে আগের অবস্থায় ফিরে গেছে।

ইমরান খান প্রধানমন্ত্রিত্বের প্রথম বছরে তাঁর অনেক প্রতিশ্রুতি থেকে সরে গেছেন। এ কারণে তিনি ‘ইউটার্ন খান’ নামটি অর্জন করেছেন। গত এক বছরে পাকিস্তানের অর্থনীতির বারোটা বেজেছে। দেশের মুদ্রার মান দিনে দিনে পড়েছে এবং মাত্র এক বছরে এর মূল্যমান ৩৫ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। পরিস্থিতি এতটাই খারাপ হয়েছে যে ইমরান খানকে তাঁর মন্ত্রিপরিষদ রদবদল করতে হয়েছে এবং পাকিস্তানের আর্থিক সংকটের সমাধান হিসেবে তিনি বছরের পর বছর ধরে যার প্রশংসা করেছিলেন, সেই অর্থমন্ত্রীকে বরখাস্ত করেছেন। নির্বাচনী প্রচারের সময় ইমরান খান কোনো বিদেশি ঋণ গ্রহণ ছাড়াই পাকিস্তানের ডুবন্ত অর্থনীতিকে টেনে তোলার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। অথচ তাঁর সরকার মাত্র এক বছরে ১ হাজার ৬০০ কোটি ডলার ঋণ নিয়ে আগের সব রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মের পর কোনো অর্থবছরে বিদেশি ঋণ নেওয়ার এটা সর্বোচ্চ রেকর্ড। গত এক বছরে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হারও অর্ধেকে নেমেছে—৩ দশমিক ৩ শতাংশ। গত ৯ বছরের মধ্যে এটি সর্বনিম্ন।

ক্ষমতায় আসার আগে ইমরান খান বারবার বলেছেন, দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদদের কারণে দেশটি অগ্রসর হচ্ছে না, যাঁরা কিনা বিদেশে তাঁদের সম্পদ জমা রেখেছেন। তিনি তখন চুরি হওয়া ওই সব অর্থ ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু ক্ষমতায় আসার পর তিনি এসবের কিছুই করেননি। ইমরান খানের দলের অনেক দুর্নীতিবাজ সদস্য কোনো তদন্তের মুখোমুখি হননি। বরং কিছু ক্ষেত্রে অন্যায়ের কোনো প্রমাণ ছাড়াই ইমরান খানের রাজনৈতিক বিরোধীদের দোষী সাব্যস্ত করার জন্য বিচারকদের ব্ল্যাকমেল করা হয়েছে। এগুলো আসলে বিরোধীদের দমন করার জন্য ইমরান খানের চাল।

গত বছর পাকিস্তানের সেনাবাহিনী এবং সরকারবিরোধীদের দমন করার জন্য তাঁদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ আনা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ সরকারের একজন কঠোর সমালোচক বিশিষ্ট সংসদ সদস্য রানা সানাউল্লাহকে মাদক পাচারের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এই রাজনৈতিক দমন-পীড়ন দেশের বৃহত্তম প্রদেশ পাঞ্জাবে জনগণের ক্ষোভকে উসকে দিয়েছে। কারাবন্দী সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের কন্যা মরিয়ম নওয়াজ শরিফের নেতৃত্বে কয়েক হাজার মানুষ ২৫ জুলাই বিরোধীদের কণ্ঠ রোধ করার প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছিল। পাকিস্তানের গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপরও আঘাত হানছে ইমরান খানের সরকার। এই মাসের শুরুর দিকে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা এক আদেশে যেসব বিরোধী রাজনৈতিক নেতার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তাধীন রয়েছে, তাঁদের খবর গণমাধ্যমে প্রচার করা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। চলতি মাসের শুরুর দিকে যে তিনটি সংবাদ চ্যানেল মন্ত্রিসভার আদেশকে উপেক্ষা করে মরিয়ম নওয়াজের একটি সংবাদ সম্মেলন প্রচার করেছিল, তাদের সম্প্রচার কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

পাকিস্তানের মানবাধিকারকর্মীরা, যাঁরা আইনের শাসন এবং জনগণের অধিকার নিয়ে কথা বলেন, তাঁদেরও কর্তৃপক্ষ টার্গেট করেছে। পুরস্কারপ্রাপ্ত নারী অধিকারকর্মী গুলালাই ইসমাইল বর্তমানে আত্মগোপন করে আছেন। পাকিস্তানের দ্বিতীয় বৃহত্তম নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী পশতুন সম্প্রদায়ের দাবির প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করায় সরকারের শ্যেনদৃষ্টি তাঁর ওপর পড়েছে। আফগানিস্তান-পাকিস্তান সীমান্তের নিকটবর্তী আদিবাসী-অধ্যুষিত এলাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অভিযানের প্রতিবাদে পশতুন সম্প্রদায়ের লোকজন এক বছর ধরে প্রতিবাদ করে আসছেন। ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ১১ সেপ্টেম্বরের হামলার পর থেকে সেনাবাহিনী সেখানে অভিযান চালিয়ে আসছে।

কিন্তু তাদের দাবি শোনার পরিবর্তে সেনাবাহিনী ও সরকার উভয়ই এই আন্দোলনের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালিয়েছে এবং গণমাধ্যমকে তাদের প্রতিবাদের কোনো খবর বা ছবি না দেওয়ার এবং তাদের নেতাদের গ্রেপ্তারের নির্দেশ দিয়েছে। অথচ ক্ষমতায় আসার আগে ইমরান খানকে পশতুনদের সমাবেশে দেখা গিয়েছিল। তিনি তখন তাদের আন্দোলনকে সমর্থন করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর ইমরান খান তাঁর প্রতিশ্রুতি ভুলে গেছেন এবং এখন পশতুন সম্প্রদায়ের ক্ষোভের কারণ তাঁর কাছে আর পাত্তা পায় না। বরং আদিবাসী বেল্টে সেনাবাহিনীর অভিযানকে দ্ব্যর্থহীনভাবে সমর্থন করছেন। এটা ঠিক যে দেশের শক্তিশালী জেনারেলরা পর্দার আড়াল থেকে পাকিস্তানের রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করছেন। তবে মনে হচ্ছে, পাকিস্তানের জেনারেলরা একটা বিষয় বুঝতে ব্যর্থ হচ্ছেন আর সেটা হচ্ছে, পাকিস্তানের মতো বৈচিত্র্যময় একটি দেশের কখনোই উন্নতি হবে না, যদি সেখানকার বেসামরিক শাসকেরা সামরিক বাহিনী দ্বারা চালিত হন।

আল-জাজিরাথেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
তাহা সিদ্দিকি: পাকিস্তানি সাংবাদিক