বন্যাদুর্গত শিশুদের সুরক্ষার দিকে নজর দিন

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের আনুষ্ঠানিক তথ্য বিবরণী ও বিবৃতি–বক্তৃতায় চলমান বন্যায় প্রাণহানির কথা বলা হয়নি। কিন্তু দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বন্যাকবলিত মানুষের মৃত্যুর খবর আসছে। গত কয়েক দিনের সংবাদমাধ্যমে শেরপুর, নাগরপুর, কুড়িগ্রাম, ফরিদপুর প্রভৃতি স্থান থেকে শিশুদের মৃত্যুর খবর প্রকাশিত হয়েছে।

দুর্যোগ মোকাবিলায় সমন্বিত চাহিদা যাচাইয়ের লক্ষ্যে গঠিত যৌথ চাহিদা নিরূপণ কার্যপরিচালনা কমিটি বা জয়েন্ট নিডস অ্যাসেসমেন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের ২১ জুলাই প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০ জুলাই পর্যন্ত বন্যায় সারা দেশে মোট ৬০ জনের মৃত্যু হয়েছে, তাদের মধ্যে ৪৩ জন অপ্রাপ্তবয়স্ক। ১০ বছরের কম বয়সী শিশু ৩৩ জন। ২৩ জুলাই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম জানিয়েছে, বন্যার কারণে গত ১২ দিনে বিভিন্ন জেলায় মারা গেছে অন্তত ৮৭ জন। তাদের ৭২ শতাংশ অপ্রাপ্তবয়স্ক। এসব উপাত্ত থেকে এটা বেশ স্পষ্ট যে চলমান বন্যায় সবচেয়ে নাজুক অবস্থায় আছে শিশুরা। বাঁধের বাইরে বন্যা উপদ্রুত এলাকা আর ভেঙে যাওয়া বাঁধের ভেতরে হঠাৎ চলে আসা বন্যার পানিতে আটকে পড়া মানুষের কষ্টের মধ্যে হয়তো রকমফের আছে, কিন্তু শিশুদের দুর্দশা ও বিপন্নতা ক্রমে বাড়ছে।

সরকারি হিসাব অনুযায়ী, প্রায় সাড়ে তিন হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠদান বন্ধ আছে। অনেকটিতেই আর কোনো দিন আগের মতো পাঠদানের সুযোগ হবে না। নদীভাঙনের শিকার এসব বিদ্যালয় আবার কবে কোথায় নির্মাণ করা হবে কে জানে। বিধি মোতাবেক, কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দুর্যোগের কারণে একনাগাড়ে সাত দিনের বেশি বন্ধ রাখা যাবে না। নদীতে ভেঙে যাওয়া স্কুল অথবা পানিতে ডুবে থাকা স্কুল এখন কোনোরকমে চলছে কারও বাড়ির বারান্দায় অথবা উঠানে। যার বাড়িতে পানি উঠেছে কিংবা যে ঘরের চাল খুলে নিয়ে দূরের কোনো বাঁধে আশ্রয় নিয়েছে পরিবারের সঙ্গে, সে কীভাবে আসবে এসব আপৎকালীন স্কুলে? এদের সংখ্যাই বেশি, তাই উপস্থিতির হার ৫ শতাংশের কম। যেসব স্কুলে পানি ওঠেনি, সেখানে উঠেছে বন্যাকবলিত শরণার্থীর দল। তাদের আরেক বিপদ, বন্যার পানি নেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষ তাদের ঘরদোর ঠিক না করে স্কুলবাড়ির আশ্রয়কেন্দ্র ছেড়ে যেতে পারবে না। ছেড়ে গেলে সেগুলোর মেরামত লাগবে।

একটা শর্ত আছে যে দুর্যোগের সময় কোনো বিদ্যালয়কে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করতে হলে যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি থাকতে হবে। কিন্তু জরুরি পরিস্থিতিতে বানভাসি মানুষকে অপেক্ষায় রেখে অনুমতির জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষের দরজায় কড়া নাড়া কতটা বাস্তবসম্মত। প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচি-৩–এর এডুকেশন ইন ইমার্জেন্সি খাতের আওতায় সংস্থানকৃত অর্থ ব্যবহারের নীতিমালায় এ রকমের অবাস্তব ব্যবস্থার বিধান রাখা হয়েছে। উল্লেখিত নীতিমালার ১০ নম্বর বিধিতে বলা আছে, প্রাকৃতিক যেকোনো দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত বিদ্যালয়ের পাঠদান কার্যক্রম রাখা এবং প্রাথমিক শিক্ষাসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান কার্যক্রম চলমান রাখার জন্য অস্থায়ী গৃহনির্মাণ, গৃহ মেরামত ও সংস্কার এবং অন্তর্বর্তীকালীন স্কুল নির্মাণের প্রয়োজন হলে এই খাতের টাকা ব্যবহার করা যাবে।

দৃশ্যত, এর চেয়ে ভালো ব্যবস্থা আর হয় না। কিন্তু বিধি বলছে, এসব টাকা বরাদ্দ করবেন মহাপরিচালক। তিন লাখের বেশি টাকার প্রয়োজন হলে মন্ত্রণালয়ে যেতে হবে। যমুনার কামারজানির চরে বা রৌমারীর বন্দবেড় শৌলমারী বা দাঁতভাঙ্গায় যে বিদ্যালয় এই বানের পানিতে হঠাৎ তলিয়ে যাচ্ছে বা নদীভাঙনের কবলে পড়ছে, সেটির জন্য আবেদন কবে কীভাবে মিরপুর বা আবদুল গণি রোডে পৌঁছাবে। পৌঁছাতে হবে যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে। জরুরি প্রয়োজনে জরুরি তহবিল, কিন্তু ব্যবস্থাপনাটা সেকেলে। আলমারি দিলাম, আলমারির মধ্যে টাকাও দিলাম, কিন্তু চাবি রাখলাম আমার ট্যাঁকে। এ কেমন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা? আমরা না রোল মডেল, সারা দুনিয়া না আমাদের কাছে শিখবে! মধ্য যমুনায় চরপাঁচুরিয়ার প্রাথমিক স্কুলের প্রধান শিক্ষক যথাযথ কর্তৃপক্ষের দিকে তাকিয়ে না থেকে কোমরপানিতে নেমে তাঁর ছাত্রছাত্রী আর গ্রামবাসীকে নিয়ে যেভাবে নদীভাঙনের খপ্পরে পড়া স্কুলের আসবাব বাঁচালেন, তা কেবল বাংলাদেশের এসব লড়াকু মানুষের পক্ষেই সম্ভব।

ধারণা করা হচ্ছে, ভাদ্রের পূর্ণিমা বা ভরাকটালের আগে বাঁধের বাইরে আর চর এলাকার মানুষকে পানি ডিঙিয়েই চলতে হবে। তত দিন বন্ধ থাকবে স্কুলের স্বাভাবিক পাঠদান। এ কারণে শিশু সুরক্ষার ঝক্কি দিন দিন আরও বাড়বে। পানিবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব অচিরেই সংবাদ শিরোনামে পরিণত হতে পারে।

বন্যাকবলিত এলাকায় ত্রাণ তৎপরতার আড়ম্বর প্রদর্শনের জন্য শিশুদের ব্যবহার করার হিড়িক পড়েছে। মন্ত্রী–আমলা–সাংসদের ত্রাণ তৎপরতায় গমনাগমনের সময় শিশুদের রাস্তায় দাঁড় করানোর বিরুদ্ধে শক্ত বিধিমালা ২০১৪ সালের জানুয়ারি মাসে জারি করা হয়েছিল। বলা হয়েছিল, কোনো অবস্থাতেই বিশিষ্ট ব্যক্তি বা জনপ্রতিনিধিদের সংবর্ধনা দিতে শিক্ষার্থীদের আর রাস্তায় দাঁড় করানো যাবে না। তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী বলেছিলেন, এই নির্দেশ কেউ অমান্য করলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বিধিমালায় আরও সুনির্দিষ্ট করে বলা হয়েছিল, নির্দেশ অমান্য করলে প্রধান শিক্ষক বা প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পরিষদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বলা বাহুল্য, সেসব নির্দেশ কাগজেই থেকে গেছে। কোথাও স্কুল কর্তৃপক্ষ, কোথাও সরকারি দলের স্থানীয় নেতাদের নির্দেশে শিক্ষার্থীদের নিয়ে এমপি-মন্ত্রীদের সংবর্ধনা সভায় যোগ দিতে বাধ্য করার চেষ্টা বন্ধ হয়নি। সম্প্রতি বন্যা উপদ্রুত সিরাজগঞ্জের কাজীপুর উপজেলায় প্রশাসন বানভাসি মানুষের মধ্যে ত্রাণ বিতরণের আয়োজন করে। এতে অতিথি ছিলেন এক প্রতিমন্ত্রী এবং এক উপমন্ত্রী। অতিথিরা ঘটনাস্থলে পৌঁছার আগে তাঁদের স্বাগত জানাতে সকাল ১০টা থেকে বেলা প্রায় ১টা পর্যন্ত মাইজবাড়ি বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয়ের প্রায় ৭০০ শিক্ষার্থীকে রোদের মধ্যে লাইনে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। শিশুদের প্রতি সামান্যতম দরদ থাকলে কি আমরা তাদের এভাবে কষ্ট দিতে পারতাম?

চলমান বন্যা মোকাবিলায় আমাদের আরও শিশুমনস্ক হতে হবে।

গওহার নঈম ওয়ারা: লেখক ও গবেষক
[email protected]