মধ্যপ্রাচ্যে নারী শ্রমিকের আত্মহত্যা

মধ্যপ্রাচ্যে কাজ করতে গিয়ে লাশ হয়ে ফিরছেন বাংলাদেশি শ্রমিকেরা। মধ্যপ্রাচ্যে প্রবাসী কর্মজীবী নারীর ওপর যৌন হয়রানিসহ নানা বৈষম্য বছরের পর বছর ধরে চলছে। কিন্তু মাত্র সাড়ে তিন বছরে প্রায় সাড়ে তিন শ নারীর মৃত্যুর খবর অত্যন্ত উদ্বেগজনক। ২০১৬ সাল থেকে গত জুন পর্যন্ত মধ্যপ্রাচ্য থেকে ৩১১ নারী শ্রমিকের লাশ বাংলাদেশে আনা হয়েছে। এদের অধিকাংশই সৌদি আরব থেকে এসেছে। সব থেকে ভয়াবহ হলো, এদের মধ্যে ৫৩ জনই আত্মহত্যা করেছেন। এর থেকে দ্বিগুণেরও বেশি, ১২০ জন স্ট্রোকে এবং ৫৬ জনের দুর্ঘটনায় মৃত্যু ঘটেছে। বিদেশগামী নারীদের বেশির ভাগের বয়স ২০ থেকে ৪০-এর মধ্যে। সুতরাং ১২০ জন নারীর স্ট্রোকে মৃত্যুকে সহজভাবে মেনে নেওয়া যায় না। উপরন্তু প্রবাসী নারী শ্রমিকদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশই দারিদ্র্যের কশাঘাতে জর্জরিত, তাঁরা আত্মীয়স্বজনসহ নানা সূত্রে ঋণ নিয়ে, জমিজিরাত বন্ধক রেখে বা বিক্রি করে সচ্ছল জীবন গড়ার আশায় বিদেশে চাকরি করতে গিয়েছিলেন। তাঁরা তাঁদের ভ্রমণের খরচ উঠে না আসতেই দলে দলে ফিরে আসছেন। তাঁদের অনেকেই কর্মক্ষেত্রে নানা ধরনের হয়রানি ও বৈষম্যের অভিযোগ তুলছেন। সুতরাং এখানে এটা পরিষ্কার, এই নারীরা আন্তর্জাতিক শ্রম আইন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অসহায় শিকার।

অভিবাসী শ্রমিক, তা তাঁরা বিশ্বের যে প্রান্তেই থাকুন, তাঁরা যেমন নিজ দেশে রেমিট্যান্স প্রেরণকারী, তেমনি স্বাগতিক দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে ভূমিকা পালনকারী হিসেবে স্বীকৃত। অভিবাসী শ্রমিকদের মর্যাদা গোটা বিশ্বে মূলত এভাবে পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় হিসেবেই দেখা হয়ে থাকে। কিন্তু তদুপরি সৌদি আরবের সঙ্গে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশের বিশেষ সম্পর্ক ঐতিহাসিকভাবে সুবিদিত ও স্বীকৃত। সৌদি সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের অধিকতর বোঝাপড়ার বিষয়টিও স্বীকৃত। কিন্তু বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশি নারী সৌদি আরবে রহস্যজনকভাবে আত্মহত্যা করেছেন, অথচ সে বিষয়ে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অব্যাহত নির্লিপ্ততা দুঃখজনক। যেমন এ বিষয়ে ডেইলি স্টার-এর প্রতিবেদকের প্রশ্নের জবাবে ওই মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিব বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। ওই উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বলেছেন, কতিপয় প্রবাসী নারী শ্রমিকের আত্মহত্যা বা স্ট্রোকে মৃত্যুর তথ্য তাঁর জানা নেই। এ বিষয়ে তদন্ত হওয়া উচিত। আবার রিয়াদে বাংলাদেশ দূতাবাসের লেবার কাউন্সেলরের দেওয়া বক্তব্য রূঢ় বাস্তবতা হলে তা আমাদের অসহায়ত্বকে তীব্রতা দেবে। তাঁর দাবি, সৌদি আরবের মাটিতে ওই সব অস্বাভাবিক মৃত্যুর তদন্তের কোনো সুযোগ নেই। আমরা বুঝতে অক্ষম যে, লেবার কাউন্সেলর কিসের ভিত্তিতে এবং কাদের দ্বারা তদন্তের সুযোগ নেই বলে মন্তব্য করেছেন। বাংলাদেশ দূতাবাস কি এ ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নিয়েছিল? সৌদি আরব ১৯৭৬ সালে ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশনের (আইএলও) সদস্যরাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃত হওয়ার পর এ পর্যন্ত ১৬টি কনভেনশন অনুসমর্থন করেছে। এমনকি আইএলওর যে আটটি কোর কনভেনশন আছে, তার মধ্যে ছয়টিতেই তারা সই করেছে।

রেমিট্যান্স থেকে প্রাপ্তি বড় করে দেখাতে আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্রের অত্যুৎসাহ কোনো লুকোছাপার বিষয় নয়। ভূমধ্যসাগরে সলিলসমাধি, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ায় গণকবর উপাখ্যানের পর মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশের নারী শ্রমিকদের আত্মহত্যার হার মাত্র তিন বছরের ব্যবধানে অন্তত ১৭ গুণ বেড়ে যাওয়া গভীরভাবে উদ্বেগজনক। অথচ এ বিষয়ে সরকারের তরফে কোনো ব্যাখ্যা নেই। গত সাড়ে তিন বছরে (২০১৬-১৯) শুধু সৌদি আরবেই গমনকারী বাংলাদেশি নারী শ্রমিক ২ লাখ ৬০ হাজারের বেশি। আমরা আশা করব, সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যে নিযুক্ত বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোকে আমাদের নারী শ্রমিকদের নির্যাতন ও আত্মহত্যা বৃদ্ধির অভিযোগের বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে নির্দেশ দেওয়া হবে। এসব ঘটনা তদন্তের জন্য আমরা সৌদি সরকারের প্রতি একটি রয়্যাল কমিশন গঠনের দাবি জানাই।