এক স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে খুব মনে পড়ছে

মশকনিধনে ব্যর্থ হওয়ায় স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণমন্ত্রী এবং ঢাকা সিটির দুই মেয়রের কুশপুত্তলিকা দাহ করা হচ্ছে
মশকনিধনে ব্যর্থ হওয়ায় স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণমন্ত্রী এবং ঢাকা সিটির দুই মেয়রের কুশপুত্তলিকা দাহ করা হচ্ছে

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পূর্ব বাংলার (বর্তমান বাংলাদেশের) প্রথম স্বাস্থ্যমন্ত্রী ছিলেন হবিবুল্লাহ বাহার চৌধুরী। মুসলিম লীগের যে উপদলটি ছিল অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল, তিনি ছিলেন সেই গ্রুপের নেতা। তিনি দলীয় রাজনীতি করেছেন বটে, কিন্তু প্রধানত ছিলেন একজন ক্রীড়াবিদ, লেখক ও সাংবাদিক। তাঁর সম্পাদিত বুলবুল ছিল একটি অসাধারণ সাহিত্য সাময়িকী। যৌবনের শুরুতে তিনি যুক্ত ছিলেন মাস্টারদা সূর্য সেনের গ্রুপের সঙ্গে, ছিলেন নজরুলের অত্যন্ত স্নেহভাজন এবং নোয়াখালীর দাঙ্গার পর মহাত্মা গান্ধীর শান্তি মিশনে তাঁর সঙ্গে কাজ করে গান্ধীজির প্রীতিভাজন হন।

গত বৃহস্পতিবার থেকে হবিবুল্লাহ বাহারের কথা আমার মনে পড়ছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে তিনি সফরে গিয়েছিলেন শিবালয়ে। তাঁকে নিয়ে আমার আব্বা ডাকবাংলোতে ওঠান। তাঁর অডারলি ডাকবাংলোর পুকুরে হাতমুখ ধুতে যান। তাঁর কোমরে রাখা রিভলবারের গুলিতে পুকুরঘাটে তিনি গুরুতর আহত হলে মন্ত্রী তাঁর সফর ফেলে সিভিল সার্জনকে সঙ্গে নিয়ে একটি লঞ্চে ঢাকা রওনা দেন। আমি তখন খুবই ছোট। কিন্তু ঘটনাটি চাঞ্চল্য সৃষ্টি করায় মনে আছে।

মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের সম্পর্ক ছিল আদায় কাঁচকলায়। পরস্পর ঘোর প্রতিপক্ষ। পূর্ববাংলা আইন পরিষদের কংগ্রেসদলীয় প্রভাবশালী সদস্য ছিলেন প্রভাসচন্দ্র লাহিড়ী। ব্রিটিশ আমলে দীর্ঘদিন জেল খেটেছেন। তিরিশের দশকে ঢাকা জেলখানায় ছিলেন। মশারির মধ্যে থাকতেন, তা সত্ত্বেও মশার কামড়ে হাত-পা ফুলে যেত। তিনি এক স্মৃতিকথায় লিখেছেন ‘ঢাকার মশা অতি চালাক।...তখন পেয়েছি ঢাকার মশার পরিচয়। কিন্তু বাহার সাহেবের মন্ত্রিত্বের আমলে দেখেছি, সেই ঢাকাকে তিনি একদম মশক-শূন্য করেছিলেন। তাঁর সময় আমি বিনা মশারিতেও ঢাকায় রাত কাটিয়েছি। লোকে বলত সেইটিই ছিল “বাহার সাহেবের বাহার”।’

একালে এক দলের নেতা আরেক দলের নেতার গিবত গাওয়া ছাড়া প্রশংসাসূচক একটি শব্দও উচ্চারণ করেন না। সেকালে বিরোধী দলের নেতা সরকারের ভালো কাজের প্রশংসা করতেন। সূত্রাপুরে থাকতেন আরেক কংগ্রেস নেতা গণেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য। তিনিও হবিবুল্লাহ বাহারের কর্মদক্ষতার প্রশংসা করেছেন।

জসীমউদ্দীন এক স্মৃতিরোমন্থনে বলেছেন, ‘মন্ত্রী হইয়া বাহার সাহেবের অমর কীর্তি ঢাকা শহর হইতে মশক বিতাড়ন। স্বাধীনতার পূর্ব ঢাকা শহরে সন্ধ্যার পরে মশারির বাহিরে থাকিবার উপায় ছিল না। বাহার স্বাস্থ্যমন্ত্রী থাকার কালে ঢাকা হইতে মশক বিতাড়িত হইল। বাহার নিজে বস্তিতে বস্তিতে ঘুরিয়া এই কাজের তদারক করিত। প্রতি মাসে তাহার বিভাগের লোকেরা কতকগুলি গাছের খোড়ল সিমেন্ট দিয়া বন্ধ করিত, কতকগুলি ভাঙ্গা পাতিল ও কলসী বনজঙ্গল হইতে কুড়াইয়া আনিত তাহার তালিকা বাহারের নখদর্পণে ছিল।’

আমরা এখন পরিবেশের কর্মীরা ঢাকা নগরীর খাল ও জলাধারগুলোর অবস্থা নিয়ে হাহাকার করি। পঞ্চাশের দশকে দেখেছি নগরীর ভেতরে খালে সারা বছর পানি। ধোলাই খালে চলত বড় বড় লঞ্চ। ঢাকা নগরীতে কিছু নৌপথ করার পরিকল্পনা ছিল হবিবুল্লাহ বাহারের। জসীমউদ্দীন লিখেছেন: ‘পূর্বে ঢাকা শহরের ভেতরে যেসব নদীনালা ও পয়ঃপ্রণালি ছিল বাহারের ইচ্ছা ছিল সেগুলোকে সংস্কার করাইয়া ভেনিশের মত ঢাকা শহরের রাস্তাগুলোকে জলের রাস্তায় [নৌপথে] পরিণত করা।’

হবিবুল্লাহ বাহার ছিলেন চাটগাঁর মানুষ এবং আবুল ফজলের সমসাময়িক। আবুল ফজল এক স্মৃতিচারণায় লিখেছেন: ‘পূর্ব পাকিস্তানের স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে তিনি যে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন তার তুলনা নাই। তাঁর আমলেই ঢাকার বিশ্ববিখ্যাত মশককুল হয়েছিল নির্বংশ। তাঁর সেদিনের এ কৃতিত্ব আজো একটা অবিশ্বাস্য কিংবদন্তী হয়ে আছে।’

হবিবুল্লাহ বাহার স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে বলতে পারতেন, আমার কাজ স্বাস্থ্য বিভাগের পদস্থ কর্মকর্তা, সরকারি হাসপাতাল, ডাক্তার, নার্সদের নিয়ে, তাদের নিয়োগ-বদলি, পদোন্নতি নিয়ে, কোথাকার কোন ক্ষুদ্র কীট মশা, আমি মন্ত্রী হয়ে তার পেছনে দৌড়াব? কিন্তু তিনি সচিবালয় থেকে বাড়ি ফেরার পথে ‘নর্দমা, ডোবা, জমা পানি’ কোথায় আছে দেখে যেতেন এবং প্রয়োজনমতো সেগুলো সাফ করতে নির্দেশ দিতেন। তিনি স্লোগান লেখা গেঞ্জি পরে, টুপি মাথায় দিয়ে, ব্যান্ড পার্টি নিয়ে র‍্যালি করে মশা তাড়ানোর পোস্ট-মডার্ন পদ্ধতিতে যাননি। বাহার সাহেব ছিলেন ক্ষয়িঞ্চু সামন্ত পরিবারের মানুষ। কোনো ব্যবসা-বাণিজ্য ছিল না। মন্ত্রী হয়ে শুধু মন্ত্রিত্বই করেছেন, পারিবারিক প্রতিষ্ঠানাদি দেখাশোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন না।

গত দেড় মাস ডেঙ্গু জ্বর নিয়ে পত্রপত্রিকায় লেখালেখি হচ্ছে। আমাদের মাননীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী এত দিন ডেঙ্গু নিয়ে মুখ খোলেননি। দেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ে গত শুক্রবার তাঁর মূল্যবান মতামত পাওয়া গেল। ড্রয়িংরুমে বসে তিনি কথাচ্ছলে বলেননি, চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের একটি বৈজ্ঞানিক সেমিনারে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছেন: ‘আমাদের দেশে হঠাৎ করে কেন এত ডেঙ্গু রোগী? একটি সিম্পল উত্তর আমার পক্ষ থেকে, সেটা হলো—মশা বেশি, এডিস মশা বেশি। সে মশাগুলো অনেক হেলদি (স্বাস্থ্যবান) মশা এবং সে মশাগুলো অনেক সফিসটিকেটেড (অত্যাধুনিক পরিশীলিত) মশা। তারা শহরে, বাড়িতে থাকে—এটাই উত্তর। যেহেতু প্রোডাকশন বেশি...তাই মশা বাড়তেছে। সাম হাউ উই কুড নট ম্যানেজ [টু] কন্ট্রোল দ্য মসকিউটো পপুলেশন। যেভাবে রোহিঙ্গা পপুলেশন বাড়ে...আমাদের দেশে এসে, সেভাবে মসকিউটো পপুলেশন বেড়ে যাচ্ছে।...প্রোডাকশন যদি কম হতো, এডিস মশা কম হতো। মানুষ আক্রান্ত মশার কামড় কম খেত, ডেঙ্গু কম হতো।’ [যায়যায়দিন]

স্বাস্থ্যমন্ত্রী যথার্থই বলেছেন, ‘মশক নিধন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নয়, সিটি করপোরেশনের দায়িত্ব।’ ডেঙ্গু জ্বর নিয়ে সংবাদ পরিবেশনে সাংবাদিকদের আরও সচেতন হওয়ার সদুপদেশ দিয়ে বলেছেন, ‘সাংবাদিকদের জানতে হবে, দেশে প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় ১৫ থেকে ২০ জন মারা যায়। সাপের কামড়ে ১০ জন করে এবং হার্ট অ্যাটাকে শত শত লোক মারা যায়। সে খবর তো আমরা রাখি না। কিন্তু গত কয়েক মাসে ডেঙ্গুতে মারা গেছে মাত্র ৮ জন। এটা এখন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে।’ [সমকাল]

মাননীয় মন্ত্রী খেয়াল করেননি এক কথায় তিনি কাউকে করেছেন অপমান এবং কাউকে করেছেন আঘাত। বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে নির্যাতিত জনগোষ্ঠী রোহিঙ্গাদের নিয়ে কটূক্তি বা রসিকতা চরম নির্মমতা। পানিতে ডুবে কেউ মারা গেলে পুকুর বা নদীকে কেউ দায়ী করে না। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে তো নয়ই। যে বাড়ির কেউ পানিতে ডুবে মারা গেছে তাদের প্রিয়জনকে আঘাত দিয়েছেন।

সাপের কামড়ে মৃত্যুর জন্য বাংলাদেশের কোনো বালকও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে দোষারোপ করে না এবং সাপ নিধনের দাবিও জানায় না। শুধু হার্ট অ্যাটাক কেন, কতজন তো গলায় ফাঁস নিয়েও মরছে। তাঁর হিসাবে সড়ক দুর্ঘটনায় বছরে সাত হাজারের বেশি মানুষ মারা যায়। সড়ক দুর্ঘটনায় যে বাড়ির এক বা একাধিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন, মন্ত্রীর এই মন্তব্যে তাঁরা আঘাত পেয়েছেন।

বিভিন্ন কারণে মৃত্যুর তুলনামূলক হিসাব কষে, কীভাবে মরা ভালো তার আভাস দিয়ে তিনি তাঁর মন্ত্রণালয়কে নির্দোষ প্রতিপন্ন করতে চেয়েছেন। বলেছেন ডেঙ্গু সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে। তার অর্থ কেউ আক্রান্তও হবে না, মরার তো প্রশ্নই আসে না। এমন জোরালো দাবির কোনো প্রয়োজন ছিল না, কারণ দেশের মানুষ জানে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ‘মৃত্যুপ্রতিরোধ মন্ত্রণালয়’ নয়। ইতালির একটি শিশু কূপে পড়ে গিয়েছিল, তাকে বাঁচাতে রাষ্ট্রযন্ত্র সর্বাত্মক ব্যবস্থা নেয়। তখন ইতালির প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘হোয়েন কোয়েশ্চন অব ডেথ, ওয়ান ইজ টু বিগ আ নাম্বার।’

অতি উঁচু পদে যাঁরা অধিষ্ঠিত, তাঁদের যোগ্যতা-দক্ষতা যা-ই থাক, তাঁদের থেকে দায়িত্বশীল আচরণ ও সংবেদনশীল কথাবার্তা মানুষ প্রত্যাশা করে। মহামারির সংজ্ঞা বা মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে অঙ্ক কষে বা বিতর্ক করে পরিস্থিতির উন্নতি ঘটানো সম্ভব নয়। দরকার দায়িত্বশীলতা ও কর্তব্যনিষ্ঠা। তাই ৬৯ বছর পরেও হবিবুল্লাহ বাহারকে মনে পড়ে।

সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক