ভিআইপি আপদ: 'আমাকে চিনোস তুই?'

বিদেশি একটা পত্রিকায় দেখেছি, ব্রিটেনে মাত্র ৮৪ জন প্রশাসনের পক্ষ থেকে ‘বিশেষ নিরাপত্তা–সুবিধা’ পান। ভিআইপি বলা হয় যাঁদের। ফ্রান্সে এ রকম সুবিধা পান ১০৯ জন। জাপানে ১২৫ জন। যুক্তরাষ্ট্রে ২৫২। ১৩৭ কোটি মানুষের দেশ গণচীনে ওই রকম ‘ভিআইপি’ আছেন মাত্র ৪৩৫ জন।

কিন্তু বাংলাদেশে রাস্তাঘাটে, হাসপাতালে, বিমানবন্দরে, ফেরিঘাটে—এমনকি দেখেছি, হোটেলের ডাইনিং রুমে শত শত ব্যক্তি ও বাহন ওই রকম সুযোগ-সুবিধা দাবি করছে, নিচ্ছে, পাচ্ছে। ঢাকার আজিজ মার্কেটের এক বইয়ের দোকানে দেখেছি, এক ব্যক্তি প্রয়োজনীয় বই খুঁজছেন।Ñদুই পাশে দুই রক্ষী অন্যদের বের হয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত করছে। কোন সাংবিধানিক নির্দেশনার বদৌলতে এখানে প্রতিনিয়ত এত ‘ইমপট্যান্ট পার্সন’ তৈরি হচ্ছে তা অজ্ঞাত।

বর্বরতার শিকার আপনজনের মৃত্যুর ওপর দাঁড়িয়ে কেবল আমরা নিজেদের দাসোচিত জীবন নিয়ে হাহুতাশ করি। যেমনটি শুরু হয়েছে সম্প্রতি ভিআইপি কালচার নিয়ে বিতর্ক।

রাষ্ট্রের অভিভাবক হিসেবে রাষ্ট্রপতি কিংবা প্রশাসনের সর্বোচ্চ নির্বাহীরা রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে চলাফেরার পথে স্বাভাবিকভাবেই অগ্রাধিকারমূলক প্রটোকল ও সর্বোচ্চ নিরাপত্তাসুবিধা পাবেন। সেটা আর চলতি সময়ের সর্বগ্রাসী ‘ভিআইপি কালচার’ আদতে পৃথক বিষয়।

ভিআইপি সংস্কৃতি জনগণকে ‘অচ্ছুত’ ভাবে
অনেক ভিআইপিই জনগণের সঙ্গে লাইন ধরেন, জনগণের পাশে দাঁড়িয়ে কিছু পেতে আগ্রহী নন। এতে বার্তাটি স্পষ্ট। জনতাকে ‘অচ্ছুত’ ভাবেন তাঁরা। চলাফেরার পথে এই অচ্ছুতদের সরাতে পাড়া-মহল্লায়ও অনেক ভিআইপি গাড়িতে অদ্ভুত ধাঁচের এক হাইড্রোলিক হর্ন লাগিয়ে রাখেন। এ যেন ক্ষমতার এক শাব্দিক প্রকাশ, যা না হলেই নয়।

অনেক ভিআইপি আবার গাড়ির সামনে-পেছনে মোটরসাইকেল আরোহী কয়েকজনকে পাহারায় রাখেন। এ রকম সংবাদ অনেকেই দেখেছেন ভিআইপিদের আসা-যাওয়ার পথে আটকা পড়ে অনেক পরীক্ষার্থী যথাসময়ে হলে পৌঁছাতে পারেননি। ভিআইপিদের গতি নির্বিঘ্ন রাখতে গিয়ে রাস্তায় রোগীদের মৃত্যু নৈমিত্তিক ঘটনা এখন। এ রকম ‘গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি’দের বিলম্বের কারণে বিমানভর্তি যাত্রীকে বসিয়ে রাখার ঘটনাও অহরহ ঘটছে। এসব অনাচার নিয়ে তাৎক্ষণিক প্রশ্ন তুললেই শুনতে হয় ‘আমাকে চিনোস তোরা’? ভিআইপি কালচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে নাজেহাল হওয়ার ঘটনাও শহরাঞ্চলে বিপুল।

এই দম্ভের শিকড় আমাদের মননের অনেক গভীরে নীরবে নীরবেও কাজ করে। ভিআইপি হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার আকুতি সমাজে এত প্রবল যে অনেককে দেখেছি মসজিদে ঢুকেই প্রথম কাতারে গিয়ে দাঁড়ানোর জন্য মরিয়া হয়ে ধাক্কাধাক্কি করে এগোতে থাকেন। যেন প্রার্থনা নয়, তাঁর প্রথম কাতারে দাঁড়ানোটাই মুখ্য। তাঁকে জায়গা করে দেওয়া সব মুসল্লির দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।

ভিআইপি সংস্কৃতি বর্ণপ্রথার মতো
সমগ্র সমাজকে ঠায় দাঁড় করিয়ে রেখে, বঞ্চিত করে, কিছু বাছাইকৃত মানুষের বাড়তি সুবিধার নামই ভিআইপি সংস্কৃতি। ভিআইপি মানসিকতা কার্যত উপনিবেশকালের একটা রোগ। একটা অসুস্থতা। এটা আসলে ভিন্ন নামে বর্ণপ্রথা। বাংলাদেশে ভিআইপিরা হর্ন বাজিয়ে ‘রং-সাইড’ দিয়ে হলেও এগিয়ে যেতে চান। এতেই স্পষ্ট এই বিকৃতির সামাজিক শিকড় কত গভীরে।

সভ্য দুনিয়ায় সাইরেনের মতো হর্ন বাজিয়ে চলাচল করে কেবল দুর্যোগ নিবারণের কাজে নিয়োজিত গাড়ি। কিন্তু বাংলাদেশে এটাকে কেউ কেউ স্ট্যাটাস সিম্বলও ভাবেন। কিন্তু কোনো ‘রিপাবলিক’ এভাবে ভিআইপি, নন–ভিআইপিতে বিভক্ত হতে পারে না। রিপাবলিকে ভিআইপি থাকে না, ইপিআই (এভরি পার্সন ইজ ইমপরট্যান্ট) থাকে। বাংলাদেশেও সেটা থাকার কথা ছিল।

যেসব বিধি-নিয়ম-প্রথা ভিআইপি কালচারকে অক্সিজেন জোগাচ্ছে, সেগুলো অবশ্যই আমাদের সংবিধানের স্পিরিটের সঙ্গে সাংঘর্ষিক এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রতিজ্ঞাসমূহের লঙ্ঘন। সাধারণ মানুষ যুদ্ধ করে শত্রুর কাছ থেকে এই দেশ বাস্তব করেছিল, গুটি কয়েক মানুষকে উচ্চবর্ণের মর্যাদায় অভিষিক্ত করার জন্য নয়। সংবিধানটিও নিশ্চয়ই কেবল কাগুজে দলিল নয়। এক দেশে দুই রকম মানুষের আইনগত বৈধতার লক্ষ্যে নিশ্চয়ই বাংলাদেশ হয়নি।

উপনিবেশিকতার দীর্ঘ জের
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি অনেক রাষ্ট্রীয় কর্মচারীও নিজেদের ভিআইপি ভাবছেন। যদিও জনগণ আনুষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্রের তরফ থেকে এরূপ ভিআইপিদের সংখ্যা জানে না। সরকারি তরফ থেকে এটা জানানো দরকার।

রাজনীতিবিদদের নির্বাচিত করা হয় জনগণের নিরাপত্তা ও সুবিধা বাড়ানোর জন্য। এটা মোটেই বর্ণগত পদোন্নতি নয় যে জনপ্রতিনিধি হয়েই জনতাকে অস্পৃশ্য ভাবতে হবে। প্রশাসক ও নির্বাহীদেরও ‘সেবক’ হওয়ার কথা—ভিআইপি নন। জনগণই সর্বাগ্রে। জনগণের তরফ থেকে বেতনভোগীরা সর্বাগ্রে নন। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর দ্বারা সুরক্ষার দাবিদার সর্বাগ্রে করদাতারা। কিন্তু কার্যত রাষ্ট্রের সুবিধাগুলো অগ্রাধিকারমূলকভাবে পাচ্ছেন কথিত ভিআইপিরা। রাষ্ট্রযন্ত্র যেন এটা ভাবতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে যে ভিআইপিদের সেবার জন্যই বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে।

কোনো জনপদে জনগণ যদি এরূপ প্রথাকে মেনে নিতে থাকে, তাহলে পরোক্ষে তারা এটাই স্বীকৃতি দেয়, কথিত ভিআইপিদের চেয়ে নৃগোষ্ঠী হিসেবে তারা হীন। গোষ্ঠীগতভাবে তারা ‘অপর’। তারা ‘অধস্তন’। বাংলাদেশের মানুষ কি সচেতনভাবে এটা মেনে নিতে প্রস্তুত আছে? হয়তো আছে। না হলে ভিআইপি প্রথা টিকে আছে কীভাবে?

মনে হচ্ছে উপনিবেশিকতার দীর্ঘ জের। সত্য যে, ৭২ বছর আগে ব্রিটেন গিয়েছে, ৪৮ বছর আগে পাঞ্জাবিরা গিয়েছে, কিন্তু আমাদের দাসোচিত মনটি হয়তো রয়ে গেছে। মনোবিজ্ঞানে একেই বলে ‘কালেকটিভ ডিপ্রেশন’ বা যূথবদ্ধ দীনতা। সাধারণত বন্দিশিবিরে এরূপ ট্রমা তৈরি হয়। তবে অনেক তথাকথিত ‘মুক্ত’ দেশেও উপনিবেশিকতার জের হিসেবে এরূপ মনোবিকার থেকে যায়। ফ্রাঞ্জ ফানো একে বলতেন ‘কলোনিয়াল এলিয়েনেশন অব দ্য পার্সন’। অর্থাৎ উপনিবেশ-উত্তর দেশগুলোতে মানুষের সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্কের বিচ্ছিন্নতাজনিত মানসিক ব্যাধি।

অস্বাভাবিক নয় যে বাংলাদেশের মতোই পাকিস্তান, ভারত, বার্মা ও শ্রীলঙ্কায়ও এ রকম সংস্কৃতি প্রবলভাবে আছে এখনো। ভারতে মোদি সরকার কিছুদিন আগে কথিত ভিআইপিদের গাড়ির ছাদে লাল রঙের আলো জ্বালিয়ে সাইরেন বাজানো নিষিদ্ধ করেছে। ইমরান খানও প্রতিজ্ঞা করেছিলেন দেশটি থেকে এই সংস্কৃতি নির্মূল করবেন। তবে বাধা হয়ে আছে আমলাতন্ত্র। সম্প্রতি সেখানে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জন্য একধরনের ওয়াশরুম বানিয়ে তাতে ‘ভিভিআইপিদের জন্য’ নামফলক বসানো হয়েছে, যা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হচ্ছে।

বাংলাদেশেও বিমানবন্দর থেকে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা পর্যন্ত সব পর্যায়ে ভিআইপি প্রথার পুনর্ভাবনা জরুরি। অবিলম্বে এ বিষয়ে জাতীয় নীতিমালা ঘোষণা দরকার। পাশাপাশি জনমনস্তত্ত্ব থেকেও এরূপ প্রথার উৎপাটন জরুরি। যেকোনো ধরনের বর্ণপ্রথা অশোভন, অগ্রহণযোগ্য এই বোধের জাগরণ ছাড়া ভিআইপি কালচার ঠেকানো যাবে না।

আলতাফ পারভেজ: গবেষক