সংখ্যালঘুর সুরক্ষার দায়িত্ব সংখ্যাগুরুর

প্রিয় সাহার দুই মিনিটের এক ভিডিও দেখে বাংলাদেশের অনেকে ক্ষুব্ধ। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে খুব গুছিয়ে তিনি কথাগুলো বলেননি, হোয়াইট হাউসের ওভাল অফিসে আমেরিকার প্রেসিডেন্টের সামনে গুছিয়ে কথা বলা খুব সহজ নয়। তা–ও দুই মিনিটে। একজন সংখ্যালঘু নারী কী কথা বললেন, কেন বললেন, তা ভালো করে না শুনে দেশের সংখ্যাগুরুর একাংশ বলতে শুরু করেছে, ‘এই দেশদ্রোহীকে জেলে ঢোকাও।’ ভাগ্যিস বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বিদেশ থেকেই বিষয়টিতে হস্তক্ষেপ করেছেন। বলেছেন, তিনি কথাগুলো কেন বলছেন, আগে ভালো করে শোনা যাক। তারপর ব্যবস্থা নেওয়া যাবে। 

পৃথিবীর সর্বত্রই সংখ্যালঘুরা নিগ্রহ ও বৈষম্যের শিকার। শুধু বাংলাদেশের হিন্দুরা নয়, ভারতের মুসলমান, ইরানের বাহাই, পাকিস্তানের আহমদিয়া, আমেরিকার আফ্রিকান-আমেরিকান অথবা ব্রাজিলের আদিবাসী ইন্ডিয়ান—এরা সবাই কমবেশি একই সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক ও দৈনন্দিন বৈষম্যের শিকার। তারা সংখ্যায় কম, অর্থ ও প্রতিপত্তিতে সংখ্যাগুরুর সঙ্গে পেরে ওঠা তাদের পক্ষে অসম্ভব। নিজের দেশ, অথচ নিত্যদিনের অপমান সহ্য করতে হয়। যেকোনো মাথায় লাঠির বাড়ি পড়তে পারে। পুলিশের কাছে গিয়ে লাভ নেই, সে–ও সংখ্যাগুরুর একজন। রাষ্ট্রের অন্তর্গত বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ভেতর এই যে বৈষম্য, রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা তার নাম দিয়েছেন ‘সমান্তরাল বৈষম্য’ বা ‘হরাইজন্টাল ইন-ইক্যুয়ালিটি’। একই দেশের মানুষ, আইনের খাতায় তাদের সমান অধিকার, কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে জাতিগত বা ধর্মীয় কারণে একে অপরের মধ্যে বিস্তর প্রভেদ। পাকিস্তানে পাঞ্জাবি না হলে সেনাবাহিনীতে চাকরি মিলবে না। তুরস্কে কুর্দি হলে অনেক সরকারি চাকরির জন্য যোগ্য বিবেচিত হবে না। আমেরিকায় কালো বা মুসলিম হলে তার দ্বিতীয় দফা ‘ব্যাকগ্রাউন্ড চেক’ করা হবে। 

এই বৈষম্যের কথা মাথায় রেখে প্রায় সোয়া শ বছর আগে মহাত্মা গান্ধী বলেছিলেন, একটা জাতি কতটা সভ্য, তা বোঝার উপায় সে জাতির বা দেশের সংখ্যালঘুদের অবস্থা কেমন, তা পরখ করে দেখা। অধিকার ভোগের ক্ষেত্রে তারা কতটা সংখ্যাগুরুর নিকটবর্তী, সেই হিসাবটা করা। সংখ্যালঘুর অধিকার সুরক্ষার দায়িত্ব সংখ্যাগুরুর, এ কথাও গান্ধী আমাদের বলেছিলেন। শুধু বলেননি, নিজের জীবন বাজি রেখে সংখ্যালঘুর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। 

বাংলাদেশের সংখ্যালঘুরা ভালো নেই, এ কোনো নতুন কথা নয়। ১৯৪৭ সালের পর দেশে যত দাঙ্গা হয়েছে, তার প্রতিটির শিকার দেশের সংখ্যালঘুরা। এই বৈষম্যের নথিপত্র অনেক আগে থেকেই করা হয়েছে। শুধু সংখ্যালঘুদের হাতে নয়, সংখ্যাগুরু মুসলিমদের দ্বারাও সে নথিপত্র তৈরি হয়েছে। শুধু দাঙ্গার সময় নয়, প্রাতিষ্ঠানিক নিয়মের ঘেরাটোপে সংখ্যালঘুরা কীভাবে অধিকার বঞ্চিত হয়, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বা যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট প্রতিবছর সে বৈষম্য ও নির্যাতনের বিবরণ দিয়েছে। তবে এ কথায় ভুল নেই, অবস্থা আগের চেয়ে অনেক ভালো। দেশের সংখ্যালঘুরা নিজেরাই সে কথা স্বীকার করে। চাকরির ক্ষেত্রে বৈষম্য কমেছে, নীতিনির্ধারণী দায়িত্বে সংখ্যালঘুদের সংখ্যা বেড়েছে, ঋণপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিবন্ধকতা হ্রাস পেয়েছে। কিন্তু অবস্থা এখনো উদ্বেগজনক, সাধারণ মানুষ এখনো দৈনন্দিন বৈষম্যের শিকার। এ জন্য হিউম্যান রাইটস ওয়াচের রিপোর্ট পড়তে হবে না, দৈনিক পত্রিকা পড়লেই সে কথা বোঝা যাবে। 

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ তাদের ২০১৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে সে কথা স্বীকার করে অবস্থা আরও উন্নত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। যেমন তারা প্রতিশ্রুতি দিয়েছে প্রবল বৈষম্যমূলক অর্পিত সম্পত্তি আইন সংশোধনী আইনের মাধ্যমে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রকৃত স্বত্বাধিকারীদের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হবে। সংখ্যালঘুদের প্রতি বৈষম্য রোধে নতুন সুরক্ষা আইন প্রণয়নের পাশাপাশি একটি সংখ্যালঘু কমিশন গঠনের কথাও এতে বলা হয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, এই ইশতেহারে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে, সংখ্যালঘুদের প্রতি বৈষম্যমূলক ‘সকল আইন ও অন্যান্য অন্যায় ব্যবস্থার’ অবসান করা হবে। 

প্রিয় সাহা অভিযোগ করেছেন, বাংলাদেশ থেকে পৌনে চার কোটির মতো মানুষ ‘নিখোঁজ’ হয়েছে। কোনো সময়সীমা তিনি উল্লেখ করেননি। তিনি ইংরেজি ‘ডিজঅ্যাপিয়ার’ কথাটি ব্যবহার করেছেন, তাতে কেউ কেউ ক্রুদ্ধ হয়েছেন। বলাই বাহুল্য, এত কোটি মানুষ গুম বা খুন হয়েছে, সে কথা তিনি বোঝাননি। জাতীয় জনসংখ্যা গণনায় স্বাভাবিক প্রবৃদ্ধিগত কারণে দেশে যত হিন্দু থাকার কথা, তা নেই। এ কারণে তারা হিসাবের খাতায় অনুপস্থিত। তুলনা হিসাবে স্মরণ করুন, বাঙালি অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের দাবি, চীনে ১০ কোটি শিশুকন্যা ‘মিসিং’। না, এরা খুন হয়নি, এদের গুম করা হয়নি। এরা ‘মিসিং’, কারণ জনসংখ্যার স্বাভাবিক বৃদ্ধিতে চীনে শিশুকন্যার সংখ্যা যত হওয়ার কথা, বাস্তবে তাদের সংখ্যা ১০ কোটি কম। সবাই ছেলেসন্তান চায়, ফলে যেসব কন্যাশিশুর জন্মানোর কথা, তাদের জন্মই হয়নি। এদের ‘মিসিং’ বলুন, ‘ডিজঅ্যাপিয়ার’ বলুন, তাতে বাস্তবতার কোনো হেরফের হবে না। 

প্রিয় সাহা পৌনে চার কোটি হিন্দু ‘নিখোঁজ’ হওয়ার কথা বলেছেন। একজন খ্যাতনামা বাংলাদেশি অর্থনীতিবিদ, যিনি সরকারি দলের থিংক ট্যাংকের সদস্য হিসেবে পরিচিত, তিনি বলেছেন আরও সাংঘাতিক কথা। অধ্যাপক আবুল বারকাত বলেছেন, যে হারে হিন্দুরা দেশত্যাগ করছে, প্রিয় সাহা যাকে ‘ডিজঅ্যাপিয়ার’ বলেছেন বলে এই লেখকের মনে হয়েছে, তাতে এখন থেকে ৩০ বছর পরে বাংলাদেশে কোনো হিন্দুই অবশিষ্ট থাকবে না। তাঁর হিসাবে, ২০০১-১৩ সালের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে গড়ে প্রতিদিন ৭৭৪ জন হিন্দু দেশত্যাগ করেছে। এই হার আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। 

হিন্দুরা কেন নিজ বসতবাটি ছেড়ে ‘নিখোঁজ’ হয়? উত্তরটা আমাদের সবার জানা, তারা নিজ দেশে নিরাপদ বোধ করে না, তাই। যাঁরা প্রিয় সাহার ওপর ক্ষুব্ধ, তাঁরা হয়তো লক্ষ করেননি তিনি কিন্তু দেশ ছেড়ে যেতে চান না। তিনি এই দেশেই থাকতে চান, এই জন্য তিনি সাহায্য চান। আমার এক বামপন্থী বন্ধু ফেসবুকে প্রশ্ন করেছেন, এই সাহায্য ট্রাম্পের কাছে চাইতে হবে কেন? উত্তরটা সোজা। কারণ, আপনারা তাঁর সুরক্ষায় ব্যর্থ হয়েছেন, তাই। প্রিয় সাহার নিজের পৈতৃক বসতবাড়ি আক্রান্ত হয়েছে, আগুনে পুড়েছে। এই অভিযোগ নিয়ে প্রেসক্লাবের সামনে প্রতিবাদ সভা করেছেন, বিচার চেয়েছেন। বিচার পাননি। 

ট্রাম্প কী করবেন যখন প্রশ্ন উঠলই, তখন মনে করিয়ে দিই বাংলাদেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক দলই নিজেদের প্রয়োজনে আমেরিকার হস্তক্ষেপ প্রার্থনা করেছে। গত বছর নির্বাচনের আগে ওয়াশিংটনে দল বেঁধে এসেছিলেন বিরোধী বিএনপির নেতারা। ট্রাম্প পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেননি, হেরিটেজ ফাউন্ডেশনের পাতি নেতাদের সঙ্গে প্রাতরাশ বৈঠক করে সেই একই প্রার্থনা করেছেন। কই, তখন তো এই সব বামপন্থী বন্ধুকে প্রশ্ন করতে শুনিনি, এ জন্য ট্রাম্প কেন? 

স্বীকার করি বা না করি, এ কথায় কোনো ভুল নেই, আমরা, দেশের সংখ্যাগুরুরা সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষার দায়িত্ব পালন করতে পারিনি। এরা আমাদের লাগোয়া ঘরে থাকে, অথচ নিত্যদিন যে লাঞ্ছনার শিকার, তা আমরা জেনেও না জানার ভান করি। ঢাকায় আমার এক হিন্দু বন্ধু জানিয়েছিলেন, তাঁর মা ঘরে ধূপ জ্বেলে পূজা করেন। প্রতিবেশীরা জেনে যাওয়ায় বাড়ির মালিক তাঁদের সে বাড়ি ছেড়ে যেতে বাধ্য করেছিলেন। ২০০১ সালে ভোলায় দাঙ্গার পর হিন্দু নারীরা ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন। 

সংখ্যালঘুদের শুধু হিন্দু বা খ্রিষ্টান না ভেবে আমরা যদি তাদের প্রতিবেশী–স্বজন বলে ভাবা শিখি, বিপদে তাদের পাশে এসে দাঁড়াই, তাহলে কোনো প্রিয় সাহাকে বিদেশি নেতার কাছে নিরাপত্তার জন্য আবেদন করতে হবে না। 

হাসান ফেরদৌস যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি