ট্রাম্প, জনসন ও গণতন্ত্রের সংকট

বরিস জনসন ও ডোনাল্ড ট্রাম্প। রয়টার্স ফাইল ছবি
বরিস জনসন ও ডোনাল্ড ট্রাম্প। রয়টার্স ফাইল ছবি

বিশ্বের সবচেয়ে দুই প্রভাবশালী ও ‘পূজনীয়’ গণতান্ত্রিক দেশ যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের হাল ধরে আছেন বরিস জনসন ও ডোনাল্ড ট্রাম্প। তাঁরা দেশ দুটির গণতন্ত্রকে শেষ পর্যন্ত কোথায় নিয়ে দাঁড় করাবেন, সে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। ট্রাম্প সম্প্রতি জনসনকে ‘ব্রিটেনের ট্রাম্প’ বলে সম্বোধন করেছেন। এর মধ্যে তাঁদের ব্যক্তিত্ব ও স্টাইলের মিলের বিষয়টি উঠে এসেছে। এই দুই দেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর চরম ব্যর্থতার কারণে যে তাঁদের মতো নেতারা গদিতে বসতে পেরেছেন, তা এখন স্পষ্টভাবে প্রতিভাত হচ্ছে। 

ট্রাম্প ও জনসন উভয়কেই আইরিশ চিকিৎসক ও মনোবিদ ইয়ান হিউস ‘মানসিক ভারসাম্যহীন’ বলেছেন। ট্রাম্প একজন প্রমাণিত ক্রনিক মিথ্যাবাদী, বিকটতম বর্ণবাদী এবং বিশাল মাপের কর ফাঁকিবাজ। 

ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারকাজের অনিয়ম বিষয়ে টানা ২২ মাস তদন্তের পর মার্কিন স্পেশাল কাউন্সেল রবার্ট মু্যলার যে প্রতিবেদন দিয়েছেন, তাতেও ট্রাম্পের ন্যায়বিচারে বাধা দেওয়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে। এ পর্যন্ত অন্তত ২০ জন নারী তাঁর বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ এনেছেন এবং তাঁর অনৈতিক সম্পর্কের বিষয়ে মুখ বন্ধ রাখতে কোনো কোনো নারীকে নিজের অ্যাটর্নির মাধ্যমে অর্থকড়িও দিয়েছেন বলে খবর বেরিয়েছে। 

ঠিক একইভাবে জনসনের ব্যক্তিগত স্বভাবচরিত্রে যথেষ্ট অসংযম দেখা গেছে। তিনিও ক্রনিক মিথ্যাবাদী হিসেবে সমধিক পরিচিত। দুবার বিয়ে করেছেন। কিন্তু দুবারই সংসার ভেঙেছে। বর্তমানে যে বান্ধবীর সঙ্গে থাকেন, প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দিন সন্ধ্যায়ও তাঁদের মধ্যে তীব্র কলহ হয়েছে বলে সংবাদমাধ্যমে খবর এসেছে। মিথ্যা বলা ও মিথ্যা তথ্য দেওয়া এবং অসভ্য আচরণের জন্য এর আগে বারবার তিনি চাকরিচ্যুত হয়েছেন। যে অভিযোগ তুলে জনসন ২০১৬ সালে ব্রেক্সিট আন্দোলনে লোকজনকে উত্তেজিত করে তুলেছিলেন, তা মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকা অবস্থায় তিনি দুবার দুটি গোয়েন্দা তথ্য ফাঁস করেছিলেন। এর একটি ছিল লিবিয়ার বিষয়ে ফ্রান্সের গোয়েন্দা তথ্য এবং অপরটি হলো ইরান বিষয়ে যুক্তরাজ্যের গোপন প্রতিবেদন। 

ট্রাম্পের দায়িত্ব পালনের যে রেকর্ড, তার দিকে নজর বোলালে দেখা যাবে তাঁর শাসনপদ্ধতি একের পর এক রাজনৈতিক বিভ্রান্তি তৈরি করছে। তাঁর নীতিগুলো সাধারণের মধ্যে অজনপ্রিয় এবং তাঁর নীতির মধ্যে খুব কমগুলোতেই বেশির ভাগ জনমতের প্রতিফলন দেখা গেছে। ট্রাম্প যেটিকে তাঁর সবচেয়ে বড় বিজয় হিসেবে মনে করেন, সেটি হলো কর ছাড় আইন পাস করা। এই আইন পাস হলেও এখন পর্যন্ত এটি সবচেয়ে বেশি অজনপ্রিয় আইন। একইভাবে জলবায়ু পরিবর্তন, অভিবাসন, মেক্সিকো সীমান্তে দেয়াল বানানো, সামাজিক খাতে ব্যয় হ্রাস, ওবামাকেয়ারের প্রধান প্রধান অনুবিধি বাদ দেওয়া, ইরান চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসা ইত্যাদি নীতি অজনপ্রিয়। 

অনেক অজনপ্রিয় জরুরি আদেশ ট্রাম্প তাঁর নির্বাহী আদেশ দিয়ে পাস করিয়েছেন। বাস্তবতা হলো যুক্তরাষ্ট্র এখন এক ব্যক্তির শাসনের খুব কাছাকাছি অবস্থান করছে। জনসনের বেলাতেও প্রায় একই ঘটনা দেখতে পাচ্ছি। যে ব্রেক্সিট আন্দোলনের ওপর ভর করে জনসন ক্ষমতায় এসেছেন, জনমত সেই ব্রেক্সিটের বিপক্ষে চলে যাচ্ছে। জনগণ ও পার্লামেন্টের অধিকাংশ সদস্য চুক্তি ছাড়াই ব্রেক্সিটের বিপক্ষে থাকলেও জনসন বলেছেন, প্রয়োজনে চুক্তি ছাড়াই তিনি যুক্তরাজ্যকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বের করে আনবেন। 

এখন অবধারিতভাবেই প্রশ্ন উঠছে, এত অজনপ্রিয় নীতি বাস্তবায়ন করার পরও এই দুই মানসিক ভারসাম্যহীন লোক কীভাবে শাসক হিসেবে গদিতে আছেন? উত্তর হলো, উদারপন্থী গণতান্ত্রিক দলগুলো সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক চাওয়া পূরণ করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। এ কারণে তঁারা ট্রাম্প এবং বরিস জনসনের মতো নেতার প্রতি ঝুঁকেছেন। তাঁরা জনগণকে, বিশেষত জাতীয়তাবাদী চেতনায় বিশ্বাসী ভোটারদের বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন, তাঁদের হাত ধরেই জনগণের স্বার্থ সংরক্ষিত হতে পারে। 

 উভয় নেতাই বয়স্ক ও রক্ষণশীল ভোটারদের প্রায় শতভাগ সমর্থন আদায় করতে সক্ষম হয়েছেন। আমেরিকার বয়স্ক শ্বেতাঙ্গ ভোটারদের মধ্যে সাদাদের শ্রেষ্ঠত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠার যে মোহ আছে, তাকে শতভাগ কাজে লাগিয়েছেন ট্রাম্প। একইভাবে ব্রিটিশ নাগরিকদের একটি অংশ আছে, যারা যুক্তরাজ্যকে আগের মতো প্রভাবশালী অবস্থায় দেখতে চায়। তাঁরাও মনে করেন, জনসনের পক্ষে সেটি করা সম্ভব হতে পারে। 

ইংরেজি থেকে অনূদিত। স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট

জেফরি ডি স্যাক্স কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্যনীতি ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষক