দুধে বিষ, গবেষণায় ষড়যন্ত্র: মেশাল কে?

ঈশ্বরী পাটনিকে খুব মনে পড়ছে। ওই যে ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্যের ঈশ্বরী পাটনি। কী দারুণ প্রত্যাশায় তিনি বর চেয়েছিলেন, ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে।’ এ এক বিরাট প্রত্যাশা। বিরাট যে তা মঙ্গলকাব্যের যুগ পেরিয়ে দারুণ বাস্তবে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘দুধে ভাতে উৎপাত’ গল্পে এসেই ঢের টের পাওয়া গেছে। কিন্তু এই প্রাজ্ঞ আখতারুজ্জামান ইলিয়াসও কি ভেবেছিলেন, দুধ নিয়েই একদিন ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা সৃষ্টি হবে এ জনপদে। ভাবেননি হয়তো। তিনি এই দেশের দরিদ্র জনপদের নিত্যকার বাস্তবতা তুলে আনতে চেয়েছিলেন, যা এখনো খুব একটা বদলায়নি।

দুধে জল মেশানো নিয়ে কত গাথা, কত গপ্পো তৈরি হয়েছে এই দেশে। একসময় এই দেশে গোয়ালার দুধে জল দেওয়াটাই দস্তুর হয়ে গেছে। এ নিয়ে তর্ক চলে, কিন্তু পিঠটান চলে না। ফলে, গোয়ালার সঙ্গে বচসা ও তার কাছ থেকে ‘দুধ রোজ’ একসঙ্গেই চলতে পারে। এই নিত্যতর্কাতর্কি যাদের ঠিক ধাতে সয় না, তাদের জন্য আশীর্বাদ হয়ে এসেছিলেন পাস্তুর মশাই। বলা হচ্ছে বিজ্ঞানী লুই পাস্তুরের কথা। সেই কবে তিনি পাস্তুরীকরণের পদ্ধতি বাতলে গেছেন। তারপর থেকে সেই যে শুরু হলো, এখনো চলছে। বিজ্ঞাপন হচ্ছে, ‘পাস্তুরিত’ তরল দুধের। কিন্তু এই ২০১৯ সালে এসে আরেক বিজ্ঞানী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োমেডিক্যাল রিসার্চ সেন্টারের পরিচালক ও ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক এ বি এম ফারুক দিলেন বড়সড় ঝাঁকুনি।

লুই পাস্তুরের পসার মৃত্যুর পরও যে কতটা, তা বেশ ভালোভাবে বোঝা গেল এ বি এম ফারুক কথা বলার পর। কারণ, তিনি বাংলাদেশের বাজারে থাকা বিভিন্ন কোম্পানির পাস্তুরিত তরল দুধের মান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। এসব দুধে বিভিন্ন ধরনের অ্যান্টিবায়োটিকের অস্তিত্ব রয়েছে বলে তিনি জানান। পরীক্ষা করেই তিনি এ ফল পেয়েছেন। তাঁর কথা আমাদের জানাল যে ‘সকলই গরল ভেল’। দুধে জলের ভয়ে পাস্তুর সাহেবের ওপর ভরসা রেখে লাভ তো হচ্ছেই না, লোকসানই বেশি। প্যাকেটজাত দুধে এখন আর শুধু জলই নেই, ভারী ধাতুর অস্তিত্ব রয়েছে।

শুরুতেই ‘হা রে রে রে’ বলে তেড়ে এলেন প্রশাসনের নানা পর্যায়ের লোকেরা। অধ্যাপক ফারুকের সহকর্মীরাও কম যাবেন কেন; তাঁরাও বললেন, এর সঙ্গে তাঁদের কোনো সম্পর্ক নেই। সবাই মিলে গবেষণাটির ফলকে আমলে নেওয়ার বদলে গবেষণাটি কেন করা হলো, তা নিয়েই মেতে উঠল। এ এক দারুণ ব্যাপার। সবার ভাবটা এমন যে এই এ বি এম ফারুকই হচ্ছেন সেই প্রখ্যাত গোয়ালা, যিনি দুধে শুধু জলই নয়, বিষও মেশাচ্ছেন! ভাবতে ইচ্ছে হয়, তখন ঈশ্বরী পাটনি অলক্ষ্যে বসে কী ভাবছিলেন?

এই যখন অবস্থা, তখন একটি রিট হলো। দুধের মান নির্ণয় করে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে করা এ রিট আবেদন আমলে নিয়ে হাইকোর্ট আদেশ দিলেন বিএসটিআইকে। তারা বাজারে থাকা বিভিন্ন কোম্পানির দুধের নমুনা পরীক্ষা করে জানাল, ঘটনা সত্য, বিষ আছে। দুধে মানুষের জন্য ক্ষতিকর পদার্থ রয়েছে বলে জানানোর পর হাইকোর্ট ১৪টি কোম্পানির পাস্তুরিত তরল দুধের উৎপাদন, সরবরাহ ও বিক্রি পাঁচ সপ্তাহের জন্য বন্ধের নির্দেশ দেন। আদেশটি আসে ২৮ জুলাই। ১৪ জুলাই চারটি ল্যাবকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল বিএসটিআইয়ের সনদধারী সব কোম্পানির দুধের মান যাচাই করে এক সপ্তাহের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে। এই চার ল্যাব হলো ন্যাশনাল ফুড সেফটি ল্যাবরেটরি, বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ, আইসিডিডিআরবি ও সাভারের বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষণাগার। আদালতের আদেশ প্রতিপালন করে সংশ্লিষ্টরা আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করলে হাইকোর্ট ১৪ কোম্পানির দুধ উৎপাদন ও বিপণনে নিষেধাজ্ঞা দেন।

মজার বিষয় হলো পরদিনই নিষেধাজ্ঞা থেকে মুক্তি পায় মিল্ক ভিটা। তার পরদিন আরও দুটি কোম্পানির ওপর থেকেও নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়। ভাবতে ভালো লাগে, মাত্র এক দিনেই সব মান অর্জন করে এই যোগ্যতা অর্জন করেছে কোম্পানিগুলো। এত দ্রুত ও সফল পদক্ষেপের জন্য কোম্পানিগুলোকে অবশ্যই পুরস্কৃত করা উচিত। অন্য কোম্পানিগুলোও একই পথে কয়েক দিনের মধ্যে হাঁটবে এবং তাদের সাফল্যও আমরা নিশ্চয় দেখব। এই দেশে এ ধরনের সাফল্য বড় সংক্রামক।

এই যখন অবস্থা, তখন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিয়ে এলেন সম্পূর্ণ ভিন্ন এক আঙ্গিক। তিনি বললেন, বিদেশি দুধের আমদানিকারকদের যোগসাজশে এ ধরনের গবেষণা হতে পারে। লক্ষ্য, দেশীয় দুধ উৎপাদক ও কোম্পানিগুলোকে বিপদে ফেলা। সংশ্লিষ্ট গোষ্ঠীটি এমনকি দেশের স্বয়ংসম্পূর্ণতার জন্যই হুমকি।

৩০ জুলাই বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের বিশেষ সভায় লন্ডন থেকে ফোনে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘হঠাৎ কথা নেই, বার্তা নেই, একজন দুধ পরীক্ষা করে বলে দিলেন, দুধ ব্যবহারযোগ্য নয়। এবং সঙ্গে সঙ্গে রিট করা হয়। সেখানে বলে দেওয়া হয়, পাঁচ সপ্তাহ দুধ ব্যবহার করা যাবে না বা খাওয়ানো যাবে না। আমাদের যে দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচি, সাধারণ মানুষের যে বেঁচে থাকার পথগুলো সৃষ্টি করা, সেগুলো কেন বাধাগ্রস্ত করা হয়? এটাই আমার প্রশ্ন।’

শিশুখাদ্য দুধের বিশুদ্ধতার প্রশ্নটিও তো গুরুত্বপূর্ণ। হাইকোর্ট আদেশ দেওয়ার আগে চারটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা প্রতিষ্ঠানে দুধের মান যাচাইয়ের নির্দেশ দিয়েছিলেন। সেই প্রতিবেদন হাতে পেয়েই এই নিষেধাজ্ঞা। যদি এটি নিয়ে প্রশ্ন তুলতে হয়, তাহলে ওই চার প্রতিষ্ঠানের মধ্যে থাকা তিনটি সরকারি প্রতিষ্ঠান ও একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের পরীক্ষাগার ও সেখানে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ নিয়েই প্রশ্ন তুলতে হয়।

প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, বিদেশ থেকে আসা গুঁড়ো দুধের মান যাচাইয়ে পদক্ষেপ নিতে। এটি অত্যন্ত ভালো প্রস্তাব। সাধারণ মানুষও জানতে চায়, তরল দুধের যখন এই অবস্থা, তখন গুঁড়ো দুধের কী হাল? সেখানে উৎপাত কতটা?

প্রধানমন্ত্রীর উদ্বেগ খুব স্বাভাবিক। ১৪টি কোম্পানির তরল দুধে নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর খামারিরা রাস্তায় দুধ ঢেলে প্রতিবাদ করেছেন। এটি সবাইকে ভাবিয়ে তুলেছে। কারণ, এই দুধ বিক্রিটা তাঁদের বাঁচামরার প্রশ্ন হতে পারে। কিন্তু ওই ১৪ কোম্পানির বাজারজাত করা দুধে যে ক্ষতিকর পদার্থ রয়েছে, তা তো বলছে দায়িত্বশীল চার প্রতিষ্ঠানই। তাহলে উপায়?

এ এক দারুণ চক্রে পড়া গেল দেখি! কী করা। তবে গোখাদ্যে নজর দেওয়া যাক। সাধারণ বুদ্ধিমাত্রই এটা বলবে। কারণ, কোনো খামারি বা সংশ্লিষ্ট আর কেউ যেচে পড়ে দুধে অ্যান্টিবায়োটিক মেশাতে যাবে না। এটি আকাশ থেকেও আসবে না। এর উৎস হতে পারে গোখাদ্যই। এটি খুঁজে দেখা উচিত। কোনো এক ব্যক্তি বা কোনো গোষ্ঠীর ষড়যন্ত্র হিসেবে না দেখে এর সত্যিকার অবস্থা, এর কারণ ও উত্তরণের উপায় খুঁজে দেখা ও সেই মতো ব্যবস্থা নেওয়াটাই জরুরি। কোনো ষড়যন্ত্র তত্ত্ব সামনে না এনে, আদৌ কোনো ষড়যন্ত্র আছে কি না, থাকলে কে বা কারা জড়িত, দুধে কী কী উপাদান পাওয়া গেছে, তার বিস্তারিত তুলে ধরার মাধ্যমে এর সুরাহা হওয়া দরকার। আর কারও বক্তব্য বা বিবৃতি দিয়ে না করে ওই চার প্রতিষ্ঠানের করা পরীক্ষার ফলটি প্রকাশ করা হোক। কারণ, এর সঙ্গে শিশুদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টি সরাসরি জড়িত।

ফজলুল কবির: সাংবাদিক
[email protected]