টমাস উইলিয়ামস ও বঙ্গবন্ধু হত্যার তদন্ত

সোহরাব হাসান
সোহরাব হাসান

স্যার টমাস উইলিয়ামস (১৯১৫-১৯৮৬) এ দেশের মানুষের কাছে পরিচিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার একজন বিশেষজ্ঞ আইনজীবী হিসেবে। তখন তিনি ব্রিটেনের রানি এলিজাবেথের আইনজীবী ছিলেন এবং প্রবাসী বাঙালিদের আমন্ত্রণে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের পক্ষে আইনি লড়াই চালাতে ১৯৬৮ সালের জুলাই মাসে ঢাকায় আসেন।

১৯৭৫ সালে যখন বঙ্গবন্ধু সেনাবাহিনীর কতিপয় বিপথগামী সদস্যের হাতে নিহত হন, তখন টমাস উইলিয়ামস ছিলেন হাউস অব কমন্সের সদস্য। ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ দ্বারা দেশে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের পথ রুদ্ধ ছিল। এই প্রেক্ষাপটে লন্ডনে টমাস উইলিয়ামসের নেতৃত্বে তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়েছিল, যার শিরোনাম ছিল ‘শেখ মুজিব মার্ডার ইনকোয়ারি’ বা শেখ মুজিব হত্যা তদন্ত। এই কমিশনের অপর দুই সদস্য ছিলেন নোবেল পুরস্কার বিজয়ী আইরিশ কৌঁসুলি ও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সাবেক মহাসচিব জেফ্রি টমাস ও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সাবেক সভাপতি ও শ্রমিকদলীয় সাংসদ সন ম্যাকব্রাইড। এ ছাড়া কমিশনের সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ব্রিটিশ আইনজীবী অব্রে রোজ।

উল্লেখ্য, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের প্রধান হিসেবে সন ম্যাকব্রাইড ১৯৭৭ সালের এপ্রিল মাসে বাংলাদেশ সফর করেন। বঙ্গবন্ধু ও জেলহত্যার বিচারে আইনগত কী বাধা আছে, সে সম্পর্কে খোঁজখবর নেওয়া ছিল তাঁর উদ্দেশ্য। ম্যাকব্রাইড বিষয়টি নিয়ে তৎকালীন সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেছিলেন। তাঁর জিজ্ঞাসার জবাবে জিয়া বলেছিলেন, ‘আইন নিজস্ব গতিতে চলবে।’ কিন্তু ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বজায় থাকায় আইন নিজস্ব গতিতে চলেনি।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে টমাস উইলিয়ামসের যুক্ত হওয়ার দুটি পর্ব। প্রথম পর্ব আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধুর পক্ষে আইনি লড়াই চালানো এবং দ্বিতীয় পর্বে বঙ্গবন্ধু হত্যা তদন্তের মাধ্যমে বিচারের বিষয়টি সামনে নিয়ে আসা।

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় টমাস উইলিয়ামসের যুক্ত হওয়া সম্পর্কে মামলায় বঙ্গবন্ধুর পক্ষের অন্যতম আইনজীবী মওদুদ আহমদ লিখেছেন, ‘টমাস উইলিয়ামসের নিযুক্তি চূড়ান্ত হওয়ার পর তা প্রকাশ্যে ঘোষণা করা হলে আইনজীবীদের মধ্যে উৎসাহ বেড়ে যায়। জুলাই মাসের তৃতীয় সপ্তাহে (১৯৬৮) টমাস উইলিয়ামসের উপস্থিতিতে আইনজীবীদের মধ্যে আরও উৎসাহ ও সাহস সঞ্চার হয় এবং জনগণ অভিযুক্ত ব্যক্তিদের পক্ষে সমর্থন জানাতে শুরু করেন। উইলিয়ামসসহ ২৫ জন আইনজীবীকে আগরতলা মামলায় অভিযুক্ত ব্যক্তিদের পক্ষে নিয়োগ করা হয়। সিদ্ধান্ত হয় যে টমাস উইলিয়ামস পুরো বিচারকালে উপস্থিত থাকতে পারবেন না বলে তিনি শুধু মামলার শাসনতান্ত্রিক দিকগুলো দেখবেন এবং সালাম খান (আইনজীবী প্যানেলের দ্বিতীয় প্রধান) বাকি সময়ে অভিযুক্তদের পক্ষে মামলায় নেতৃত্ব দেবেন। রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান সাক্ষী আমির হোসেনকে জেরা করার কথা ছিল উইলিয়ামসের। কিন্তু সরকার রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে তাঁকে আদালতে জেরা করতে দেয়নি। তবে টমাস উইলিয়ামস ট্রাইব্যুনালের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করেছিলেন। রিটের পরিপ্রেক্ষিতে তৎকালীন ঢাকা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ সরকারের প্রতি রুলনিশি জারি করেন।’ (বাংলাদেশ: স্বায়ত্তশাসন থেকে স্বাধীনতা, ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, ঢাকা)

এই বাস্তবতায় টমাস উইলিয়ামসকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার শুনানিতে অংশ না নিয়েই ঢাকা ত্যাগ করতে হয়। কিন্তু বাংলাদেশের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ অব্যাহত ছিল। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের প্রতি তাঁর সমর্থন ছিল। বঙ্গবন্ধু হত্যার পাঁচ বছর পর ১৯৮০ সালে তাঁকে বঙ্গবন্ধু পরিবার ও প্রবাসী আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধু পরিষদের ইউরোপীয় শাখার সভাপতির দায়িত্ব নেওয়ার অনুরোধ জানানো হলে তিনি সানন্দে গ্রহণ করেন। ১৯৮০ সালের ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মবার্ষিকীতে হাউস অব কমন্সের কমিটি রুমে আয়োজিত আলোচনা সভায় টমাস উইলিয়ামস যে বক্তব্য রেখেছিলেন, তা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করতে ভালোবাসি এবং বিশ্বাস করি যে শেখ মুজিব আমার বন্ধু ছিলেন। আমি তাঁকে জানতে পেরে এবং তাঁর জন্য ও তাঁর সঙ্গে কাজ করতে পেরে গর্বিত। আমার এই কথা ভাবতে ভালো লাগে যে আমি যখন তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে ছিলাম, তখন অনেকের সঙ্গেই আমার বন্ধুত্ব হয়েছিল, যাঁরা সবাই আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় আমার সহযাত্রী ছিলেন এবং বাংলাদেশ যে স্বাধীন হয়েছে, সেটি ছিল তার সূচনা পর্ব।’

সে সময়ের কথা স্মরণ করে উইলিয়ামস আরও বলেন, ‘সেই কতকাল আগে, ১৯৬৮ সালে, আমি ঢাকা গিয়েছিলাম বঙ্গবন্ধুর পক্ষে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা লড়তে। তারপর এল একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। তখনো আমি তোমাদের সঙ্গে ছিলাম। সে তো প্রায় ১০ বছর আগের কথা।...শেখ মুজিবের সঙ্গে যখন আমার প্রথম দেখা হয়, তিনি আমাকে বলেছিলেন যে তাঁর আরাধ্য কাজ অসমাপ্ত রেখে তিনি মারা যাবেন, তা তিনি বিশ্বাস করেন না। তাঁর এ বিশ্বাস হয়তো পুরোপুরি পূর্ণ হয়নি, কিন্তু এ কথা অবশ্যই স্বীকার্য যে যত দিন বাংলাদেশ থাকবে এবং যত দিন বাংলাদেশ বিশ্বের ইতিহাসের অংশ হয়ে থাকবে, তত দিন তাঁর মৃত্যু নেই। তাঁর দৈহিক মৃত্যু তাঁর নিজ পরিবারের জন্য বেদনাদায়ক, তাঁর বন্ধুদের জন্য দুঃখজনক, কিন্তু তার চেয়ে অনেক বেশি বেদনা ও দুঃখের ছিল বাংলাদেশের জন্য, যে বাংলাদেশ তাঁর মৃত্যুতে গভীর দুঃখ-দুর্দশায় নিমজ্জিত হয়েছিল।’

তাঁর শেষ মন্তব্য ছিল, ‘আমি মনে করি, বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু নেই, কেননা দুঃখ-দুর্দশার মধ্যেও বাংলাদেশ আবার যখন জেগে উঠবে, জাতিসত্তা পূর্ণতা পাবে, তখন তাঁর আত্মা আমাদের মধ্যে ফিরে এসে বলবে, তোমরা যদি আমার স্মৃতিচিহ্ন চাও, তবে তোমাদের চারদিকে তাকাও। আগামী দিনগুলোয় তাঁর স্মৃতি আমাদের মধ্যে জাগরূক হয়ে থাকবে এবং তা আমাদের অনুপ্রাণিত করবে। আমি আশা করি, যে স্বাধীন ও শক্তিশালী বাংলাদেশের স্বপ্ন তিনি দেখেছিলেন, তার মৃত্যু নেই।’

.
.

১৯৮০ সালের মাঝামাঝি টমাস উইলিয়ামস বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনাকে (বর্তমানে বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী) ব্রিটিশ পার্লামেন্টে আমন্ত্রণ জানান। ওই সাক্ষাতে শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধু হত্যা ও জেলহত্যা তদন্তের জন্য টমাস উইলিয়ামসকে একটি কমিশন গঠনের অনুরোধ জানালে তিনি সম্মতি দেন। টমাস উইলিয়ামস বলেন, হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্দেশ্যে ১৫ আগস্ট ও ৩ নভেম্বর হত্যাকাণ্ড-সম্পর্কিত যেসব দলিলপত্র তাঁদের কাছে আছে, বঙ্গবন্ধু সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন ও অন্যান্য আইনজীবীকে নিয়ে সেগুলো পরীক্ষা করে দেখবেন। কেননা ‘যাদের হাতে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর ঘনিষ্ঠ সহকর্মীদের রক্তের দাগ রয়েছে, তাদের বিচার করতেই হবে। শুধু বিচার করলেই চলবে না, বিচার করা হয়েছে বলে প্রতীয়মান হতে হবে।’

১৯ সেপ্টেম্বর লন্ডনের হাউস অব কমন্সের কাছে এক রেস্তোরাঁয় বঙ্গবন্ধু হত্যা তদন্ত কমিশনের সদস্যদের পক্ষ থেকে এক সংবাদ সম্মেলন আহ্বান করা হয়। সেখানে টমাস উইলিয়ামস বলেন, কমিশনের প্রথম কাজ হলো আইনের অবস্থান নির্ধারণ এবং লন্ডন থেকে তা করা যেতে পারে। কমিশনের দুটি বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে: ১. আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে বলে জিয়া যে আশ্বাস দিয়েছিলেন, তা বাস্তবে পরিণত হয়নি কেন? ২. বাংলাদেশে প্রচলিত ফৌজদারি আইনের আওতায় হত্যাকারীদের বিচার করা যায় কি না। তদন্তের আগেই যদি মনে হয়, অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা যেতে পারে, সে ক্ষেত্রে মামলা করার জন্য আমরা অ্যাটর্নি জেনারেলকে রাজি করানোর চেষ্টা করব। অ্যাটর্নি জেনারেলকে দিয়ে মামলা করানো সম্ভব না হলে কমিশন বিষয়টি জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের কাছে পেশ করবে।’ এর আগে কমিশনের সদস্যরা ১৮ সেপ্টেম্বর একটি বৈঠক করেন।

১৯ সেপ্টেম্বরে কমিশনের পক্ষ থেকে পাঠানো প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়:
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে শেখ মুজিব ও তাঁর পরিবারের সদস্য, ২/৩ নভেম্বর চার রাজনৈতিক নেতার হত্যাকারীদের বিচারের আওতায় আনার ব্যর্থতায় বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বিভিন্ন মহলের উদ্বেগ অব্যাহত রয়েছে। শেখ মুজিব ও অন্যান্য নিহত ব্যক্তির পরিবারের আবেদন এবং ব্রিটেন, ইউরোপ ও বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে জনসমাবেশ থেকে গভীর উদ্বেগ প্রকাশের প্রত্যুত্তরে টমাস উইলিয়ামস কিউসি এমপির সভাপতিত্বে এবং অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সাবেক সভাপতি সন ম্যাকব্রাইড, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মহাসচিব ও নোবেল বিজয়ী জেফ্রি টমাসের সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। অব্রে রোজ এই কমিটির সচিবের দায়িত্ব পালন করবেন। এতে আরও জানানো হয়, কমিশনের সদস্যরা শিগগিরই বাংলাদেশ সফর করবেন। কিন্তু ১৯৮১ সালের জানুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে আইনজীবী অব্রে রোজ ও জেফ্রি টমাস বাংলাদেশ মিশনে ভিসার জন্য আবেদন করলে তা নামঞ্জুর হয়।

এর আগেই বাংলাদেশ সরকার টমাস উইলিয়ামসকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে। তিনি লিখেছেন, বাংলাদেশ দ্বিতীয় দেশ, যে তাঁকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করল। প্রথম দেশটি হলো জেনারেল আগাস্তো পিনোশের চিলি। ঢাকার ব্রিটিশ হাইকমিশনও কমিশন সদস্যদের আগেই সতর্ক করে দিয়েছিল যে তাঁরা যেন ভিসা ছাড়া বাংলাদেশে না আসেন।

বাংলাদেশে না আসতে পেরে তদন্ত কমিশন ১৯৮২ সালের ২০ মার্চ লন্ডনেই প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করে, যাতে তিনটি বিষয়কে গুরুত্ব দেওয়া হয়: ১. আইন ও বিচারকে নিজস্ব গতিতে চলতে দেওয়া হয়নি, ২. আইনকে নিজস্ব গতিতে চলতে না দেওয়ার জন্য সরকারই দায়ী এবং ৩. দায়মুক্তির বিধান তুলে নিয়ে বিচারের পথ উন্মুক্ত করতে হবে।

সোহরাব হাসান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
[email protected]