নিকটতম প্রতিবেশী, ঘনিষ্ঠতম ঘাতক

.
.

আমাদের ঘরবাড়ি তাদের ঘরবাড়ি। আমাদের রাজধানী তাদের উপনিবেশ। আমাদের রক্ত তাদের খাদ্য, আমাদের জীবন তাদের শিকার। শহর বড় হচ্ছে, বাড়ছে তাদেরও আবাসন। উন্নয়নের গতি আর তাদের বংশবৃদ্ধির গতি রেলের দুটি লাইনের মতো বহে সমান্তরাল। তারাই আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী, ঘনিষ্ঠতম ঘাতক। তারা মশা, আমাদের সহচর।

কিন্তু মশা প্রজাতির জনক কে? অপরিকল্পিত নগরায়ণের নায়ক যারা, তারাই তাদের পিতা। ডেঙ্গু মহামারির জন্য দায়ী মশা হলেও এডিস মশার জন্য দায়ী অপরিকল্পিত ও অমানবিক নগরায়ণ।

রাজধানী হলো দেশের প্রচ্ছদ। সেই প্রচ্ছদ তেমনই হয়, যেমন হয় সে দেশের শাসকেরা। বাংলাদেশের মন্ত্রী-এমপি-সচিব-ধনীদের বিপুল অংশের পরিবার বিদেশে থাকলেও সাড়ে নব্বই ভাগেরই ব্যবসা ও ক্ষমতার আসন ঢাকায়। এখানে তাদের বাড়িঘরও আছে। কিন্তু দেখুন, কী হাল করে রেখেছেন তাঁরা তাঁদের সাধের ক্ষমতাকেন্দ্রের!

অতি বাড় ভালো না জেনেও বাড়তে বাড়তে সীমা ছাড়াচ্ছে রাজধানী। অভিস্রবণের নিয়মে সেই অতিকায় রাজধানী আবাদ-বন-জলা গিলতে গিলতে জোড়া লাগতে চাইছে আমজনতার আমধানীগুলির সঙ্গে। ঢাকা চলে যাচ্ছে কুমিল্লার কাছে, কুমিল্লা ছুঁয়ে ফেলছে ফেনীকে, ফেনীর গায়ে গা ঘেঁষছে চট্টগ্রাম। এদিকে নারায়ণগঞ্জ-মুন্সিগঞ্জ, ওদিকে সাভার-মানিকগঞ্জও হয়ে পড়ছে ঢাকাময়। মহানগর বানিয়েছে বটে, মহানাগরিক সেবাব্যবস্থা বানাবার দরকার মনে করেনি কোনো সরকার।

উড়ালসড়ক, মেট্রোরেল, উঁচু উঁচু ভবন বানানো হচ্ছে। আকাশচুম্বী খরচের বিশ্বরেকর্ড গড়া হচ্ছে। দুধের শিশু বড় হয়ে স্কুলে যাচ্ছে কিন্তু নির্মাণকাজ আর শেষ হয় না। এখন জানা গেল, এসব নির্মাণকাজের জমা পানি, অস্বাস্থ্যকর আবাসনই ডেঙ্গু–চিকুনগুনিয়া জাতীয় রোগের খামার। দিল্লির ডেঙ্গু-দুর্যোগের জন্য দায়ী করা হয় নতুন নতুন অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্স নির্মাণকে। নির্মাণকর্মের জন্য জমানো পানির ট্যাংকগুলোই সেখানে মশার বৃন্দাবন। আমাদের বেলাতেও সেটাই হওয়ার কথা। সেরের ওপর সোয়া সের হয়েছে উড়ালসড়ক ও মেট্রোরেল নির্মাণের জন্য খোঁড়া খাদ ও তলায় জমা পানি।

জনস্বাস্থ্য ও টাকার মধ্যে জিতে যায় মশা ও রাজনীতি। বলবেন, এখানে আবার রাজনীতি এল কোত্থেকে? রাজনীতি সরকার তৈরি করে। সেই সরকার অকেজো বিটিভির জন্য প্রায় ১৮শ কোটি টাকা বাজেট দেয়, হাজার হাজার কোটি টাকার ঋণ খেলাপ হতে দেয়, পনের দিনে শেয়ার বাজার থেকে উবে যেতে দেয় ২৭ হাজার কোটি টাকা! কিন্তু স্বাস্থ্যকর আবাসন ও চিকিৎসাসেবার বেলায় বরাদ্দ ঢনঢনা। যে রাজনীতির সরকার মশা মারার প্রকল্পেও দুর্নীতি করে, সেই রাজনীতি টিকিয়ে রেখে এমনকি মশাও মারা যায় না। শহুরে গরিবের বসবাস যে পোকামাকড়ের পরিবেশে, গণবিধ্বংসী ভাইরাস বহনকারী মশার জন্মও সেখানে। যে রাজনৈতিক অর্থনীতির শাসনে গরিবেরা থাকে, সেই অর্থনীতির মতো রোগ ও মহামারিও গরিববিদ্বেষী। তারাই ভোগে বেশি। চিকিৎসা করাতে গিয়ে তারা আরও গরিব হয়ে যায়। ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া বেজায় গরিববান্ধব। কিন্তু হাসপাতালগুলো তাদের নেয় না। রাজধানীর একটি সরকারি হাসপাতাল থেকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে ডেঙ্গুতে–ভোগা এক পথশিশুকে।

বৃহত্তর ঢাকার জনসংখ্যা প্রায় আড়াই কোটি। সুন্দর সুশাসনের দেশেও এত বিপুল জনঘনত্বের রাজধানীর জনস্বাস্থ্য বাঁচানো অসম্ভব। ঢাকা যখন খুব ছোট ছিল, সেই পঞ্চাশের দশকে মশার জ্বালায় লোকে দিনেও মশারি খাটাত। কবি বুদ্ধদেব বসুর স্মৃতিকথায় সেই মশামেদুর দিনরাতের তিতকুটে বর্ণনা আছে। কেবল একজন স্বাস্থ্যমন্ত্রীই ঢাকাকে মশকমুক্ত করতে পেরেছিলেন—তিনি হাবিবুল্লাহ বাহার। সেই ঢাকা এখন গোদের মতো ফুলে গেছে। গরিব বস্তি আর বড়লোকি ভবনের থেকে বেরোনো আবর্জনায় ভরপুর এ শহর। এমন শহরেই তো দিনে দিনে জমাট দেনা কোনো এক সময় টাইমবোমার মতো বেদনার বিষ্ফোরণ ঘটায়। কখনো গণপিটুনির আকারে, কখনো ডেঙ্গু মহামারির প্রকারে।

বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা তো বহু খবর রাখে। তাদের হিসাবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ৩৪ শতাংশ মানুষই শহরবাসী। আর জাতিসংঘের হিসাবে দক্ষিণ এশিয়ার শহরগুলোর ৪০ শতাংশ আদমসন্তানই বস্তিবাসী। ধনবৈষম্য থাকবে, ক্ষমতার বৈষম্য থাকবে, অধিকারের আকাল থাকবে আর গরিবেরা ধনীদের চেয়ে বিষম সংখ্যায় স্বাস্থ্যসমস্যায় ভুগবে না, তা হয় না। যা হওয়ার তা-ই হচ্ছে। নতুন নতুন নগর বানানো হচ্ছে নদী–বন–প্রকৃতির বিরুদ্ধে। সকল সভ্যতাই নদীর দিকে মুখ করে যাত্রা করেছে, আমাদের ঢাকা এখন নদীর দিকে পিঠ ফিরিয়ে রেখেছে। নদী এখন জীবনের আধার নয়, জাতীয় মলাধার।

জনবিমুখ উন্নয়ন, মহামারি আর ভিআইপি সম্প্রদায় একে অন্যের যমজ। ইতিহাস দেখায়, এরা একসঙ্গেই জন্মায়।

বাংলার সুলতান-রাজা-জমিদারেরা দেশময় অজস্র খাল-জলাশয়-দিঘি, এমনকি কোনো কোনো নদীও (যেমন মাথাভাঙা-জাতীয় কানা নদী) খনন করেছিলেন সেচ আর শুদ্ধ জলের জন্য। নবাব আলিবর্দী খাঁর আমলে লাগাতার মারাঠা আক্রমণ আর সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের পর ইংরেজের দখলদারিতে দেশীয় সামন্ত-নবাবরা ধ্বংস হলো। নুতন শাসনব্যবস্থা কায়েম হতেও নিল প্রায় ৫০ থেকে ৬০ বছর। তত দিনে জলদেহগুলি মজে গেল। দেখার কেউ ছিল না। বন্যার সময় মাটির বাঁধ কেটে পলিবান নয়া পানি দিয়ে সেসবের নবায়নও বন্ধ রইল। ফলে, বদ্ধ পানিতে ম্যালেরিয়ার মশা ছড়াল। সঙ্গে এল কলেরা। বহু মানুষ মরল, ফসলের ক্ষতিতে দুর্ভিক্ষ হলো। ছিয়াত্তরের দুর্ভিক্ষ তখনকার ঘটনা। ইংরেজ নদীপ্রকৌশলী স্যার উইলিয়ম উইলকক্সের ১৯৩০ সালে এই বিবরণ দেন।

এরপর জেঁকে বসে ইংরেজ শাসন। তারা পুরোনো সেচ-নিষ্কাশনব্যবস্থা সংস্কার না করেই ভুলভাল বাঁধ দিল। নদীগুলো প্রবাহিত উত্তর থেকে দক্ষিণে। তারা রেললাইন-সড়ক বানাল পুবে-পশ্চিমে। কারণ, রাজধানী কলকাতা তো পশ্চিমে। ফলে বর্ষায় অবাধ জলপ্রবাহ বাধা পেল, বন্যার পরে দেখা দিল জলাবদ্ধতা। এসব বদ্ধ জলা হলো ম্যালেরিয়ার খামার আর দূষিত পানি হলো কলেরার বাহন। মধ্যযুগে ইউরোপের শহরগুলোয় প্লেগ রোগে বহু মানুষ মারা যেত। কিন্তু এশিয়া-আফ্রিকা-লাতিন আমেরিকার দেশগুলো কলেরা, ম্যালেরিয়া, ইবোলা প্রভৃতি মহামারির শিকার হয় ইউরোপীয় উপনিবেশবাদের উন্নয়নে থাকার সময়। এখনো সড়ক–বাঁধ নির্মাণের সেই কলোনিয়াল ধারাই চলমান।

মশাদের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত আর ইংরেজ দখলদারি জমিদারি চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত সমকালীন ঘটনা। হঠাৎ জমিদারেরা তো ভিআইপি। প্রভু ইংরেজ ছাড়া কারও কাছে তাঁদের দায়বদ্ধতা ছিল না। এমনকি দেশীয় ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে ইংরেজ অপরাধীদের বিচারও করা যেত না। কোনো শাসকই তখন নির্বাচিত হতেন না, জনগণ ছিল এতই বিধ্বস্ত যে জবাবদিহি চাওয়ার তাকত তাদের ছিল না। অবস্থাটা এখনকার মতোই।

নিজ জনগণের সঙ্গে এসব কলোনিয়াল ভিআইপিদের সম্পর্কটাও হলো ঔপনিবেশিক। খাজনা আদায় ছাড়া আর কোনো দরকার দেশীয় লোকজনের কাছে তাদের ছিল না। জনবহুল দেশের অর্থনীতিতে খাজনার জন্য মানুষ বাঁচানো দরকার পড়ে না, আবাদযোগ্য জমি থাকলেই হলো। এ কারণে দেখা যায়, বাংলা ১১৭৬/ইংরেজি ১৭৬৯ সালের মন্বন্তরের পরে এবং বাংলা ১৩৫০/ইংরেজি ১৯৪৩ সালের মন্বন্তরে কোটি মানুষ মারা গেলেও পরের বছরই খাজনা আদায়ের পরিমাণ ছিল সর্বোচ্চ। সে আমলের খাজনাকে আজকের ভাষায় আমরা প্রবৃদ্ধি বলতে পারি।

ঔপনিবেশিক উন্নয়ন যখন তুঙ্গে, তখন নিয়মিতভাবে ম্যালেরিয়া ও কলেরা এবং দুর্ভিক্ষ হয়। সব দুর্যোগেই ব্যবসায়ীরা আরও ফুলে যায়। এখন যেমন মশারি, মশানাশকের ব্যবসা থেকে শুরু করে হাসপাতাল ব্যবসা তুঙ্গে। এর আগে জঙ্গি দমনে মেটাল ডিটেক্টর, সিসিটিভি থেকে শুরু করে সিকিউরিটি ব্যবসার রমরমা হয়, তেমন আরকি। ছিয়াত্তর আর পঞ্চাশের দুর্ভিক্ষের সময় মজুতদারি করা বড়লোকদের এখনো দানবীর বলা হয়। আধুনিক ভাষায় যাহা ডিজাস্টার ক্যাপিটালিজম, তাহারই শিকার আমরা।

সেইসব মহামারি ও দুর্ভিক্ষ অদ্ভুত এক জ্ঞান দেয়। কোটি মানুষ খাদ্যগুদাম ও খাবারের দোকানের দিকে চেয়ে চেয়ে অসহায় মরে গেল কিন্তু কিউ খাবার কেড়ে নেবার সাহস পর্যন্ত করেনি। কিন্তু এরই তিন বছর পর মুমূর্ষু জীবিতরা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় বিপুল বিক্রমে পরস্পরকে হত্যা করতে কসুর করেনি। অথচ গোড়াতেই প্রতিরোধ করলে হয়তো দাঙ্গা-দুর্ভিক্ষ-দেশভাগ ইত্যাদি হতো না। কলোনিয়ালিজমে মানুষ এমন আত্মঘাতী হয়। আজ যেন আমাদের দেশে আমাদের লোকেদেরই অভ্যন্তরীণ উপনিবেশ বসেছে। তারা টাকা ও ক্ষমতা বানায় দেশে, কিন্তু সম্পদ ও ভবিষ্যত গড়ে বিদেশে—বেগমপাড়ায়, সুইস ব্যাংকে।

আমাদের অনেকেই নাহয় মারা যাব; অনেকেই নাহয় এই বাস্তবতায় মানুষের জীবন আর পাব না। কিন্তু পরে যারা আছে, তারা শিখবে না জীবনের সঠিক ব্যবহার? দুর্নীতিতে অপচয় হয় বড়জোর সম্পদের ৫০ শতাংশ। কিন্তু ভুল নীতিতে নষ্ট হয় পুরোটাই। যে অর্থনীতি, উন্নয়ন নীতি ও রাজনীতির অধীনে আমরা আছি, তা যদি অচিরেই বদলাতে না পারি, তাহলে ডেঙ্গুর পর আরো মারাত্মক জিকা আসবে, ইবোলা আসবে। মশা মারতেও তখন বিরাট বিপ্লবের দরকার হবে। শুধু কামানে আর কুলাবে না।

ফারুক ওয়াসিফ: লেখক ও প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক।
[email protected]