লিবিয়াকে কেন সমর্থন করছে তুরস্ক?

ছবি: রয়টার্স
ছবি: রয়টার্স

জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ গত মাসে লিবিয়া সংকটের কোনো সামরিক সমাধান নেই বলে সর্বসম্মতভাবে ঘোষণা দিয়ে দেশটির ওপর আরও এক বছরের জন্য অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে।

এই নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘লিবিয়ার সঙ্গে আমাদের সামরিক সহযোগিতা চুক্তি রয়েছে। যদি আমাদের কাছে লিবিয়ার পক্ষ থেকে কোনো অনুরোধ আসে এবং তারা যদি তার জন্য অর্থ প্রদান করে, তবে আমরা তাদের অস্ত্র সরবরাহ করব। প্রতিরক্ষার প্রয়োজনে তারা অস্ত্র চাইতেই পারে।’

এরদোয়ানের এই বক্তব্য জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের নিষেধাজ্ঞার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ২০১১ সালে লিবিয়ায় সহিংসতা শুরু হওয়ার পর নিরাপত্তা পরিষদ এই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। কিন্তু লিবিয়ায় তুরস্কের স্বার্থ কী এবং কেন আঙ্কারা অস্ত্র সরবরাহের এই ঝুঁকি নেবে? লিবিয়ার সাবেক নেতা মুয়াম্মার গাদ্দাফির শাসনামলে দেশটির সঙ্গে তুরস্কের উল্লেখযোগ্য বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল। এই বাণিজ্যিক সম্পর্ক খুব মসৃণ ছিল এবং বড় কোনো রাজনৈতিক সমস্যা সৃষ্টি করেনি। ২০১০ সালে এরদোয়ান মানবাধিকারের জন্য আল-গাদ্দাফি আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছিলেন, তবে ২০১১ সালে লিবিয়ায় আরব বসন্ত বিদ্রোহ শুরু হওয়ার পর গাদ্দাফির কাছ থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নিতে শুরু করেন এরদোয়ান।

গাদ্দাফির প্রতি এরদোয়ানের প্রথম সুর ছিল আপসমূলক। তিনি লিবিয়ার জনগণের দাবি মেনে দেওয়ার জন্য গাদ্দাফিকে অনুরোধ করেছিলেন। পরে তিনি তাঁর অবস্থান বদলে ফেলেন। এরদোয়ান প্রকাশ্যে দেশের স্বার্থে গাদ্দাফিকে পদত্যাগ করার জন্য বলা শুরু করেন। আসলে তুরস্কের অগ্রাধিকার হচ্ছে লিবিয়ায় অবস্থানরত ২০ হাজার তুর্কি নাগরিক ও হাজার হাজার বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করা প্রকল্পগুলোর সুরক্ষা নিশ্চিত করা। আঙ্কারা লিবিয়ার গৃহযুদ্ধের অবসান ও শাসনব্যবস্থায় শান্তিপূর্ণ রূপান্তরের দাবি জানিয়েছিল। তুরস্কের লক্ষ্য ছিল এই অঞ্চলে ভূরাজনীতির পরিবর্তনের পাশাপাশি বাণিজ্যিক সম্পর্কের সম্প্রসারণের জন্য অনুকূল পরিবেশ সুরক্ষিত করা। এ জন্য কোনো বিস্তৃত পরিকল্পনা ছাড়াই লিবিয়ায় ন্যাটোর হস্তক্ষেপের বিরোধিতা করে তুরস্ক। একই কারণে তুরস্ক লিবিয়ান ন্যাশনাল আর্মির (এলএনএ) প্রধান জেনারেল হাফতারের বিরোধিতা করছে। হাফতার হলেন একজন যুদ্ধবাজ, যিনি জাতিসংঘ স্বীকৃত সরকার গভর্নমেন্ট অব ন্যাশনাল অ্যাকর্ডের (জিএনএ) বিরুদ্ধে অবৈধ লড়াই চালাচ্ছেন। তাঁর এই পদক্ষেপে দেশে নিরাপত্তাহীনতা তৈরি হয়েছে, অবকাঠামো ধ্বংস হয়েছে, সম্ভাব্য বিনিয়োগ বিলম্বিত হয়েছে এবং সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোকে লিবিয়ায় আরও প্রভাব বিস্তারের সুযোগ করে দিয়েছে।

এরদোয়ানের কাছে জিএনএ সরকার এবং এর প্রধানমন্ত্রী ফায়েজ আল-সাররাজি লিবিয়ার বৈধ সরকার। আঙ্কারা সাররাজের সরকারের সঙ্গে নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে। এ জন্য তুরস্কের নেতারা লিবিয়ায় তাঁদের অস্ত্র সরবরাহকে কোনো সমস্যা বলে বিবেচনা করেন না, যদিও এটি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সীমাবদ্ধতার দিকে ঠেলে দিতে পারে। তবে আঙ্কারা বিশ্বাস করে, এ ধরনের চুক্তি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ কারণ, এটি তুরস্কের বিকাশমান প্রতিরক্ষাশিল্পকে লিবিয়ার বাজারে উন্মুক্ত করতে সহায়তা করার পাশাপাশি হাফতার বাহিনীর অস্ত্র সক্ষমতার ভারসাম্য বজায় রেখেছে এবং কৌশলগত অঞ্চলে তুরস্কের সামরিক বাহিনীকে সামনে এনেছে। গত মাসের শেষ দিকে তুরস্ক তাদের কয়েকজন নাগরিককে জিম্মি করে রাখার জন্য জেনারেল হাফতার ও এলএনএর বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপ নেওয়ার হুমকি দেয়। হাফতারের বাহিনী এই হুমকিকে গুরুত্বের সঙ্গে নেয় এবং দ্রুত ওই সব তুর্কি নাগরিককে মুক্তি দেয়।

তুরস্ক তার লিবিয়া নীতিগুলো একমাত্র নিকটতম আরব মিত্র কাতারের সঙ্গে সমন্বয় করে। তুরস্কের আকাঙ্ক্ষা হচ্ছে লিবিয়ায় তুর্কিপন্থী শাসককে রক্ষা করা এবং আরব মিত্রদের সীমানা প্রসারিত করা। তবে লিবিয়ার ব্যাপারে তুরস্কের হস্তক্ষেপের কারণে লিবিয়া থেকে অনেক আরব দেশকে বিচ্ছিন্ন করেছে যেমন সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও মিসর।

হাফতার এই বিচ্ছিন্নতা কাজে লাগিয়ে তুরস্কের প্রতিদ্বন্দ্বীদের কাছ থেকে আরও সমর্থন সুরক্ষিত করেছেন। একই সময়ে, মার্কিন প্রশাসনকে হাফতারের কাছাকাছি হতে দেখা যায়, রাশিয়াও তাকে সমর্থন করছে, ফ্রান্স লিবিয়ার উভয় পক্ষের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখছে এবং ইতালি হাফতারের তীব্র বিরোধিতা করছে—এই সব মিলিয়ে লিবিয়াকে কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিক জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। এই অর্থে বলা যায়, লিবিয়ায় তুরস্কের হস্তক্ষেপ একটি ঝুঁকিপূর্ণ উদ্যোগ। তুর্কি নীতিনির্ধারকেরা এই ঝুঁকিটিকে প্রতিরক্ষা, সুরক্ষার ক্ষেত্রসহ লিবিয়ার সঙ্গে আঙ্কারার সহযোগিতার স্তর উন্নয়নের সম্ভাবনার মধ্যে যথার্থ বলে বিবেচনা করছেন। তুরস্ক সম্ভবত যতক্ষণ পারবে, ততক্ষণ লিবিয়ার মঞ্চে ভূমিকা পালন করে যাবে।

মিডল ইস্ট আই থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনূদিত

বুলেন্ত আরাস তুর্কি লেখক ও মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ে বিশেষজ্ঞ