মৃত্যু আমাকে নেবে, মন্ত্রণালয় নেবে না

এই মুহূর্তে সবচেয়ে আলোচিত বিষয়: ১. ডেঙ্গু, ২. ভিআইপি, ৩. শিশুধর্ষণ, ৪. বন্যা, ৫. ডুবুরি, ৬. মিন্নি, ৭. মানুষের মাথা, ৮. গণপিটুনি, ৯. নাসা ভ্রমণ, ১০. গরুর দুধে অ্যান্টিবায়োটিক, ১১. তামিমের ফর্ম, ১২. বালিশ ওঠানো, ১৩. গুজব, ১৪. সুজন ও বাংলাদেশ পুরুষ ক্রিকেট দলের কোচ, ১৫. হারপিক ও ব্লিচিং পাউডার, ১৬. দুদক, ১৭. স্বাস্থ্যমন্ত্রী এলাকায় নাকি মালয়েশিয়া, (ফেসবুকে পাওয়া। ঈষৎ পরিবর্তিত)

একটাও যদি সুখবর থাকত কোথাও! বেশ কবছর আগে ‘আমাকে একটা সুখবর দিন’ শিরোনামে একটা কবিতা কিংবা পোস্ট লিখেছিলাম:
আমাকে কেউ একটা সুখবর দিন
বলুন মা তাঁর হারানো সন্তানকে ফিরে পেয়েছেন
বলুন মানুষ আর কোনো দিন বোমা বানাবে না
বলুন নিখোঁজ বিমানটি অক্ষত অবস্থায় ফিরে এসেছে
যাত্রীরা ফিরে গেছে মায়ের আলিঙ্গনে, প্রিয়জনের বাহুপাশে
বলুন ক্যানসারের ওষুধ আবিষ্কৃত হয়েছে
এইচআইভির টিকা
বলুন আমাদের নেতারা ঠিক করেছেন তাঁরা মিলেমিশে চলবেন
আর বলুন যে দেশে আর যানজট থাকছে না
বলুন যে এবার শীতে কেউ কষ্ট পাবে না
বলুন যে বাংলাদেশ বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পথে এগিয়ে যাচ্ছে
আমাকে কেউ একটা সুখবর দিন
বলুন যে এই দেশে কোনো শিশু অপুষ্টিতে মারা যায় না
বলুন যেসব শিশু স্কুলে যায় সবার স্বাস্থ্য ভালো
আমাকে কেউ একটা সুখবর দিন
বলুন যে কোনো পাইপ ঢাকনা ছাড়া নেই
কোনো শিশু গর্তে পড়বে না
আমাকে কেউ একটা সুখবর দিন
বলুন যে এই দেশে কেউ আর ঘুষ খায় না
মানুষ মানুষের পাশে যাচ্ছে হাসিমুখে সহমর্মিতার দুহাত বাড়িয়ে
সবাই সবার কর্তব্য করে যাচ্ছে নিয়মমাফিক এবং নিয়মের ঊর্ধ্বে উঠে মানবিক টানে...
আমাকে কেউ একটা সুখবর দিন
বলুন যে ২০১৫ ভালো হবে ২০১৪-এর চেয়ে
২০১৬ হবে আরও ভালো...
বলুন যে মানুষ সবাই সুখী
ঘরে ঘরে আরাম করে রাতের ঘুম দিচ্ছে নির্বিরোধ পুরুষ-রমণী
আমাকে কেউ একটা সুখবর দিন
দুঃসংবাদ শুনতে শুনতে আমার ফোবিয়া হয়ে গেছে
টেলিভিশনের রিমোট টিপতে আমি ভয় পাচ্ছি
ভয় পাচ্ছি ফেসবুকের হোমপেজে যেতে
সকালবেলার খবরের কাগজ আমি মেলতে পারছি না...

এটা ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে লেখা। ২০১৯ সালে আগস্টে এসে এই রোদন, অক্ষমের এই আর্তি আরও ভয়াবহ রূপ পরিগ্রহ করেছে।

আমাদের দেশে একটা করে দুর্ঘটনা ঘটে, আমরা সেটা নিয়ে মেতে উঠি। তারপর আগেরটার চেয়েও বড় আরেকটা দুর্ঘটনা ঘটে, তখন আমরা আগেরটা ভুলে যাই। এখনই একটা ভূমিকম্প হোক, আমরা সবাই সভা করব, গোলটেবিল করব, টক শো করব; বিষয় হবে, ‘ভূমিকম্প মোকাবিলায় আমাদের করণীয়’। যেমন আমরা এরই মধ্যে ভুলে গেছি বনানীর বহুতল ভবনে আগুনের কথা। ভুলে গেছি পুরান ঢাকার দুটো ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের কথা। আমাদের ভবনগুলো ভূমিকম্পসহনীয় করার কথা ছিল, অগ্নিনির্বাপণব্যবস্থা ত্রুটিহীন করার কথা ছিল, নিয়মিত আগুনের মহড়া করার কথা ছিল। আল্লাহ না করুন, এখনই একটা রেল দুর্ঘটনা ঘটুক, আমরা লেগে পড়ব রেলসেতুগুলোর দুরবস্থা নিয়ে। তারপর ভুলে যাব। যেমন ভুলে গেছি সড়ক দুর্ঘটনার কথা।

আমাদের স্বাস্থ্যমন্ত্রী মালয়েশিয়া গেছেন। ফিরেও এসেছেন। তবে তাঁর অফিসের লোকজন বলেছেন, তিনি এলাকায় কাজ করছেন। এই নিয়ে কথা বলতেও লজ্জা হচ্ছে। এর আগে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বৈজ্ঞানিক সেমিনারে বলেছেন, ডেঙ্গু মশার প্রজননক্ষমতা রোহিঙ্গাদের মতো। বলেছেন, ‘সাংবাদিকদের জানতে হবে দেশে প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় ১৫-২০ জন মারা যায়, সাপের কামড়ে মারা যায় ১০ জন, হার্ট অ্যাটাকে মারা যায় শত শত লোক। সেসব খবর আমরা রাখি না?’

এরপরে ফেসবুকে বলা হচ্ছে, একটা মিনিস্ট্রি অব কমনসেন্স খোলা হোক।

এটা তো কমনসেন্স না। কমনসেন্স কথাটা কমন, কিন্তু কমনসেন্স তো সবার থাকে না। রোহিঙ্গাদের নিয়ে তিনি যা বলেছেন, তা শুনে নিজের কানকে কি বিশ্বাস করা যায়! আর সাংবাদিকদের কী জানা উচিত, তার সবক দিয়ে তাঁর মন্ত্রণালয়ের লোকজনের ছুটি বাতিল করে তিনি নিজে বিদেশে চলে গেলেন। এই কাজ যিনি করেন, তাঁকে ফুলের মালা দিয়ে বরণ করতে সবাই মিলে বিমানবন্দরে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা উচিত ছিল।
হে মোর দুর্ভাগা দেশ, যাদের করেছ অপমান,
অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান!

এবার একটা জরুরি কথা বলে নিই। ডেঙ্গু সারা দেশের ৬৪ জেলাতেই ছড়িয়ে পড়েছে। এডিস মশা যদি সারা দেশে ছড়িয়ে গিয়ে থাকে, তাহলে মহামারি ঠেকানোর ক্ষমতা আমাদের আর নেই। সারা দেশে ওষুধ ছিটানো যাবে না। আর কচুর পাতা, ঘৃতকুমারীর পাতায় জমে থাকা পানিতেও এডিস মশা বিস্তার করে।

আমার ধারণা, এখনো সময় আছে। ঢাকা এবং আশপাশের এলাকাকে এডিস মশামুক্ত করতে পারলে এই মহামারি রোধ করা যাবে। তবে শুধু রাস্তায়, গলিতে, উপগলিতে ওষুধ ছিটিয়ে এটা দূর করা যাবে না। ওষুধের নামে অকার্যকর ধোঁয়া উদ্‌গিরণ করলে তো কিছুই হবে না। ঘরে-বাইরে, বারান্দায়, ছাদে, ভবনের কোনায় জমে থাকা পরিষ্কার পানিতে এডিস মশা বংশবিস্তার করে। সবাই মিলে একসঙ্গে নিজেদের ঘরবাড়ি, অফিস-আদালত-প্রতিষ্ঠান, কারখানার ভেতরে-বাইরে, আশপাশে জমে থাকা পানি পরিষ্কার না করলে এডিস নিধন সম্ভব নয়। সেটা করার জন্য একটা প্রবল আন্দোলনের সূচনা করতে হবে। ডাক দিতে হবে। সেই ডাক দেওয়ার লোকটাও যে আমাদের নেই, সেই দুঃখ আমরা রাখি কোথায়!

হায়, এই দেশে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করার মতো মানুষ নেই, এই দেশে আছেন বর্তমান স্বাস্থ্যমন্ত্রীর মতো মানুষ, যিনি মানুষকে তুলনা করেন এডিস মশার সঙ্গে, যিনি সংকটকালে বিদেশে যান আর তা নিয়ে লুকোচুরি করেন।

হে আল্লাহ, আমাদের তুমি হেফাজত করো।

আনিসুল হক: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক