গরহাজির ও অতিহাজির - তাঁরা ভালো থাকুন

গত ৩০ জুলাই রাতে বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের দেশে উপস্থিতি-অনুপস্থিতি নিয়ে কিছু জল্পনা ও টক শোতে আলাপচারিতা শুনেছিলাম। স্বাস্থ্যমন্ত্রী কোথায় আছেন, সেই নিয়ে আলোচনা। খবর ছিল ভিন্ন ভিন্ন গোছের। তিনি মানিকগঞ্জে অথবা ঢাকায় অথবা মালয়েশিয়ায়। পরের দিন ৩১ জুলাই প্রথম আলো (শেষের পাতায়) এয়ারপোর্ট সূত্র জানায় যে স্বাস্থ্যমন্ত্রী সপরিবার ২৮ জুলাই মালয়েশিয়া গেছেন। তাঁদের ফেরার টিকিটের তারিখ ৪ আগস্ট। টিকিট সূত্রের খবর ছাড়া এত বড় সরকার আর মন্ত্রণালয় কেউ সঠিক খবর দিয়েছিল বলে জানা যায়নি। (অবশ্য তিনি ইতিমধ্যে দেশে ফিরেছেন।)

সেই হাজার বছরের পুরোনো পুরাকথা বা শ্রুতি মনে পড়ে গেল—রোম যখন পুড়ছে, সম্রাট নিরো তখন বাঁশি বাজাচ্ছিলেন। মন্ত্রী অবশ্যই বলতে পারেন, দেশ তো আর পুড়ছে না, হেথায় হোথায় কিছু লোকের জ্বর হয়েছে, ১৭ কোটি লোকের দেশে মৃতের সংখ্যা কুল্লে ৫০–এর আশপাশে। ভ্রমণে বাধা কোথায়। হক কথা, তিনি সপরিবার বহাল তবিয়তে থাকুন, এটাই আমাদের শুভকামনা।

মন্ত্রী-ভিআইপিদের ভালো তো থাকতেই হবে।

প্রতি মঙ্গলবারে শত-হাজার কোটি টাকার প্রকল্পের অনুমোদন হয় একনেকে। সারা দেশ তো প্রকল্পে ভরে গেছে। কোনো এক প্রকল্পের এক কর্মকর্তার জন্য মাদারীপুরের কাঁঠালবাড়ি ১ নম্বর ফেরিঘাটে ফেরি আটকে ছিল প্রায় তিন ঘণ্টা। ভিআইপি আসবেন বলে। গুজব রটেছে ফেরি
আটকে থাকার কারণে এক স্কুলছাত্রকে বহনকারী অ্যাম্বুলেন্সও আটকে ছিল প্রায় তিন ঘণ্টা। ভিআইপি আসার পরে ফেরি ছেড়েছে, অ্যাম্বুলেন্সও ফেরিতে উঠেছে, কিন্তু আহত ছাত্রটি আর বেশিক্ষণ বাঁচতে পারেনি। গুজব রটানো হচ্ছে এই বলে যে ফেরি ঠিকমতো ছাড়লে ছাত্রটি হয়তো ঢাকায় তিন ঘণ্টা আগেই পৌঁছে হাসপাতালে ভর্তি হতে পারত। হায়াত-মউত সৃষ্টিকর্তার হাতে। ডেঙ্গুই হোক বা ফেরিতে বিলম্ব—মউত নির্ধারিত থাকলে স্বাস্থ্যমন্ত্রী কী
করবেন আর বেচারা ভিআইপিরই দোষ কতটুকু? অবশ্য ফেরিঘাটের কর্মকর্তারা খুবই প্রাণবন্ত বিশ্লেষণ দিয়েছেন। তাঁদের কথা অনুযায়ী, নদীতে প্রচণ্ড স্রোত ছিল। তাই তাঁরা ফেরিতে অ্যাম্বুলেন্স পারাপার করতে পারেননি। আর ভিআইপি আসার সঙ্গে সঙ্গেই নিশ্চয়ই স্রোত কমে গিয়েছিল এবং সঙ্গে সঙ্গেই ফেরি সচল হতে পেরেছিল। তাঁরা ভালো থাকুন।

দুই

মধ্যযুগে রাজা–বাদশাহদের আমলে অনেক ছিল নবাবের পুত্র নবাবজাদা, রাজার পুত্র রাজকুমার, ছোট কুমার, মেজ কুমার, বড় কুমার এবং আরও কত–কী। নায়েবজাদা, জমিদারজাদি ইত্যাদি। ইংল্যান্ডে আর মধ্যপ্রাচ্যে রাজা–বাদশাহদের দেশে এখনো ডজন ডজন ক্রাউন প্রিন্স, সেকেন্ড, থার্ড ইন লাইন টু দ্য ক্রাউন। মধ্যপ্রাচ্যে রাজা–বাদশাহদের দেশগুলোতে পুত্র, ভাতিজা, ভাগনে আর নাতি-পুতিদের নিয়ে ভরাট থাকে মন্ত্রিসভা। ঐতিহাসিকভাবে আমাদের এই পূর্ব বাংলায় অল্পসংখ্যক সুন্নি মুসলমান বড় নবাব বা বড় জমিদার ছিলেন। তাই হয়তো ‘জাদা’ না হওয়ার খায়েশ মাঝেমধ্যে অধমের মনে হয়, আমরা ভিআইপি হয়ে মেটাচ্ছি। আগেরকার দিনে নবাবজাদা, জমিদারজাদা ইত্যাদিরা যেসব সুযোগ–সুবিধা ভোগ করতেন, আমাদের ভিআইপিরা বোধ হয় সেই সব ভোগ করে আমাদের পূর্বপুরুষদের বঞ্চিত হওয়ার ইতিহাসের বদলা নিচ্ছেন। আগে ‘জাদা’ হতে পারিনি তাতে কী, এখন তো হচ্ছি।

হোক, তাতে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু কারা কারা ভিআইপি, সেটা জানলে আমজনতা ভীষণ উৎসাহে তাঁদের সম্মান করতে পারত। পদ জানলে তাঁদের জন্য রাস্তা খালি করে দিয়ে রিকশা-বাস-গাড়ি থেকে নেমে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে যেতাম ফেরিঘাটে, রেলস্টেশনে, এয়ারপোর্টে। তাঁদের সবচেয়ে আগে যেতে দিয়ে ধন্য হয়ে যেতাম। শুধু পদাধিকারীরাই নয়, তাঁদের স্ত্রী, পুত্র, কন্যা, নাতি–নাতনি, মা, গৃহকর্মী সবার জন্য আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ভিআইপি লাউঞ্জ উন্মুক্ত থাকবে। বড় বড় হাসপাতাল আর হোটেলে সবচেয়ে মজার রুমগুলোতে তাঁদের থাকবে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার।

ভিআইপি কারা, তার একটা তালিকা সব পত্রপত্রিকায় অবিলম্বে প্রকাশ করা হোক। সেটা কয়েক শ বা কয়েক হাজার বা ৫০ হাজার যা–ই হোক না কেন, আমাদের কোনো আপত্তি নেই। এই তালিকা প্রকাশ করার পরের দিন তাঁদের প্রাপ্য ও প্রাপ্ত সুযোগ–সুবিধার একটা তালিকা আমাদের জানিয়ে দিলে আমরা সেভাবেই চলব–ফিরব। অবশ্য প্রথম শ্রেণির ভিআইপি, দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম শ্রেণি ইত্যাদিভাবে সরকার নিশ্চয়ই শ্রেণিবিভাগ করবে এবং শ্রেণিবিভাগের সঙ্গে সঙ্গে প্রথম শ্রেণির সুযোগ–সুবিধা হয়তো থাকবে ১০০টি এবং ক্রমান্বয়ে অন্যান্য শ্রেণির জন্য ৭৫, ৫০, ২৫ ইত্যাদি সুযোগ–সুবিধা। নাতি–পুতিদেরও প্রাপ্য সুযোগ–সুবিধা উল্লেখ করতে যেন ভুল না হয়।

তিন

২৮ জুলাই ২০১৯ হাইকোর্ট বিভাগ ডজনখানেক কোম্পানির দুধ বিক্রি পাঁচ সপ্তাহের জন্য বন্ধের নির্দেশ দিয়েছিলেন। ৩১ জুলাই নাগাদ এই নিষেধাজ্ঞা স্থগিত করেছেন আপিল বিভাগের মাননীয় চেম্বার আদালত। এসব দুধ এখন আবার বাজারে পাওয়া যাবে আর আমরা সানন্দে পান করব।

২৯ জুলাই প্রথম আলো দুধসংক্রান্ত আদালতের নিষেধাজ্ঞার ব্যাপারে রিপোর্ট করতে গিয়ে লিখেছে, ‘ব্র্যাক ডেইরির পরিচালক মোহাম্মদ আনিসুর রহমান মনে করেন, সিসা বা অ্যান্টিবায়োটিক যদি থাকে, সেটার উৎস আগে খুঁজে বের করা উচিত।...এর উৎস হতে পারে গরুর খাবার, ওষুধ, মাটি ও পানি...।’

কথা তো ঠিকই। পশুখাদ্যে অ্যান্টিবায়োটিক ইত্যাদি থাকতেই পারে। বর্তমান সময়ে ষড়যন্ত্রটা মুখ্য। আইন দিন দিন গৌণ থেকে গৌণতর হচ্ছে। কে কীভাবে কোথায় ষড়যন্ত্র করে, তা বোঝা আমাদের জন্য অসম্ভব। তবে আইন পড়ি, পড়তে পারি। এক সংবাদকর্মী আইনটির অস্তিত্ব সম্পর্কে অবহিত করলেন। পড়লাম। আইনটির নাম মৎস্যখাদ্য ও পশুখাদ্য আইন, ২০১০। স্পষ্টতই বর্তমান সরকারের আমলে প্রণীত আইন। খুঁজেপেতে আইনটির ১৪ ধারায় পেলাম ‘(১) মৎস্যখাদ্য ও পশুখাদ্যে অ্যান্টিবায়োটিক, গ্রোথ হরমোন, স্টেরয়েড, কীটনাশকসহ অন্যান্য ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করা যাইবে না। (২) কোনো ব্যক্তি উপধারা (১)–এর বিধান লঙ্ঘন করিলে উহা এই আইনের অধীন অপরাধ হিসেবে গণ্য হইবে।’

এই আইনের অধীনে মৎস্য ও পশুখাদ্য উৎপাদন, বিপণন ইত্যাদি দেখভাল করার জন্য সরকারি কর্তৃপক্ষ তৈরি করা হয়েছে। অ্যান্টিবায়োটিক বা সিসা বা অন্যান্য ক্ষতিকর উপাদান পশুখাদ্যে কতটা আছে এবং ফলে, দুধে, মাছে বা মাংসে কী পরিমাণ নিষিদ্ধ উপাদান আছে, সেটা এই আইন অনুযায়ী বিবেচ্য নয়। এসব নিষিদ্ধ উপাদান থাকলে আমাদের (মানুষের, পশুর না) ক্ষতি হবে, বিধায় আইনটি ওপরে উল্লিখিত ১৪ ধারায় এসব উপাদান সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

আইনটি হয়তো বোকার মতো ধরে নিয়েছে যে নিষিদ্ধ উপাদানগুলো থাকতে পারবে না। ষড়যন্ত্র বা কম ক্ষতির কারণে এসব নিষিদ্ধ বস্তু দুধে, মাছে, মাংসে পাওয়া গেলেও আমরা তা পান করতে বা খেতে পারি। আমাদের এসব পানাহারে বাধা সৃষ্টি না করার জন্য আপিল বিভাগ আমাদের ধন্যবাদ পেতেই পারেন। আজ সরকারকে দুই হাতে করতালি দিয়ে ধন্যবাদ জানাব যদি তারা তড়িৎ গতিতে সংশোধন করে আইনটি উপরে উল্লিখিত ১৪ ধারাটি বাতিল করে দেয়। এখন যেহেতু সংসদ অধিবেশন নেই, সেহেতু মহামান্য রাষ্ট্রপতি অর্ডিন্যান্সের (অধ্যাদেশ) মাধ্যমে ১ দিনেই ১৪ ধারাটি বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করতে পারেন।

স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সপরিবার বিদেশ গমনে আমরা পুলকিত; ভিআইপি কারা এবং তাঁদের যথার্থই প্রাপ্য সুযোগ–সুবিধা সম্পর্কে অবগত হয়ে কৃতার্থ হব আর আইনটি সংশোধনীর মাধ্যমে যা ইচ্ছে তা মেশানো দুধ, মাছ ও মাংস আমাদের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করবে।

ড. শাহদীন মালিক: বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এবং ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের আইনের শিক্ষক