মশার কামড় ও মন্ত্রী-মেয়রের ধমক

গত সপ্তাহে ঢাকার অভিজাত এলাকায় এক বিয়ের অনুষ্ঠানে গিয়ে দেখলাম, হলঘর প্রায় ফাঁকা। আয়োজকদের মন খারাপ। আমন্ত্রিত অর্ধেক অতিথিও আসেননি। কারণ জানতে চাইলে তাঁরা জানান, ডেঙ্গুর কারণে অনেকে আসতে পারেননি। আমন্ত্রিতদের মধ্যে অন্তত ১২টি পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল, তাদের এক বা একাধিক সদস্য ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত। ফলে তাঁদের কেউ বিয়ের অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পারবেন না। ওই অনুষ্ঠানে আলাপ হলো একজন জ্যেষ্ঠ চিকিৎসকের সঙ্গে। তিনি বললেন, গত দুই সপ্তাহে তাঁর চেম্বারে যত রোগী এসেছে, তার ৬০ শতাংশই ডেঙ্গু রোগী।

আমাদের এক সহকর্মী, যিনি মিরপুরের বাসিন্দা গতকাল জানান, তাঁর প্রতিবেশীর শিশুসন্তান ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে ভদ্রলোক নিকটবর্তী একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলেন। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ শিশুটির পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ওষুধ দিলেও ভর্তি করেনি। কেননা, সেখানে শয্যা খালি নেই। এ রকম অবস্থা ঢাকার প্রায় সব হাসপাতালে। ডেঙ্গু বিশেষ সংক্রামক রোগ, এই রোগীকে যে মশা কামড় দিয়েছে, সেই মশা অন্য কাউকে কামড়ালে তার আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি আরও বেশি। এ কারণে ডেঙ্গু রোগীকে মশারির ভেতরে রাখা হয়।

পত্রিকান্তরের খবর, নেত্রকোনা ছাড়া দেশের ৬৩টি জেলায় ডেঙ্গু রোগ হানা দিয়েছে। অর্থাৎ ডেঙ্গু এখন জাতীয় দুর্যোগে পরিণত হয়েছে। কিন্তু সরকারের মন্ত্রী, সিটি করপোরেশনের মেয়র কিংবা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানেন না কীভাবে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব কমানো যাবে, কীভাবে হাসপাতালে বাড়তি রোগীদের সামাল দিতে হবে। ফিলিপাইনে এক লাখ মানুষ আক্রান্ত হওয়ার পর সেখানে রেড অ্যালার্ট জারি করা হয়েছে। বাংলাদেশে এখনো সে রকম কোনো ঘোষণা আসেনি। শুধু জুলাই মাসেই ১৪ হাজার ৯৯৬ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। এর আগে সবচেয়ে বেশি রোগী ভর্তি ছিল ২০১৮ সালে, ১০ হাজার ১৪৮ জন। ঢাকার বাইরেও রোগীর সংখ্যা বেড়ে চলেছে।

ঢাকার অনেক অভিভাবক বলেছেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ঈদের ছুটি এগিয়ে আনা হোক। বৃহস্পতিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৬৮ জন শিক্ষার্থীর রক্ত পরীক্ষা করা হলে ১৬ জনের শরীরে ডেঙ্গু রোগ পাওয়া গেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চিকিৎসা কেন্দ্রে যে ডিভাইস আছে, তাতে দিনে ১৫০ জনের রক্ত পরীক্ষা করা সম্ভব। ছাত্র ইউনিয়ন ডেঙ্গুর কারণে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করার দাবি জানিয়েছে। কেননা, ছাত্রাবাসে শিক্ষার্থীরা আক্রান্ত হলে তাঁদের দেখাশোনা করার কেউ থাকবে না। আমাদের বেশির ভাগ স্কুল-কলেজ ও কোচিং সেন্টার অপরিচ্ছন্ন, সেখানে নোংরা আবর্জনায় বর্ষার পানি জমলেও সরানোর ব্যবস্থা নেই।

ডেঙ্গু নিয়ে মন্ত্রী-মেয়ররা কাজের কাজ কতটা করছেন, তা নিয়ে জনমনে সংশয় আছে। তবে তাঁরা এন্তার কথা বলে যাচ্ছেন, দেশবাসী ও নগরবাসীকে নসিহত করছেন। সময়-সময় সাংবাদিকদের ধমক দিচ্ছেন। ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে আখ্যায়িত করে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও বলছেন। গত বৃহস্পতিবার স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. জাহিদ মালেককে যখন এক সাংবাদিক জিজ্ঞেস করলেন, ডেঙ্গু রোগে সারা দেশে ভয়ংকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার পরও কেন তিনি মালয়েশিয়া সফরে গিয়েছিলেন। তিনি প্রশ্নের জবাব না দিয়ে ধমকের সুরে তাঁকে থামিয়ে দেন। বলেন, ‘আপনি থামেন, থামেন।’ এর আগে মন্ত্রী ডেঙ্গুবাহিত এডিস মশাকে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে তুলনা করে বলেছিলেন, ‘যেভাবে রোহিঙ্গা পপুলেশন বাড়ে আমাদের দেশে এসে, সেভাবে মসকিউটো পপুলেশন বেড়ে যাচ্ছে।’ অপর এক অনুষ্ঠানে ডেঙ্গু পরিস্থিতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে উল্লেখ করে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘প্রতিদিন দুর্ঘটনায় ১৫ জন মারা যায়। প্রায় ১০ জন লোক রোজ সাপের কামড়ে মারা যায়। আর কয়েক মাসে মাত্র ৮ জন ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যু হয়েছে। প্রতিদিন শত শত মানুষ হার্ট অ্যাটাকে মারা যায়। আমরা এসব খবর রাখি না।’

সরকারের একজন মন্ত্রী ও জনপ্রতিনিধি ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে যাঁরা মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন, তাঁদের প্রতি এ ধরনের নিষ্ঠুর মন্তব্য করতে পারেন, তা ভাবতেও কষ্ট হয়। সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষ মারা যায় বলে ডেঙ্গুতেও মারা যাবে? তাহলে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থাকার প্রয়োজন কী?

উল্লেখ্য, ডেঙ্গুর প্রকোপ চলাকালে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বিদেশ সফরে যান। এ নিয়ে সর্বত্র সমালোচনা হয়। তিনি সফর সংক্ষিপ্ত করে মালয়েশিয়া থেকে দেশে ফিরে এলেও নির্ধারিত সংবাদ সম্মেলন স্থগিত করেছেন। বৃহস্পতিবার ‘ডেঙ্গু প্রতিরোধে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর আহ্বান’ শিরোনামে একটি বিজ্ঞাপন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। আর ‘স্বাস্থ্যমন্ত্রীর নির্দেশনায় ডেঙ্গু চিকিৎসায় মন্ত্রণালয় কর্তৃক গৃহীত পদক্ষেপ’ শিরোনামে অন্তত ২৮টি বিলবোর্ড দেখা গেছে রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে।

এডিস মশা মারতে না পারলেও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন একের পর এক কথার কামান দেগে যাচ্ছেন। ২৪ জুলাই বেসরকারি টেলিভিশন মালিকদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় তিনি বলেন, ‘মশা নিয়ে রাজনীতি কাম্য নয়। ছেলেধরার গুজবের মতোই সাড়ে তিন লাখ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত একই সূত্রে গাঁথা। জনগণকে সঙ্গে নিয়ে এই ষড়যন্ত্রকারীদের মোকাবিলা করা হবে। ডেঙ্গু রোগীদের পাশে থেকে কঠিন জবাব দেওয়ার জন্য সরকার প্রতিজ্ঞ।’ (প্রথম আলো, ২৫ জুলাই ২০১৯)

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জরিপের ভিত্তিতে পত্রিকায় আক্রান্তের অনুমিত সংখ্যা উল্লেখ করা হয়েছিল। এ খবরে তথ্যগত ভুল থাকলে সিটি করপোরেশন সংশোধনী বা প্রতিবাদ পাঠাতে পারত। সেসব না করে মেয়র ‘ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে চিহ্নিত করে কঠিন জবাব দেওয়ার কথা বলছেন। তবে ওই অনুষ্ঠানে উপস্থিত উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম কারও বিরুদ্ধে কোনো বক্তব্য না দিয়ে ডেঙ্গু নিরোধ কর্মসূচিতে সবার সহযোগিতা চেয়েছেন।

প্রথম আলোসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে মশার ওষুধ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার পর দুই মেয়রই এখন বলছেন যে নতুন ওষুধ আনা হবে। আগের ওষুধে মশা মরছে না। তবে কবে ও কীভাবে ওষুধ আসবে, সে সম্পর্কে এখনো ঢাকাবাসী অন্ধকারে আছেন। মেয়র সাঈদ খোকন বলেছেন, আগামী সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে তাঁর এলাকার মশা নিয়ন্ত্রণে আসবে। আর উত্তরের মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেছেন, খুব শিগগির ওষুধ আসবে, তবে দিনক্ষণ বলা সম্ভব নয়।

বৃহস্পতিবার প্রথম আলোর খবরে বলা হয়, মশা মারার ওষুধ নিয়ে অনিশ্চয়তা কাটছে না। অথচ ডেঙ্গুর ভয়াবহতা দিন দিন বাড়ছে। সরকারি হিসাবে এ পর্যন্ত ১৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। আর প্রথম আলোর সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী, এবার ডেঙ্গুতে ৬৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। প্রতিদিনই হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগী বাড়ছে। ডেঙ্গু শনাক্তের পরীক্ষা করাতে অনেকে হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ভিড় করছেন। ডেঙ্গু শনাক্ত করার রিএজেন্টেরও স্বল্পতা দেখা দিয়েছে। সুযোগ নিয়ে রিএজেন্টের ব্যবসায়ীরা দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। সরকারি হিসাবে বৃহস্পতিবার ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু জ্বর নিয়ে ১ হাজার ৭১২ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। প্রকৃত সংখ্যা আরও অনেক বেশি। সে ক্ষেত্রে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা কত দাঁড়াবে, অনুমান করা কঠিন নয়।

এরই মধ্যে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন একটি আজগুবি তথ্য দিয়েছেন। বৃহস্পতিবার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সমন্বয় সভায় তিনি জানান, তাঁর এলাকার ১১টি ওয়ার্ড ডেঙ্গুমুক্ত। গত ১৭ থেকে ২৭ জুলাই দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৩,১৪, ১৮,২২, ২৩,২৯, ৩৫,৪২, ৫৩,৫৫ ও ৫৬ নম্বর ওয়ার্ড এলাকায় জরিপ চালায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। জরিপে উঠে এসেছে, ডেঙ্গু রোগের জন্য দায়ী এডিস মশার লার্ভার উপস্থিতি এসব ওয়ার্ডে পাওয়া যায়নি। কিন্তু প্রথম আলোর সাংবাদিকেরা সরেজমিনে ওই সব এলাকায় শতাধিক ডেঙ্গু রোগীর সন্ধান পেয়েছেন। প্রকৃতপক্ষে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জরিপে এসব ওয়ার্ডকে এডিস মশামুক্ত বলা হয়নি। বলা হয়েছে, এসব ওয়ার্ডে এডিস মশার লার্ভা তুলনামূলক কম।

তাহলে মেয়র কি এটাই প্রমাণ করতে চাইছেন যে জরিপের সময় সব এডিস মশা পাশের ওয়ার্ডে বেড়াতে গিয়েছিল এবং জরিপের পর মশা এসে আবার মানুষকে কামড়িয়েছে? অনেকটা নাসিরউদ্দিন হোজ্জার কাকের গল্পের মতো। শহরে ৯৯৯৯টি কাক ছিল, কম হলে বেড়াতে গেছে। আর বেশি হলে বাইরে থেকে এসেছে। মন্ত্রী-মেয়ররা সাংবাদিকদের ধমকাতে পারেন, মশা মারতে পারেন না।

সোহরাব হাসান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
sohrabhassan 55 @gmail. com