মাঝে মাঝে তব দেখা পাই...

>

আমরা জানি, পৃথিবীর যেকোনো সভ্য দেশে সবচেয়ে বড় ভিআইপি হচ্ছে অ্যাম্বুলেন্স, সেই অ্যাম্বুলেন্স একজন যুগ্ম সচিবের জন্য পার হতে পারবে না, এটা কোন আদিম ব্যবস্থা? শিশুটি তার জীবন দিয়ে এই ব্যবস্থার অবসান ঘটাক, এটুকু তো কামনা করতে পারি। তাই বলতে চাই, রাষ্ট্র যেমন চিরদিনের, তেমনি রাষ্ট্রযন্ত্রের দেখাও যেন চিরদিন পাই। মাঝে মাঝে পাই এবং পাওয়ার চেয়ে আরও বেশি হারাই-এ ব্যবস্থা চলতে পারে না। লিখেছেন মামুনুর রশীদ

হঠাৎ করে দেশের প্রশাসনযন্ত্র যেন তার বিশাল দেহটা নিয়ে নড়েচড়ে বসল। অধিকাংশ সময় আলস্য করা, শুয়ে থাকা, ঘুমানোই তার কাজ। কিন্তু কয়েক দিন হলো হঠাৎ সক্রিয় হয়ে উঠেছে প্রশাসনযন্ত্র। ডেঙ্গু মশা বধ, দুধে অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কার এবং পরবর্তী কার্যক্রম ইত্যাদিতে বেশ জোরেশোরে নেমেছে সরকারের কিছু অধিদপ্তর এবং বিভাগ। অবশ্য দুধের বিষয়টিতে আ ব ম ফারুকের গবেষণা এবং হাইকোর্টের নির্দেশনা একটি মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। দেশের খ্যাতনামা তথা বড়লোকদের হাসপাতালে কী ধরনের কর্মকাণ্ড হয়, তা–ও জনসমক্ষে এসেছে। এ ব্যাপারে ডেঙ্গু আক্রান্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ফিরোজ কবিরের মৃত্যুর পরেও অতিরিক্ত অর্থ আদায়ও একটি বড় কারণ।

কিন্তু এসব তো হরদম চলে আসছে। কখনো এর বিরুদ্ধে প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা সরকার নেয়নি। ২২ ঘণ্টায় যে অর্থ আদায় করা হয়েছে, তার চেয়েও অনেক বেশি অর্থ এসব হাসপাতাল ছয়-সাত ঘণ্টায় আদায় করে। মৃত্যুর পর অসহায় মানুষ অর্থ জোগাড় করতে পারে না, লাশের আশায় বসে থাকে। সারা দেশ এখন প্রাইভেট ক্লিনিক ও প্রাইভেট হাসপাতালে ভরে গেছে। প্রিভেন্টিভ মেডিসিন, কমিউনিটি মেডিসিন সব সময়ই উপেক্ষিত হয়েছে।

জনসংখ্যা বেড়েছে, ডাক্তার বেড়েছে, হাসপাতাল বেড়েছে, তার সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে রেকর্ডসংখ্যক ওষুধ কোম্পানি, নিশ্বাস বন্ধ করা দূষিত বায়ু ও ভেজাল খাবার। শেষ পর্যন্ত দুধেও পাওয়া গেল অ্যান্টিবায়োটিক। এতে প্রমাণিত হলো এই বিষয়গুলোর ওপর সরকারের নজরদারি নেই। ছোটবেলায় দেখেছি, স্বাস্থ্য বিভাগের লোক প্রায় নিয়মিতই একটি ছোট্ট যন্ত্র নিয়ে দুধ পরীক্ষা করছে এবং পরীক্ষায় খারাপ ফল এলে দুধ ওখানেই ফেলে দিচ্ছে। কিন্তু এখন এত বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও শিশুখাদ্যসহ ভেজাল প্রতিরোধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ফিরোজ কবিরের মৃত্যুতে হাসপাতালের লাগামহীন লোভের বিষয়টি মানুষ জানতে পারল। ঝড় থেমে গেলে আবার পূর্বাবস্থায় ফিরে যাবে সবকিছু।

হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার ব্যবসা এখন রমরমা। যাঁরা ভিন্ন ব্যবসায় ছিলেন, তাঁরাও হাসপাতাল ব্যবসায় ঝুঁকে পড়ছেন। এই সঙ্গে চিকিৎসকেরাও উচ্চ ফি নিয়ে রেকর্ডসংখ্যক রোগী দেখছেন। কোনো কোনো চিকিৎসক একজন রোগীর পেছনে ৪০ থেকে ৫০ সেকেন্ডের বেশি সময় দেন না। তাঁদের ফি নির্ধারণ করার ব্যবস্থা সরকারের নেই। আমাদের দেশের নীতিনির্ধারকদের অনেকে অবশ্য বাংলাদেশি চিকিৎসকদের কাছে চিকিৎসা নেন না। ভারত, ব্যাংকক, সিঙ্গাপুর এসব জায়গায় ছোটেন। এ ছাড়া কালোটাকার মালিকদের জন্য ওই সব দেশে চিকিৎসা আশীর্বাদস্বরূপ। কালোটাকা সাদা করা যায় এবং টাকা পাচারও করা যায়।

কিন্তু অনেকেরই জানা নেই যে সেখানকার চিকিৎসাব্যবস্থাও প্রতারণামূলক। ব্যাংককের একটি হাসপাতালে প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার আমজাদ হোসেন মারা গেলেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এয়ার অ্যাম্বুলেন্স ও চিকিত্সার জন্য টাকাও দিলেন। কিন্তু মাত্রাতিরিক্ত বিল নিয়ে এমন একটা সংকট বাধল যে লাশই আনা যাচ্ছিল না, শেষে অনেকের মহানুভবতায় বাকি টাকা জোগাড় করতে হলো। অথচ তাদের দেওয়া চুক্তি অনুযায়ী তারা কাজও করেনি। এসব বিষয়ে টাকাওয়ালা মানুষেরা ওই সব হাসপাতালের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা ভাবতে পারেন। অনেক উন্নত দেশে এমন নজির আছে যে রোগীর মৃত্যুর পর বিনা অর্থেই ছেড়ে দেওয়া হয়। আমাদের দেশেও এ রকম আইন করা জরুরি।

 আজকে দুধের বিষয়ে হাইকোর্টের নির্দেশনার পর ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তর কাজে নেমেছে। শুধু দুধে নয়, প্রতিটি খাদ্যের জন্য বিশদ ও জোরদার ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। এমন ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন, যাতে প্রতিষ্ঠানগুলো আগে থেকেই সচেতন হতে পারবে। গুরুতর অপরাধ হলে মোটা অঙ্কের জরিমানাসহ কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। মেয়াদ উত্তীর্ণ খাদ্য বা ওষুধ বিক্রি করার জন্যও গুরুতর শাস্তির ব্যবস্থা থাকা দরকার। এবং এই ব্যবস্থাগুলো জনসমক্ষে হতে হবে, যাতে জনগণ সব জায়গা থেকেই জবাবদিহি পেতে পারে।

এডিস মশা দু-এক দিনের মধ্যে বাসা বাঁধেনি, এর বংশবিস্তার হয়েছে অনেক দিন ধরেই। তার এই বংশবিস্তারের ইতিহাস কি সিটি করপোরেশনের মশানিরোধ বাহিনীর কাছে অজানা? অজানাই যদি হবে, তবে এই বিভাগটি রেখে কী লাভ? আমার ধারণা, সিটি করপোরেশনকে নাগরিকেরা যে বিপুল পরিমাণ কর দিয়ে থাকেন, তার বিনিময়ে তাঁরা কিছু পান না। সেবা না পেলে ভবিষ্যতে নাগরিকেরা ট্যাক্স না দেওয়ার কথাও ভাবতে পারেন।

শিখ নেতা ভিন্দ্রানওয়ালে স্বর্ণমন্দির আক্রমণকালে নিহত হন। স্বর্ণমন্দিরে বিপুল পরিমাণ অস্ত্রের মজুত ছিল। ভারতের নাগরিকেরা তখন বলেছিলেন ভিন্দ্রানওয়ালে বছরের পর বছর অস্ত্র সংগ্রহ করে যে বিশাল ভান্ডার করেছে, তখন বাধা দেওয়া হয়নি কেন? এখানেও সেই একই প্রশ্ন আসে। মানুষের মৃত্যু হচ্ছে, মশার সাম্রাজ্য বড় হচ্ছিল আর এদিকে সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার মশানিরোধ বাহিনী নাকে তেল দিয়ে ঘুমিয়ে ছিল। মশানিরোধের ক্ষেত্রে নাগরিকদের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগ ও নাগরিক চেতনাকে বাড়ানোর কোনো চেষ্টাই এত দিন তারা করেনি।

সবশেষে আরেকটি বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করব। তিতাস ঘোষের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সারা দেশে প্রচণ্ড ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশের পথঘাট ভিআইপিশাসিত। এমনভাবে ভিআইপিশাসিত যে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে লাল-সবুজ বাতিকে পরাভূত করে আদিম ব্যবস্থায় ট্রাফিক পুলিশের অঙ্গুলি হেলনেই চলছে। আমরা জানি, পৃথিবীর যেকোনো সভ্য দেশে সবচেয়ে বড় ভিআইপি হচ্ছে অ্যাম্বুলেন্স, সেই অ্যাম্বুলেন্স একজন যুগ্ম সচিবের জন্য পার হতে পারবে না, এটা কোন আদিম ব্যবস্থা? শিশুটি তার জীবন দিয়ে এই ব্যবস্থার অবসান ঘটাক, এটুকু তো কামনা করতে পারি। তাই বলতে চাই, রাষ্ট্র যেমন চিরদিনের, তেমনি রাষ্ট্রযন্ত্রের দেখাও যেন চিরদিন পাই। মাঝে মাঝে পাই এবং পাওয়ার চেয়ে আরও বেশি হারাই—এ ব্যবস্থা চলতে পারে না।

মামুনুর রশীদ: নাট্যব্যক্তিত্ব