আসুন, যার যে কাজ তা করি

মশা মারার জন্যও কি হাইকোর্টের আদেশ লাগবে? প্রশ্নটি আমজনতার। খোদ বিচারালয়ও এমন প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছেন। গত ২২ জুলাই মামলার শুনানিতে একজন বিচারপতি বলেন, ‘পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে হাইকোর্ট মশা মারার জন্য রুল দেন না। এটা আমাদের বাধ্য হয়েই দিতে হয়।’

তিন দিন পর গত ২৫ জুলাই এক শুনানিতে হাইকোর্ট বিস্ময় প্রকাশ করে বলেছেন, ‘রাষ্ট্রের এত মেশিনারি থাকতে এডিস মশা কি দূর করা যাবে না!’

মূলত সামাজিক বিভিন্ন ইস্যু জনস্বার্থে আসায় একদিকে উচ্চ আদালতকে তা দেখতে হচ্ছে, অন্যদিকে সরকারপ্রধানের নির্দেশের অপেক্ষা করেন সংশ্লিষ্ট দায়িত্ববানেরা। এ প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন উঠেছে, রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ বা প্রতিষ্ঠানগুলো নিজ নিজ কাজ ঠিকমতো পালন করছে কি না।

সাম্প্রতিক সময়ে আলোচিত প্রশ্ন হচ্ছে, সব নির্দেশ কেন প্রধানমন্ত্রীকে দিতে হচ্ছে? যেকোনো বড় ঘটনার পর দুষ্কৃতকারীকে ধরা, বিভিন্ন প্রকল্প দ্রুত শেষ করা, প্রিয় সাহার বিরুদ্ধে মামলা না করা, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তার বদলি স্থগিত, ধান-চাল কেনা এবং রাসায়নিকের গুদাম সরানো থেকে শুরু করে যেসব কাজ মন্ত্রণালয় বা সংশ্লিষ্ট বিভাগের করার কথা, সেখানেও প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ অনিবার্য হয়ে উঠেছে।

এ বিষয়ে হাইকোর্টের একটি বেঞ্চও একই প্রশ্ন রেখে বলেছেন, ‘কী বলব, প্রধানমন্ত্রীকে যদি সবকিছুতে হস্তক্ষেপ করতে হয়, তাহলে সচিবেরা কেন আছেন?’ গত জুনে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা মঞ্জুর মোহাম্মদ শাহরিয়ারের বিতর্কিত বদলি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয়। তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিদেশে অবস্থান করে এ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করলে বদলির আদেশ বাতিল হয়। হাইকোর্টের একটি দ্বৈত বেঞ্চ গত ১৮ জুন এক মামলার শুনানিতে এ বিষয়ে প্রশ্ন রাখেন, ‘সবকিছুতে প্রধানমন্ত্রীর কেন ডিরেকশন (নির্দেশনা) দিতে হবে?’

সাম্প্রতিক মশা মারা থেকে বিগত মাসগুলোয় সড়ক দুর্ঘটনা, মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ, দুধের মান, ধর্ষণ, মানবাধিকার লঙ্ঘনসহ বিভিন্ন ঘটনায় হাইকোর্টে রিট আবেদন ও কিছু কিছু ক্ষেত্রে উচ্চ আদালতের স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে আমলে নেওয়ার বিষয়গুলো আলোচনায় আসছে। কারণ, যাঁর যে কাজ, তিনি তা করছেন না। আর সে কথা হাইকোর্ট বেঞ্চের বক্তব্যেও আসছে ঘুরেফিরে।

আদালতের মূল কাজ বিচার করা। দেশের সব আদালত মিলিয়ে ৩৫ লাখ মামলার পাহাড় জমেছে। সামাজিক ও প্রশাসনিক নানা অনাচারের বিরুদ্ধে প্রতিকার চাইতে অনেকে উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হচ্ছেন। আদালত কোনো বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে দেখছেন, কখনো নাকচ করছেন। গত ২১ জুলাই এলপিজির দাম নিয়ে এক মামলার শুনানিতে হাইকোর্টের একটি দ্বৈত বেঞ্চ বলেন, ‘সবকিছু কি হাইকোর্ট দেখবেন? হাইকোর্টের দায়িত্ব নয় নির্বাহীদের সব কাজ চেক করা।’

আদালতের কিছু নির্দেশ বা সিদ্ধান্ত অবশ্য তাৎক্ষণিক বাস্তবায়িত হচ্ছে। কিছু বিষয় আটকেও থাকছে আইনের মারপ্যাঁচে। কিন্তু গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এমনটি হওয়ার কথা নয়। সব নির্দেশ সরকারপ্রধানের দেওয়ার কথা নয়। প্রায় সব বড় ঘটনাসহ যেকোনো বিষয় নিয়ে হাইকোর্টে যাওয়ারও কথা নয়। তবে কিছু ভুক্তভোগী অন্তত বিচার পাচ্ছেন। পা হারানো রাসেল সরকার কিংবা দুই বাসের রেষারেষিতে হাত হারিয়ে পরে মারা যাওয়া রাজীবের পরিবার কিছু অর্থসহায়তা পেতে যাচ্ছে। অসহায়দের পাশে দাঁড়ানোয় আদালতের প্রতি অবশ্য মানুষের শ্রদ্ধা বাড়ছে।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রিটার্নিং কর্মকর্তার সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করে বগুড়ার কাহালু-নন্দীগ্রাম আসনের প্রার্থী হিরো আলম হাইকোর্টে গিয়ে প্রতিকার পেয়ে মন্তব্য করেছিলেন, ‘নির্বাচন কমিশনকে হাইকোর্ট দেখিয়ে ছেড়েছি।’ আর নির্বাচন কমিশনের ওই সময়ের সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ তখন বলেছেন, ‘হিরো আলম পর্যন্ত হাইকোর্ট দেখায়, বোঝেন অবস্থাটা।’

আবার হাইকোর্টকেও হাইকোর্ট দেখানোর কথা বলা হচ্ছে। গত ১৩ মে ওয়াসার পানি পরীক্ষা প্রসঙ্গে শুনানিতে একজন বিচারপতি বলেন, ‘হাইকোর্টকে যেন হাইকোর্ট দেখানো হচ্ছে!’

রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলোর মধ্যে প্রশাসন, পুলিশ ও বিচার বিভাগের মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব এখন অনেকটাই প্রকাশ্য। পুলিশের কাজ অনেক সময় মানুষ নিজেই করছে, আইন হাতে তুলে নিচ্ছে। যদিও এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এর অন্যতম কারণ পুলিশের ওপর অনাস্থা, বিচারপ্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতা। আর সাধারণ প্রশাসনের কাছে সহজে কাজ পাওয়াটা এখন পর্যন্ত অধিকার নয়, দৃষ্টান্ত হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

এই তিন বিভাগের প্রাপ্তির জায়গাটা এখন মোটামুটি সমান্তরাল। সরকারের কাছে পেশ করলেই প্রায় সব দাবি পূরণ হচ্ছে। জনপ্রশাসনে জ্যেষ্ঠ সচিব পদ সৃষ্টি করা হয়েছে। সেনাবাহিনীতে লেফটেন্যান্ট জেনারেল পদ সৃষ্টির পরই জনপ্রশাসনে জ্যেষ্ঠ সচিব পদ তৈরি করা হয়। এরপর বিচারক, পুলিশ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরাও পিছিয়ে থাকেননি। পুলিশের মহাপরিদর্শককে জ্যেষ্ঠ সচিব মর্যাদা দেওয়া হয়। জেলা জজরা সচিব পদমর্যাদা পেয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের দাবিও মেনে নেওয়া হয়েছে। শীর্ষ পদে এভাবে সামঞ্জস্য এনে সবাইকে খুশি করা হয়েছে। বেতন বৃদ্ধিসহ পদোন্নতি, নানা প্রণোদনা ও সুযোগ-সুবিধা পেয়ে প্রতিটি বিভাগের নিচের দিকের কর্মকর্তারাও বেশ সন্তুষ্ট। পদ না থাকলেও পদোন্নতি, কাজ না থাকলেও সুযোগ-সুবিধা—এসব নিয়ে সবাই একরকম খুশি।

কিন্তু ঝামেলাটা টের পাওয়া যায় মাঠপর্যায়ে, সেখানে অনেক ক্ষেত্রেই এখন কেউ কাউকে সহজে মানতে চান না। ব্যক্তিবিশেষ সুসম্পর্ক রক্ষা করে চললেও সর্বোচ্চ থেকে সর্বনিম্ন পর্যায়ে আছে রেষারেষি, নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ দেখানোর চেষ্টা।

২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের পর থেকে পুলিশের মধ্যে কানাঘুষা হচ্ছে, আন্দোলন ঠেকাতে এবং বিরোধী দলকে সামাল দিয়ে সরকারকে ক্ষমতায় আনতে তাদের বড় ভূমিকা রয়েছে। এই দাবিতে পিছিয়ে নেই প্রশাসনও। মনোভাবটা হচ্ছে, বাইরে পুলিশ দেখলেও ভেতরের কাজ তো প্রশাসন করেছে। এই কৃতিত্বের অন্য দাবিদারেরা অবশ্য ততটা প্রকাশ্য নয়।

সাম্প্রতিক সময়ে পুলিশ বা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের তলব করছেন বিচারালয়, এ নিয়ে দুই পক্ষের ক্ষোভ আছে। আবার বিচারালয়ের ভূমিকা নিয়ে ক্ষোভ থাকলেও পুলিশ ও প্রশাসনের মধ্যেও রেষারেষি অনেক সময় প্রকাশ্য হয়ে পড়ছে।

মাঠপর্যায়ে প্রশাসন ক্যাডার ও পুলিশের মধ্যে মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বটা বেশি। ডিসিরা জেলার আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভাপতি, কিন্তু তাঁদের ডাকা সভায় অনেক সময়ই এসপিরা যান না, সাধারণত প্রতিনিধি পাঠান।

উপজেলা পর্যায়ে ওসির পদটি প্রথম শ্রেণি হওয়ার (নন-ক্যাডার) পর তাঁরা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদেরও মানতে চান না, এমন কানাঘুষা শোনা যায়। মাঠপর্যায়ে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনায় পুলিশ চাইলে অনেক সময় পুলিশ গড়িমসি করে বলে অভিযোগ আছে। এ জন্য সর্বশেষ জেলা প্রশাসক সম্মেলনে ডিসিরা তাঁদের অধীনে একটি বিশেষায়িত পুলিশ ফোর্স নিয়োগের সুপারিশ করেছিলেন। এর কারণ, পুলিশের ওপর সব সময়ের নির্ভরতা কমানো। যদিও ডিসিদের এই প্রস্তাব শেষ পর্যন্ত নাকচ হয়ে যায়।

অন্যদিকে বিচার বিভাগের সঙ্গে প্রশাসনের মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব মূলত বিচার বিভাগ পৃথক্‌করণ নিয়ে। ২০০৭ সালে বিচার বিভাগ আলাদা হওয়ায় নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা বিচার করার ক্ষমতা হারান। তাঁরা এখন শুধু ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করতে পারেন। এ নিয়েও মামলা বিচারাধীন।

আবার পুলিশ ও প্রশাসন ক্যাডারের লোকজন মনে করেন, আদালত ইচ্ছা করেই কখনো কখনো তাঁদের অপদস্থ করেন। ফেনীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহানের বক্তব্যের ভিডিও ধারণ ও প্রচারের মামলায় জামিন শুনানিতে গত ৯ জুলাই হাইকোর্ট বলেন, কিছু কিছু ওসি, ডিসি আছেন, যাঁরা নিজেদের জমিদার মনে করেন। সত্যিকার অর্থে তাঁরা সর্বেসর্বা প্রদর্শন করে থাকেন। ওই মামলায় গত ১৬ জুন গ্রেপ্তার হন সোনাগাজী থানার ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন।

সাম্প্রতিক সময়ে পুলিশের ডিআইজি মিজানুর রহমানকে গ্রেপ্তার করা নিয়ে উচ্চ আদালতের মন্তব্য ভালোভাবে দেখছে না পুলিশ। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কর্মকর্তা এনামুল বাছিরকে ঘুষ দেওয়ার কথা স্বীকার করা মিজানকে কেন গ্রেপ্তার করা হচ্ছিল না, তা জানতে চান সর্বোচ্চ আদালত। গত ১৬ জুন দুদক আইনজীবীকে আদালত প্রশ্ন করেন, ডিআইজি মিজানুর রহমান কি দুদকের চেয়ে ক্ষমতাশালী?

রাষ্ট্রের তিনটি বিভাগের মধ্যে বিরোধ স্পষ্ট হয় ২০১৭ সালে। সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা আদালতের ভেতর-বাইরে এ নিয়ে একের পর এক কথা বলতে থাকেন। আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের সঙ্গে তাঁর বিরোধ স্পষ্ট হয়ে পড়ে। অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমকে প্রকাশ্যে আদালতে তিরস্কার করেন তিনি। এ নিয়ে অস্বস্তিকর পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পারস্পরিক দোষারোপের পথে না হেঁটে সংসদ, বিচার বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগকে সমঝোতার মাধ্যমে কাজ করার পরামর্শ দেন। ওই বছরের ২৮ এপ্রিল ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ক্ষমতা কারও কিন্তু কম নয়৷ এখন কে কাকে সম্মান করবে, কে কাকে করবে না, কে কার সিদ্ধান্ত নাকচ করবে, কে কাকে মানবে, না মানবে এই দ্বন্দ্বে যদি আমরা যাই, তাহলে কিন্তু একটি রাষ্ট্র সুষ্ঠুভাবে চলতে পারে না৷’

রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ এই বিভাগগুলোর সমন্বয় বা সমঝোতা এখনো কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় ঘটেনি। সমালোচনার কেন্দ্রে থাকা পুলিশ, মাথাভারী প্রশাসন এবং মামলার পাহাড় নিয়ে বিচার বিভাগকে যেন চলতে হবে, তা-ই চলছে। পুলিশ বা প্রশাসনের কাজকর্মেও সমন্বয় কম। সামগ্রিকভাবে সবাই তাকিয়ে থাকছে সরকারপ্রধানের দিকে। নইলে গণপিটুনি, গণধর্ষণ বা তারও আগে গণগ্রেপ্তারের ঘটনাগুলো বন্ধে সরকারপ্রধানকে নির্দেশ দিতে হয় কেন? এর কারণ, যাঁর যে দায়িত্ব, তা পালন করছেন না।


শরিফুজ্জামান হেড অব রিপোর্টিং, প্রথম আলো