স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে কাজে লাগাতে হবে

জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবে খরা ও বন্যার মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটে, যা ফসল উৎপাদনকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং সচ্ছল মানুষকেও উদ্বাস্তু করে। কিন্তু ফসলহানি বা বাস্তুচ্যুত হওয়ার মূল কারণ যে জলবায়ু পরিবর্তন, তা সাদা চোখে দৃশ্যমান হয় না। জলবায়ু পরিবর্তন শুধু যে সম্পন্ন গৃহস্থকে ভিক্ষুকে পরিণত করছে তা নয়, মানবাধিকারের ওপরও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। সুস্থ পরিবেশ বা প্রতিবেশ ছাড়া খাদ্য, স্বাস্থ্য বা শিক্ষার মতো মৌলিক অধিকারগুলো ভোগ করা যায় না। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে কাজের সুযোগ কমে যাচ্ছে। অন্যদিকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ মানুষকে নিরাপদ স্থানে যেতে বাধ্য করছে এবং বৈশ্বিক খাদ্যশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তাও ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। 

এই ঝুঁকি এড়াতে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সীমিত রাখার যে চেষ্টা, তা কতটুকু সফল হবে, তা একটি বিরাট প্রশ্ন। বলা হয়ে থাকে, তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেলে পৃথিবীর অর্ধেক হিমবাহ বিলীন হয়ে যাবে। 

জলবায়ু পরিবর্তনে দর-কষাকষির উচ্চমার্গীয় কারিগরি প্রকৃতি অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্থানীয় বাসিন্দা বা জনগোষ্ঠীর পক্ষে বোঝা দুঃসাধ্য হয়ে ওঠে। পোল্যান্ডে কপ-২৪-এ আলোচনাকারীরা প্যারিস চুক্তির ‘বিধান বই’ তৈরির উদ্যোগ নিয়েছিল। ২০২০ সাল থেকে সেটি বাস্তবায়িত হওয়ার কথা, যেটিতে রাষ্ট্রগুলোর করণীয় ও কর্তব্যের বিষয়গুলো সুনির্দিষ্ট আকারে থাকবে। এর খসড়া গাইডলাইন থেকে কিছু শব্দ বা বাক্য বাদ দেওয়ার ফলে মানবাধিকারকর্মীরা যে গ্যারান্টি বা অধিকারের বিষয়টি নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন, তা অনিশ্চিত হয়ে গেল। জলবায়ু পরিবর্তনসংক্রান্ত বিষয় থেকে প্রাপ্ত অর্থ দ্বারা ভবিষ্যৎ উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর কারণে স্থানীয় বাসিন্দারা ক্ষতির সম্মুখীন হবেন। 

জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচির তথ্য অনুসারে, দৈনিক গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন বনভূমি উজাড় ও বন ধ্বংসের ফল। গেল বছর জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক আলোচনায় জলবায়ু নীতিনির্ধারণীতে জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারকারী কোম্পানিগুলোর প্রভাব আলোচনাকারীদের ক্ষমতা খর্ব করেছে, জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারকারী শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোর অবস্থান প্যারিস চুক্তির ভাগ্যকে অনিশ্চিত করে তুলেছে। বন উজাড় ও বন অবক্ষয়ের ফলে সৃষ্ট কার্বন নিঃসরণ হ্রাস কর্মসূচি উন্নয়নশীল দেশগুলোর জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, জলপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ ও বননির্ভর জনগোষ্ঠীর জীবিকায়নকে বাধাগ্রস্ত করছে। আন্তর্জাতিক চুক্তিতে বনায়ন কর্মসূচি বাড়ানোর মাধ্যমে কার্বন ডাই-অক্সাইড নিয়ন্ত্রণ করার কথা বলা আছে। প্রয়োজনীয় ও সুষ্ঠু পরিকল্পনা বা প্রকল্পের অভাবে এই উদ্যোগ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে পারে। 

কোনো অঞ্চলের স্থানীয় বাসিন্দা বা সেখানকার আদিবাসীরা জলবায়ু পরিবর্তনের বিপর্যয়কর প্রভাবের ঝুঁকির ক্ষেত্রে প্রথম সারিতে থাকে। কারণ, জীবনধারণের মৌলিক প্রয়োজনগুলোর জন্য তারা তাদের চারপাশের প্রাকৃতিক পরিবেশের ওপর নির্ভরশীল। এ জন্য খাদ্য, স্বাস্থ্য ও অন্য সবকিছুর স্বার্থে পরিবেশের সুরক্ষা ও সংরক্ষণ তাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। তাদের অনেকেই এখন ভীষণ রকমের ভঙ্গুর ইকোসিস্টেমে বসবাস করছে, যার প্রভাব দিন দিন দৃশ্যমান হয়ে উঠছে। বিশেষত, সুপেয় পানিপ্রাপ্তির বেলায় এটা সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এ ধরনের এলাকায় কোনো কলকারখানা না থাকলেও অন্য এলাকার কারখানার প্রভাবের কারণে সমানভাবে এখানকার বায়ু দূষিত হয়। অতীতে দেখা গেছে, স্থানীয় জনগোষ্ঠীর অধিকার খর্ব করে নতুন নতুন পার্ক বা উদ্যান সৃষ্টির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। 

 প্রকৃতিনির্ভর স্থানীয় জনগোষ্ঠী খুব দক্ষতার সঙ্গে ইকোসিস্টেম রক্ষা করে এলেও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তা বিপর্যয়ের মুখে পড়ে যাচ্ছে। অথচ তার দায় কোনোভাবেই তাদের নয়। ফলে তাদের অধিকার সংরক্ষণের দিকে বাড়তি মনোযোগ দেওয়া জরুরি। সেটা করা গেলে ইকোসিস্টেম রক্ষা ও টিকে থাকার নিশ্চয়তা বাড়বে। বহু বছর ধরে রাজনৈতিক নেতা ও সুশীল সমাজকে অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে ‘তলনোয়া সংলাপ’ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া কার্যক্রমে (যেটি ২৪তম কপ-এ শেষ হয়েছে) অতি জরুরিভাবে জলবায়ু পরিবর্তনে করণীয় বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে আহ্বান জানানো হয়েছে। সেখানে আদিবাসীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করারও আহ্বান জানানো হয়। 

যদিও জলবায়ু পরিবর্তন কনভেনশনে রাষ্ট্রসমূহ ও আদিবাসীদের সম-অংশগ্রহণের জন্য জলবায়ু কনভেনশন আনুষ্ঠানিক গঠন ও সাংগঠনিক প্রক্রিয়া বিদ্যমান, তদুপরি তাদের প্রথাগত জ্ঞান, যা জলবায়ু পরিবর্তন রোধের পথে দেখানো সমাধানের পথ উপেক্ষিত। ‘বিপন্ন প্রতিবেশ রক্ষার্থে স্থানীয় জ্ঞানের অবদান’ শীর্ষক স্থানীয় জনগোষ্ঠী এবং আদিবাসী গবেষণার ফলাফলে দেখা গেছে, যেসব প্রকল্পে আদিবাসী ও স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল, সেগুলো সফলতার মুখ দেখেছে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে প্রাণবৈচিত্র্য এবং প্রতিবেশের উচ্চতম পর্যায় বিরাজমান। প্রথাগত আদিবাসী অঞ্চলগুলো পৃথিবীর শতকরা ২২ ভাগ হলেও এ গ্রহের ৮০ ভাগ ও অধিক প্রাণবৈচিত্র্যসমৃদ্ধ এলাকাগুলো হলো আদিবাসী অঞ্চল। 

বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি বিষয়ে নীতিমালা এমনভাবে তৈরি করা প্রয়োজন, যেন বৈশ্বিক থেকে স্থানীয় পর্যায় পর্যন্ত আদিবাসীরা জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট বিপর্যয়ের সমাধানের পথে বা কার্যক্রমে সমভাবে অংশগ্রহণ করতে পারে। জলবায়ু ক্রমবর্ধমান বিপর্যয়কর প্রভাব রোধে আমাদের প্রতিটি ক্ষেত্রে ব্যবহারযোগ্য প্রতিটি প্রয়োজনীয় হাতিয়ার ব্যবহার করতে হবে। আদিবাসী বা স্থানীয় জনগোষ্ঠীর ভূমিকাকে সমর্থন শুধু নৈতিক বা মানবিক নয়, এটা পরিবেশ রক্ষার অন্যতম কার্যকরী কৌশল এবং দক্ষ উপায়ও বটে। 

পণ্ডিত নোয়াম চমস্কি বলেছেন, বিশ্ব পরিবেশ বিপর্যয় মুখোমুখি হয়েছে এবং হতে যাচ্ছে আর এ বিপর্যয় প্রতিরোধের জন্য একমাত্র আদিবাসীরা দাঁড়ানো আছে। 

গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ডের মূল্যায়নপত্র ও আইপিসিসির রিপোর্টে প্রকাশ, তাদের প্রস্তাবগুলো অবহেলিত। শতাব্দীকাল ধরে তাদের পরিবেশ থেকে অর্জিত মূল্যবান জ্ঞানকে অবহেলা করা হচ্ছে। তাদের এ জ্ঞান জলবায়ু পরিবর্তন রোধে মৌলিক ভিত্তি। আমাজন অববাহিকায় দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন অঞ্চলে আদিবাসী এলাকা ও এর বাইরে কার্বন ঘনত্বের পরিবর্তনের বৈজ্ঞানিক পরিসংখ্যান পরিবেশ সংরক্ষণে স্থানীয় ও আদিবাসীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা প্রমাণিত হয়। 

পিডিশন প্রধান বৃহত্তর সিলেট আদিবাসী ফোরামের সভাপতি